বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি জাহানারা ইমাম

যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় স্বীকৃত ও বিশ্বজুড়ে বন্দিত। দেশের এই শক্তি-অনন্য বৈশিষ্ট্য আমরা জাহানারা ইমামের মধ্যেও প্রবলভাবে দেখতে পাই।
ছবি: সংগৃহীত

কোন কোন মানুষ থাকে, যিনি কর্মে, সাধনায়-ত্যাগে সবার আশ্রয় হয়ে ওঠেন। একটা দেশ যেমন সবাইকে ধারণ করে, কোন ভেদাভেদ রাখে না। তিনিও হয়ে ওঠেন অবিকল তাই। তখন সেই মানুষটা-আর দেশ একাকার হয়ে যায়। এক জায়গায় এসে মিলিত হয়। জাহানারা ইমাম ছিলেন তেমন একজন মানুষ। হয়ে উঠেছিলেন দেশের প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের মুখ।

এই দেশটাকে নিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, 'সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/তবু মাথা নোয়াবার নয়।' আমরা যদি নিকট ইতিহাসের দিকে তাকাই তা হলে তো বটেই, ইতিহাসের ধূসর অতীতও বলছে এই দেশটি, এই জনপদের মানুষেরা, এই ভূগোলের প্রকৃতি-পরিবেশের সবকিছুই কখনো মাথা নোয়ায়নি। নানা কারণে সে হয়তো আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে, পরাজিত হয়েছে, কিন্তু নিজের সত্তাকে কখনও বিকিয়ে দেয়নি। শত্রুর সঙ্গে কোন প্রকার আপস করেনি। সময়ের প্রয়োজনে এই দেশ কতটা রুদ্র মূর্তি ধারণ করতে পারে, কীভাবে আত্মসত্তার লড়াই জারি রাখতে হয় মানচিত্রের জন্য-মাতৃভাষার জন্য-সর্বোপরি মাতৃভূমির প্রশ্নে তার নজির মোটেই অপ্রতুল নয়। বরং এসবের প্রশ্নে এ দেশের কাছে পৃথিবীর অনেক জাতি-গোষ্ঠীরই শিক্ষণীয় রয়েছে বলে আমরা মনে করি। 

প্রসঙ্গে স্মরণ করি, আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে। যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় স্বীকৃত ও বিশ্বজুড়ে বন্দিত। দেশের এই শক্তি-অনন্য বৈশিষ্ট্য আমরা জাহানারা ইমামের মধ্যেও প্রবলভাবে দেখতে পাই।

জাহানারা ইমামের মাত্র ৬৩ বছরের জীবন। কিন্তু এই সময়পর্বটা বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক কালপর্ব। ইতিহাসের বাঁক বদলানো ঘটনাসমূহ উনার ইহজাগতিকতাতেই সম্পন্ন হয়। ব্রিটিশ-ভারতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পাকিস্তান রাষ্ট্রে কর্ম ও সংসার জীবন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ঊষালগ্নে শুরু হয় উনার অন্যরকম এক জীবন, যা জারি থাকে মৃত্যুবধি।

বলছিলাম, এদেশ সময়ের প্রয়োজনে এমন এক ভূমিকা পালন করতে পারে-অতীতে যা করেছে, তার তুলনা আক্ষরিক অর্থেই প্রাতিস্বিক ও অকল্পনীয়। জাহানারা ইমামও ঠিক তেমন ভূমিকা পালন করে হাজির করেছেন অভাবনীয় এক দৃষ্টান্ত।   

ব্রিটিশ ভারতের চারের দশকে একজন নারীর লেখাপড়া শেখা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের। যা আমরা দেখতে পাই কাজী ইমদাদুল হক-এর উপন্যাস আবদুল্লাহ-তে। তখন পীরবাদের রমরমা মৌসুম, নারী মাত্রই গৃহবন্দী। ব্যতিক্রম হল ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী, রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, সুফিয়া কামাল-এর মতো কয়েকজন। এই সময়ে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন তিনি। পাকিস্তান আমলে করেছেন শিক্ষকতা, স্কুল ও কলেজে।

পাশাপাশি লেখালেখির চর্চায় ছিলেন নিবেদিত প্রাণ, যা সক্রিয় ছিল জীবনের সকল পর্যায়ে সাধনার অংশ হিসেবে। কিন্তু এসবের মধ্যে দিয়ে ঠিক যে জাহানারা ইমামকে আমরা দেশ হিসেবে জানি ও মান্যতা দিই, তার কোনকিছুই স্পষ্ট হয় না। যা বুঝতে হলে, আমাদেরকে ১৯৭১ থেকে ১৯৯৪ সময়পর্বের জাহানারা ইমামকে বুঝতে হবে। এবং এই বোঝাবুঝি পরিষ্কার হলেই উন্মোচন করা সম্ভব হবে তিনি কেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি, বাংলাদেশের মুখ, প্রগতিশীল বাংলাদেশের দর্পণ সেই জিজ্ঞাসার যাবতীয় উত্তর ও যৌক্তিকতা।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে তখন এই ভূখণ্ডের সব মানুষের মতোই জাহানারা ইমামের পরিবারেরও প্রতিটা  মুহূর্ত কেটেছে ভীষণ রকমের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। বঙ্গবন্ধুর কাছে যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করা না হয়, তা হলে যুদ্ধ যে অনিবার্য এবং পাকিস্তানীরা সময়ক্ষেপণের কৌশলে সেদিকেই এগোচ্ছে সেটা স্পষ্ট হচ্ছিল প্রতিদিনের রোজনামচায়।

জাহানারা ইমাম তখন এ বিষয়টা কেবল ঠাহর করেননি, এর গুরুত্বও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। একটা জাতির স্বাধীনতার লড়াই শুরু হতে যাওয়ার ইংগিত ও ইশারা। ১৯৭১-র মার্চ থেকে লিখতে শুরু করলেন দিনলিপি। এর পরের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকল খুবই দ্রুত। কিন্তু তার কোনটাই বাদ দিলেন না তিনি। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিনের ঘটনার বিশ্বস্ত এক দলিল হয়ে উঠল উনার দিনপঞ্জি।

জাহানারা ইমামের বাসা ছিল রাজধানী ঢাকার এলিফেন্ট রোডে, নাম 'কণিকা'। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পায়ে হাঁটা দুরত্বে, সেদিনের ইপিআর পিলখানা থেকেও তাই। ২৫ মার্চের রাতে দুই জায়গাতেই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। তখন পুরো বাংলাদেশে, রাজধানী ঢাকায় ছিল ঘরে ঘরে আতঙ্ক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, এলিফেন্ট রোড, শাহবাগে। 'কণিকা' ছিল ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আশ্রয়, পরামর্শ কেন্দ্র। স্বামী শরীফ ইমাম ছিল প্রকৌশলী, মুক্তিযোদ্ধারা উনার কাছে আসতেন নানা ধরণের প্রকৌশল বিদ্যার গোমর জানতে-যা কাজে লাগানো হত গেরিলা অপারেশনে। 

এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমী। তারপর কিছুদিনের মধ্যে হয়ে গেলেন নিখোঁজ। সন্তান যে আর নেই সেটা বুঝেছিলেন, তারপরও হয়তো একটু আশা ধরে রেখেছিলেন বুকের গভীরে, মাতৃহৃদয়ে যেমনটা হয়। যুদ্ধের পরে রুমী একদিন ফিরে আসবে, নিশ্চয়। এরই মধ্যে মারা গেলেন স্বামী। তবুও যুদ্ধ শেষ হয় না। জাহানারা ইমামের দিনলিপি লেখাও বন্ধ হয় না। সেই সময় এরকম একটা দিনলিপি যে কতো বড়ো ঝুঁকির তা হয়তো এইসময়ে বসে কল্পনা করাও সম্ভব নয়।

আমরা জানি, দিনপঞ্জি লেখার অভ্যাস ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশীদুল হাসানের। উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ১৯৬৯-এর পুরো সময়ের দিনলিপি। ১৯৭১-এর দিনলিপিও পাওয়া যায়, তবে তা মাত্র কয়েকদিনের। বেশীরভাগই ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ফলে, আমরা একটা পূর্ণাঙ্গ দিনপঞ্জি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। রাশীদুল হাসানের দিনলিপির শেষ পৃষ্ঠাটা পাওয়া যায় ১২ ডিসেম্বরের, দেশের জন্য আর্তি আর ভালবাসায় ভরা। রাশীদুল হাসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আনোয়ার পাশা, 'রাইফেল রোটি আওরাত' এর লেখক, যা স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের একমাত্র কথা সাহিত্য।

জাহানারা ইমাম দেশ স্বাধীনের পর হয়ে উঠলেন শহীদ জননী। প্রথমে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুত্র-রুমীর বন্ধুদের কাছে। তার পর সকল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে-সকলের কাছে হয়ে উঠলেন 'আম্মা'। পৃথিবীর ইতিহাসে এভাবে কেউ একটা ভূগোলের বেশীরভাগ মানুষের কাছে সর্বজনীনভাবে 'আম্মা হয়ে উঠেছেন এরকম কোন নজির কম।

পরিবারের কাছে শুনেছিলাম কী ঝুঁকি নিয়ে-উনারা ওই উপন্যাস সংরক্ষণ করেছেন। একদিকে প্রাণে বেঁচে থাকার তাড়না ও আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে, 'রাইফেল রোটি আওরাত' এর পাণ্ডুলিপি রক্ষার ইচ্ছে, প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। এই নিয়ে একাত্তরের দিনগুলির পুরোটা সময় কেটেছে এসকল পরিবারের। এঁদের প্রত্যেকের লক্ষ্য ছিল কেবল নিজে বা নিজেরা বাঁচলেই হবে না, সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হবে, দেশটাকে বাঁচাতে হবে। এই যে, সবাইকে নিয়ে বাঁচতে শেখা; এটাই বড়ো মানুষের-মহত্তম মানুষের চারিত্র্য লক্ষণ। যা উনাদের সকলের ছিল। আরও একটা বড় বিষয় ছিল-জীবনকে রাঙায়িত ও প্রভাবিত করে এরকম জিনিসের গুরুত্ব বোঝার প্রজ্ঞা । সেই যুদ্ধদিনেই উনারা বুঝেছিলেন, এই যুদ্ধের পর যখন দেশ স্বাধীন হবে, তখন খুব করে জানার প্রয়োজন হবে যুদ্ধদিনের ঘনটাবলী-রোজনামচা। 

এই জন্য সেদিন এ জাতির দিক নির্দেশক মানুষেরা লিখেছিলেন সৃজন ও মননধর্মী সব লেখা-কথাসাহিত্য, দিনলিপি কিংবা কবিতা। শামসুর রাহমানের 'বন্দী শিবির থেকে' কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো এ সময়েই লেখা। যার দুটো কবিতা 'স্বাধীনতা তুমি' ও 'তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা' আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অমর এক কাব্যিক দলিলের মর্যাদায় স্বীকৃত ও নন্দিত। আনোয়ার পাশা ও রাশীদুল হাসানকে আমরা স্বাধীনতার বিজয় আসার আগেই হারিয়েছি। জাহানারা ইমাম বেঁচে ছিলেন, সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছিল উনার লেখা একাত্তরের দিনলিপি। যা পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশিত হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোকে ব্যক্তির নিরিখে বুঝতে এটাই সবচেয়ে গুরুত্ববহ ও বিশ্বস্ত এক দালিলিক প্রমাণ।

জাহানারা ইমাম দেশ স্বাধীনের পর হয়ে উঠলেন শহীদ জননী। প্রথমে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুত্র-রুমীর বন্ধুদের কাছে। তার পর সকল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে-সকলের কাছে হয়ে উঠলেন 'আম্মা'। পৃথিবীর ইতিহাসে এভাবে কেউ একটা ভূগোলের বেশীরভাগ মানুষের কাছে সর্বজনীনভাবে 'আম্মা হয়ে উঠেছেন এরকম কোন নজির কম। সকলকে সর্বাবস্থায় কাছে টেনে নেয়ার অপার্থিব এক গুণ উনার মধ্যে ছিল, যা অর্জন করেছিলেন দেশকে ভালবেসে-দেশের মানুষকে ভালবেসে। এই ভালবাসায় উনাকে শেষ জীবনে হাজির করেছিল কঠিন এক লড়াইয়ের ময়দানে।

ছবি: সংগৃহীত

বাঙালি জাতির জন্য ভীষণ ট্রাজেডির যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স রজত জয়ন্তী পূর্ণ হওয়ার আগেই এখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে করা হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রযত্নে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে মাথা তোলার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লুণ্ঠন করার মতো দুঃসাহস ও ঔদ্ধত্যও দেখিয়েছিল তারা। এই ডামাডোলের মধ্যেই পাকিস্তানের পাসপোর্টধারী গোলাম আজমকে ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর জামায়াত ইসলামের প্রকাশ্য আমীর ঘোষণা করা হয়। গোলাম আজম ও তার দল ছিল একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতাকারী। ধর্মের নামে এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতির প্রশ্নে ধর্মকে যেন হাতিয়ার করা না হয়, তারা সুরাহা হয়ে গিয়েছিল একাত্তরে। স্বাধীনতা বিরোধীন চক্র ধর্মকে নিজেদের প্রয়োজনে আবারও ব্যবহার করতে শুরু করে এবং নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের প্রশ্নে বিভ্রান্ত করতে শুরু করে। প্রগতিশীল বাংলাদেশ কঠিন এক দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়।

জাহানারা ইমাম এই সময় পালন করেন অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় এক ভূমিকা। মা যেমন সন্তানের আপদে-বিপদে নিজের সর্বস্ব দিয়ে সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। 'আম্মা'ও সেদিন মমতাময়ী মা রূপে আবির্ভূত হন। সকলকে সংগঠিত করে গঠন করেন 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি'। তিনি হন এর আহবায়ক। উনার আহবানে সাড়া দেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তি। সকলের সমর্থনে তিনি গড়ে তোলেন গণ-আদালত।

যা ছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অপকর্ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ। এই আদালত গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রকে অনুরোধ করেন। কিন্তু রাষ্ট্র সেই অনুরোধ কেবল উপেক্ষা করেনি, উপরন্তু জাহানারা ইমামসহ ২৪জন বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করে। মৃত্যুর সময়েও জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে এই মামলা চলমান ছিল।

জাহানারা ইমাম যখন 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি' গঠন করছেন তারও বেশ আগে থেকে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। মরণব্যাধি এই কর্কটরোগও উনাকে দেশের প্রয়োজনে নীরব রাখতে পারেনি। এখানেই জাহানারা ইমামের স্বতন্ত্রতা। সবকিছুর ওপরে দেশ-দেশের মানুষ। এ কারণেই তিনি সকলের 'আম্মা'। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। প্রগতিশীল বাংলাদেশের মুখ।

লেখার শুরুতে বলেছিলাম, বাংলাদেশ-এর সঙ্গে জাহানারা ইমামের হুবহু সাদৃশ্য-অনেক মিল। কেন বলেছিলাম একথা লেখার শেষাশেষি এসে-তা খোলতাই করে শেষ করব এই লেখা। নীরদচন্দ্র চৌধুরী ১৯৬৬-তে 'পূর্ববঙ্গের সমস্যা' নামে একলেখায় বলেছিলেন এই জনপদের মানুষের-ভূ-প্রকৃতির, প্রাণ বৈচিত্র্যের, নদী-নালার, আবহাওয়ার, সংস্কৃতির, ভাষার লোকধর্মের, ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে কারও অধীনতা না মানার বৈশিষ্ট্য ও বিশিষ্টতা। 

একই ধরণের বয়ান আমরা দেখি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের লেখাতেও। তিনি বলেছেন, এই ভূগোলের ভাষার, সংস্কৃতির, ঐতিহ্যের, প্রকৃতির, পরিবেশের, মানুষের, ধর্মাচারের বৈশিষ্ট্য হল কারও দাসত্ব স্বীকার না করা। আজ থেকে শতবর্ষেরও বেশি সময় আগে বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে তিনি একথা বলেছিলেন, যা সকল সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ এক বয়ান।

আমরা যদি সত্যি সত্যি একটু গভীর মনোযোগে আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্য ও বিশিষ্টতা অবলোকন করি, তা হলে দেখব নীরদচন্দ্র চৌধুরী ও আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের এই মূল্যায়ন কতটা সত্য ও দ্ব্যর্থবোধক। আমাদের দেশের এই রূপের সঙ্গে আমরা কি আমাদের দেশের কয়েকজন মানুষেরও হবহু সাদৃশ্য ও মিল খুঁজে পায়, নিশ্চয়। বাংলা সাহিত্যে এ ধারায় আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, জসীম উদ্দীনকে স্মরণে নিতে পারি। রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ। বিজ্ঞানে জগদীশচন্দ্র বসু, কুদরত-ই খুদা।

জাহানারা ইমাম এসবের কোনটার সঙ্গেই ছিলেন না। সাহিত্যিক ছিলেন, একেবারে সৃজনশীল গোত্রের। ছিলেন সংস্কৃতি কর্মী, তবে অ্যাক্টিভিস্ট নন। অথচ এই মানুষটিই দেশ ও জাতির বৃহত্তর প্রশ্নে পালন করেছেন অবিস্মরণীয় এক ভূমিকা। একজন রাজনীতিবিদের, একজন সংস্কৃতিকর্মীর, একজন বুদ্ধিজীবীর, একজন লেখক-কবি-সম্পাদক-সাংবাদিকের আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও সমুন্নত রাখার প্রশ্নে যে ভূমিকা পালন করার কথা জাহানারা ইমাম সকলের হয়ে একাই সেই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছেন, সকলকে সঙ্গে নিয়ে।

সন্তান হারানোর বেদনাকে বুকে রেখে, স্বামীর মৃত্যুর শোক সঙ্গে করেই তিনি একাত্তরের দিনগুলোর দিনলিপি লেখাকে জরুরি ও কর্তব্যজ্ঞান করেছেন। আবার ক্যান্সারকে সঙ্গী করেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যখন ঘাতক ও দালালদের থাবায় ধ্বস্ত ও ক্ষতাক্ত-তখনই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে এক ছাতার নিচে এসে গঠন করেছেন 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'। গড়ে তুলেছেন গণ-আদালত। প্রতীকী রায়ে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার দায়ে দিয়েছেন গোলাম আযমের ফাঁসি।

জাহানারা ইমাম সত্যসত্যই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি, প্রগতিশীল বাংলাদেশের মুখ। কেননা এই দেশের মতোই করে তিনি জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়েছেন রোগে শোকে, স্বজন হারানোর বেদনায়; কিন্তু মাথা নত করেননি। এখানেই তিনি ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের সমান এক আম্মা, যার ক্রোড়ে ঠাঁই মেলেছিল-আজও মেলা সম্ভব শুভবোধ আর শুভপ্রত্যয়ে বিশ্বাসী সকল মানুষের।

Comments