আলী রীয়াজের 'লেখকের দায়', অসামান্য  উপলব্ধি

সত্য বয়ান উজ্জ্বল ও যৌক্তিক হয়ে ওঠেছে প্রবন্ধকারের নির্ভীক নির্মম সাহিত্য সমালোচনার মাধ্যমে।

আলী রীয়াজের 'লেখকের দায়' গতানুগতিক কোন রচনা না। এই বই চিন্তার নানান দরজা খুলে দেয়। যেমন বইটি পড়ে উপলব্ধি হয়েছে- আমরা যতোটা সুন্দর দেখি তার কিছুটা হয়তো চোখের ভুল। অথচ চোখের দেখাতেই সম্পর্কের গোড়াপত্তন হয়। অদেখাকে দেখার যতোই আকাঙ্ক্ষা থাকুক না কেন মায়া কিন্তু জন্মে না। চোখে ভালো লাগলেই মনে মায়া জন্মে- জানার আগ্রহ বাড়ে, হয় প্রেমের সূচনা। মায়া সুঁতোর অদৃশ্য গিরায় আটকে গেলে মন ফিরানো দায়।

প্রশ্ন হলো 'লেখকের দায়' প্রবন্ধের বইটি নিয়ে এসব কথা বলার হেতু কি! হেতু আছে এই হেতু বুঝতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে। কথায় আছে- 'বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না' আর আমার উপলব্ধি, বই পড়ে কেউই ঠকে না। এবার সহজ করে বললে- শিক্ষক, গবেষক ও প্রবন্ধকার আলী রীয়াজের বইটি পড়লে কতটা লাভবান হবেন তার কিছু দিক তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এই নামের ভিতর মলাট বন্দি করেছেন- ১৯৪৭-৭৭ সালের অর্থাৎ তিন দশকের ছোটগল্পের ইতিউতি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবি ও সাহিত্যিকরা আলাদা পথে চলতে শুরু করেন। নিজস্ব বিশ্বাস ও ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা সাহিত্যে উজ্জ্বল করার প্রচেষ্টায় মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। প্রবন্ধকার খুব দৃঢ়ভাবে সেসময়ের কথাসাহিত্যে লেখকদের আলাদা হয়ে নতুন পথে যাত্রা শুরুকে তুলে ধরেছেন এভাবে- 'বাংলা গদ্যের দেড়শ বছরের পল্লবিত সুষমা ও উপন্যাস শাখার পঁচাত্তর বছরের ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের সাহিত্যের ভিত্তিভূমিটি গড়ে ওঠে।

তিনি এমনসব বাস্তব কিন্তু জটিল যৌক্তিক বিষয় তুলে ধরেছেন। একজন সাহিত্যপ্রেমীর জন্য এসকল বিষয় শুধু আননন্দায়কই নয় জানাও আবশ্যক। কথাসাহিত্য পড়তে সবারই ভালো লাগে। তবে সেই কথাসাহিত্য সৃষ্টির তাৎপর্য যদি জেনে পড়া যায় তবে তা সাহিত্যের সাহিত্যরস বহু গুণে বাড়িয়ে দেয়। 'তিনদশকের ছোটগল্প কয়েকেটি প্রবণতা' তৎকালীন ছোটগল্পকারদের লেখার প্রেক্ষাপট, পটভূমি ও লেখকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, সেসময়কার ছোটগল্পের লেখকদের একধরণের মূল্যায়ন করার চেষ্টাও করেছেন। এমন সমালোচনাধর্মী মূল্যায়ন সাহিত্যে খুবই গুরুত্ব বহন করে।

হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান হয় না তেমন সব লেখকদের লেখা বা উপস্থাপনও এক হবে না সেটা সর্বজন স্বীকৃত স্বাভাবিক। কারো পড়ার স্বাদে যদি প্রথম চৌধুরীর প্রবন্ধের রসবোধ লেগে থাকে আর তিনি যদি সেই রসবোধ আশায় সবার লেখা পড়া শুরু করেন অথবা সেই রকমের স্বাদ পাওয়ার প্রত্যাশায় ব্যাকুল হয়ে হয়ে ওঠেন তবে তার জন্য সব ধরণের লেখা পড়া এবং নতুনত্বের স্বাদ আস্বাদন করা মুশকিল। তবে একথা অস্বীকার করার অবকাশ নেই, সাহিত্যে রস-রসায়নের প্রত্যাশা বাঞ্ছিত।

যে কোনো লেখায় ছন্দ একটা বিশেষ উপাদান। কোন লেখা পড়তে গিয়ে যদি পাঠক বাক্যে শব্দের প্রবহমানতা না পায় অর্থাৎ পড়ার সময় বাবার স্বরভঙ্গ হয় তা পাঠকের পাঠসুখে জ্বালা ধরায়। কারো রচনায় যদি এমনটা ঘটে থাকে তবে সে দায় লেখকে নিতেই হবে। আলো সরালে অন্ধকার নেমে আসে আবার অন্ধকার ঠেলে দিলে আলো হাসিমুখে ফুটে ওঠে।

অন্যভাবে বললে, ভালো আর মন্দ এক শরীরের দুই মুখ। দেখার দৃষ্টিভঙ্গি অনেককিছু বদলে দেয়। 'লেখকের দায়' প্রবন্ধ সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গির শান্ত মেজাজ নিয়ে পাঠ শুরু করলে যে কারো সাহিত্যের অনেক জিজ্ঞেসার উত্তর মিলবে। সাতচল্লিশ পরবর্তী সাহিত্য চর্চার একটা রুপরেখাও পাওয়া যাবে। যেমন,'নিখোঁজ কথাসাহিত্যিকদের প্রত্যাবর্তন' নিবন্ধটি পড়লে বক্তব্য সবার কাছে ক্লিয়ার হবে। বিস্ময়কর এক বয়ান লক্ষ্য করা যায়- 'কথাসাহিত্যিকরা- বছর দশেক আগেও নিখোঁজ হয়েছিলেন আমাদের চারপাশ থেকে। তেহাত্তর কি চুয়াত্তর সালের বিশাল অঙ্গনের দিকে তাকিয়ে কাউকেই আর চোখে পড়ত না।' (নিখোঁজ কথাসাহিত্যিকদের প্রত্যাবর্তন)।

কথাসাহিত্য নিয়ে তথ্যবহুল অর্থবহ আলোচনা আছে। নবীন সাহিত্যিক ও কথাসাহিত্যের পাঠকদের জন্য যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রবন্ধকার তার দায় মিটাতে বহুল আয়োজনের প্রয়াস চালিয়েছেন। আলোচনা করছেন শওকত আলীর কথাসাহিত্য নিয়ে।

এই সত্য বয়ান উজ্জ্বল ও যৌক্তিক হয়ে ওঠেছে প্রবন্ধকারের নির্ভীক নির্মম সাহিত্য সমালোচনার মাধ্যমে। প্রবন্ধকারের ভাষায় 'পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের মাঝামাঝি বেড়ে ওঠা হাসান আজিজুল হক, নক্ষত্রের মতো জ্বলে ওঠা আহমদ ছফা আর প্রবীণ সত্যেন সেনকে বাদ দিলে গোটা কথাসাহিত্যিকদের রচনা কোন শিল্পের বিচারের মাপকাঠিতে সমাজের বেদনার ও আকাঙ্ক্ষার ছবি হতে পেরেছেন?' (নিখোঁজ কথাসাহিত্যিকদের প্রত্যাবর্তন)। এমন প্রশ্নের জন্ম দিয়েই ক্ষান্ত দেননি যথাসম্ভব এসবের ব্যাখ্যাও উপস্থাপন করছেন। সাহিত্য অনুসন্ধানকারীদের খোরক যোগানোর সাথে আরও নানান প্রশ্নেরও জন্ম দিতেই থাকবে। কিছু অমীমাংসিত প্রশ্নের জন্ম দিয়ে কালের খেয়াকে দোদুল্যমান করে দুলত দুলতে অগ্রসর হতে থাকবে সময়ের নদী। এটা কম আনন্দের কিসের। প্রাসঙ্গিকও বটে।

'লেখকের দায়' পড়লে সন্ধান পাওয়া যাবে কালের স্তূপে চাপা পড়া গত লেখকদের। কালের খেয়ায় যাদের ফসল আছে কিন্তু নানান কারণে সেসব ফসল চাপা আছে। কথাসাহিত্যিক কায়েস আহমেদের নাম নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। কথাসাহিত্য নিয়ে তথ্যবহুল অর্থবহ আলোচনা আছে। নবীন সাহিত্যিক ও কথাসাহিত্যের পাঠকদের জন্য যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রবন্ধকার তার দায় মিটাতে বহুল আয়োজনের প্রয়াস চালিয়েছেন। আলোচনা করছেন শওকত আলীর কথাসাহিত্য নিয়ে।

সেই সঙ্গে অনেক অজানা বিষয়ে অবগত হওয়ার সুযোগ আছে। সামনে আগাতে হলে অতীতকে জানতে হবে। নতুন কিছু সৃজন করতে হলে আগের সৃষ্টিকর্মকে জানার বিকল্প নেই। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কথাসাহিত্যের স্বরূপ নির্ণয় করেছেন 'তিন দশকের প্রবন্ধ-চর্চা' শিরোনামে। এই আলোচনা যদি নিষ্ফলা হতো তাহলে আমি সুন্দরভাবে এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু এড়ানো সম্ভব নয়। এতে কবিতা-প্রেমীদের জন্য তৃষ্ণা না মিটিয়ে বরং জানার তৃষ্ণাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। 

যারা জানতে ইচ্ছুক তারা সবকিছু থেকেই জানতে পারে। সুন্দর মনের চোখ কখনো নিরাশ হয় না । কবি রফিক আজাদকে নিয়ে লেখা 'সুন্দরের দিকে চোখ রেখে' পড়ে নির্দ্বিধায় আমার উপরোক্ত বয়ান মিলিয়ে নিতে সক্ষম হবেন। যারা কবি রফিক আজাদকে অতো বেশি জানেন না তাদের জন্য অমৃত বললে ভুল বা বাড়াবড়ি হবে না। বরং এটা পড়ার পর রফিক আজাদের কবিতা পড়ার আগ্রহ জন্মাবে।

অন্যদিকে রোমান্টিক কবি আবুল হাসানকে তো সবাই চিনেন। তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন এতে। প্রবন্ধকার আবুল হাসানের প্রকাশিত তিনটি কাব্য থেকেই আলোচনা করছেন। সংক্ষিপ্ত পরিসরে কবি ও তার কবিতার আলোচনা সত্যি প্রশংসার দাবিদার।

এছাড়াও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে নিয়ে আছে তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা। শিল্প, সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে সার্থক এক আলোচনার প্রায়শ চালিয়ে প্রবন্ধকার তার দায় মিটিয়েছেন। 'লেখকের দায়' বইটিকে সার্থক করতে পাঠকের পাঠ ও শিক্ষার্থীদের আবশ্যক পাঠ।

Comments