রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগাযোগ ভাবনা

রবীন্দ্রনাথকে ছোটবেলা থেকে কবি হিসেবে জানি। বিশ্বকবি। কবি কবিতা লেখেন। আর এই কবিতা যোগাযোগের এক অনন্য শৈল্পিক ফর্ম।
ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারাজীবন সময়, সমাজ ও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগই করেছেন। বিভিন্ন ফর্মে, বিভিন্ন প্যাটার্নে যোগাযোগে করেছেন সম্পর্ক স্থাপন। তাহলে যোগাযোগ কী যে কবি সারাজীবনে করে গেলেন। খুব সাধারণভাবে যোগাযোগ বলতে আমরা বার্তা আদান-প্রদান করা, তথ্য চিন্তা ভাগাভাগি করা।

আসলে এই বিষয়টাকে মোটাদাগে আমরা ভাগ করলে পাবো অবাচনিক ও বাচনিক যোগাযোগ। ইশারা, ইঙ্গিত, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি, প্রতীক চিহ্ন এগুলোর মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে তা অবাচনিক যোগাযোগ। আবার অর্থবহ শব্দ, কথা, বাক্যেও মাধ্যমে যে যোগাযোগ কবি তা বাচনিক যোগাযোগ। আবার আচারগত দৃষ্টিকোণ ও প্রেরণমূলক দৃষ্টিকোণেও যোগাযোগকে দেখা যায়। তাহলে রবীন্দ্রনাথ কী করেছেন। কবিতা, সঙ্গীত. উপন্যাস, গল্প, ছোটগল্প, প্রবন্ধ লিখেছেন। এগুলোর মাধ্যমে তিনি যোগাযোগ করেছেন। কাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন? পাঠকের সাথে, শ্রোতার সাথে, বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সাথে বার্তা আদান-প্রদান করেছেন। প্রকাশ করেছেন মনের ভাব।

রবীন্দ্রনাথকে ছোটবেলা থেকে কবি হিসেবে জানি। বিশ্বকবি। কবি কবিতা লেখেন। আর এই কবিতা যোগাযোগের এক অনন্য শৈল্পিক ফর্ম। কবিতার একটি অনন্য ক্ষমতা রয়েছে পাঠকের মনকে অর্থপূর্ণ ধ্বনি দিয়ে পূর্ণ করার এবং হৃদয়কে অনুভূতিতে পূর্ণ করার। যোগাযোগের হাতিয়ার হিসাবে, কবিতা ভাষাকে প্রসারিত করে, একজন কবিকে এমনভাবে যোগাযোগ করতে দেয় যা লিখিত যোগাযোগের অন্যান্য ফর্ম, যেমন নিয়মিত কথোপকথন বা এমনকি গল্পও তুলে করে না।

একটু অন্যভাবে বলা যায়, কবিতা কিভাবে যোগাযোগের একটি ধরন? কবিতা কবি আবেগের সাথে যোগাযোগ করার জন্য লিখেছেন, এবং পাঠক সেই আবেগগুলিকে ব্যাখ্যা করে এবং তাদের নিজস্ব লেন্সের মাধ্যমে কবিতা থেকে অর্থ বের করে। কবিতাও একটি সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে রচিত হয়।

ঐতিহাসিকভাবে, কবিতা ছিল মৌখিক ঐতিহ্যের অংশ এবং সামাজিক সমাবেশে আবৃত্তির মাধ্যমে শেয়ার করা হতো। কথ্য শব্দ কবিতার মূলে রয়েছে শব্দের মাধ্যমে শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দেওয়ার শিল্প। একটি কথ্য শব্দের টুকরো তৈরি এবং সরবরাহ করার প্রক্রিয়াটি একজন শিক্ষার্থীর স্বচ্ছতা, আবেগ এবং প্রভাবের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতাকে উন্নত করে। কবি লিখেন -- 

'ওরে  নবীন, ওরে আমার কাঁচা,  
     ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,  
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।
রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে
আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,
সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক'রে
পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।
আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

তখন আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে কি আহবান পাই। তিনি কাদের কাছে এই চরণগুলোর বার্তা পৌঁছে দেন? প্রশ্ন হতে পারে এগুলো দিয়ে কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যোগাযোগ করছেন। উত্তরে বলা যায় অবশ্যই যোগাযোগ করছেন। কারণ একটি কবিতা হলো গভীর অর্থের অনুসন্ধান করা বোঝায় যে এতে কখনো একটি লুকানো বার্তা থাকতে পারে, আবার প্রকাশ্য বার্তাও থাকে। কিন্তু কবিতা কোডেড মেসেজিং নয়; এটা শৈল্পিক যোগাযোগ। 

গোপনে এর অর্থ কী তা জিজ্ঞাসা করার চেয়ে একটি কবিতা কী যোগাযোগ করে তা আহবান করা আরও কার্যকর। কিছু কবিতা সোজাসাপ্টা; কোন ব্যাখ্যা করা লাগে না কারণ সেগুলোতে কবি কী বলতে চাইছে সে সম্পর্কে তারা স্পষ্ট। অন্যদিকে কিছু কবিতা রহস্যে মোড়ানো এবং কিছু সম্পূর্ণরূপে অস্পষ্ট.বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং অর্থ অনুসন্ধান করে উন্মুক্ত করা হয়। কবিতার বিশ্লেষকদের জন্য লুকানো অর্থ অনুসন্ধান করা অস্বাভাবিক নয় এবং কখনও কখনও কবিতাগুলেতে প্রকৃতপক্ষে কোডেড বার্তা থাকে। কিন্তু একটি কবিতা মূল্যায়ন করার সময়, আমরা খুঁজতে গিয়ে অন্যান্য বার্তাও আছে।

যোগাযোগ বাস্তবতা নির্মাণ করে। বাস্তবতা ধরে রাখে এবং ধরে রাখার ক্ষেত্রে বিপত্তি ঘটলে তা মেরামতও করে। বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন লিখেন-- 

'আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে   
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।   
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,   
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।   
  
চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,   
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।   
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,   
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক'। 

ঠিক তখন আমাদের মনের সামনে ছোট নদীর ছবি ভেসে ওঠে, বৈশাখ মাস নদীর অবস্থা কেমন হয়। কাশবন, শালিক পাখির বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে।

আমাদের কবিতা গোপন অর্থ এবং লুকানো বার্তা দিয়ে না থাকলেও আমরা যোগাযোগের গভীর স্তরে পৌঁছানোর জন্য চিত্রকল্প এবং সংবেদন ব্যবহার করতে পারি। আমরা সবসময় জানতে পারি না কিভাবে আমাদের কবিতা পাঠকদের সাথে অনুরণিত হবে।

যোগাযোগ হল তথ্য বা ধারণার আদান-প্রদান। জটিল কথ্য ভাষা থেকে সহজ হাতের অঙ্গভঙ্গি পর্যন্ত আমাদের হাতে যোগাযোগের অনেক মাধ্যম রয়েছে। অফিস মেমো থেকে শৈল্পিক অভিব্যক্তি পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সেটিংসে ব্যবহৃত যোগাযোগের অন্যতম প্রধান পদ্ধতি হল লেখা। কবিতা হল শৈল্পিক যোগাযোগের একটি রূপ। কবিতাগুলি স্পষ্ট ধারণা প্রকাশের জন্য সহজ, সরল ভাষা ব্যবহার করতে পারে, অথবা এটি অস্পষ্ট, এমনকি অনিশ্চিত, ধারণাগুলিকে যোগাযোগ করতে জটিল, অস্বচ্ছ ভাষা ব্যবহার করতে পারে। আমি সম্প্রতি আমার চার বছর বয়সী ভাইপোর জন্য একটি গান বাজিয়েছি এবং তিনি আমাকে বলেছিলেন যে গানটি "তার মাথায় ছবি রাখে।" আমি নিশ্চিত নই যে চিত্রগুলি তাঁর কাছে গানের বা সঙ্গীত থেকে এসেছে কিনা, তবে অবিলম্বে স্বীকার করেছি যে এটি কর্মক্ষেত্রে শৈল্পিক অভিব্যক্তির শক্তি ছিল। 

আমাদের কবিতা গোপন অর্থ এবং লুকানো বার্তা দিয়ে না থাকলেও আমরা যোগাযোগের গভীর স্তরে পৌঁছানোর জন্য চিত্রকল্প এবং সংবেদন ব্যবহার করতে পারি। আমরা সবসময় জানতে পারি না কিভাবে আমাদের কবিতা পাঠকদের সাথে অনুরণিত হবে। কিছু ক্ষেত্রে, আমরা আমাদের চিত্রগুলিকে সুনির্দিষ্ট করে তুলতে চাই, কিন্তু প্রায়শই, আমরা এমন স্থান ছেড়ে দিতে চাই যা কবিরা পাঠকদের তাদের কল্পনা দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করতে দেয়। এটাই কবিতার এবং সব ধরনের শিল্পের জাদু। আর অনুপ্রাণিত করার হলো যোগাযোগের কাজ।

কবিতা কীভাবে যোগাযোগ করে সেটার কিছু দিক এখানে তুলে ধরছি: 
অভিজ্ঞতা: কিছু কবিতা অভিজ্ঞতা শেয়ার করে। একটি অভিজ্ঞতার বিষয়ে বিশদ বিবরণ দিতে পারে, এটির উপর যুক্তি প্রদান করতে পারে, এটির উপর একটি গুরুত্ব স্থাপন করতে পারে, বা অভিজ্ঞতাটি বর্ণনাকারীকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে তা প্রকাশ করতে পারে। তারা এমন কিছু দেখায় যা ঘটেছিল এবং এটি একটি শিশুর প্রথম পদক্ষেপ থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে পর্যন্ত যেকোনো কিছু হতে পারে। আমরা পাঠক কবিগুরুর কবিতা দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত। কবিতায় যে অভিজ্ঞতা বিবৃত তা নিজেদের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে নিই।

বর্ণনা: অন্যান্য কবিতা একটি চিত্র আঁকা বা একটি দৃশ্য নির্ধারণ করা. কিছু ক্ষেত্রে, কোন পদক্ষেপ নেই; কবিতায় কিছুই ঘটে না, শুধু তাই হয়। এই কবিতাগুলো আমাদেরকে কিছু দেখায়। বর্ণনামূলক কবিতা শব্দ দিয়ে চিত্র আঁকে।  যেমন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবেই আমাদের বাংলাদেশ ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে-

আমার সোনার বাংলা  
আমি তোমায়  ভালবাসি  
চিরদিন তোমার আকাশ  
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস আমার প্রাণে-  
ও মা, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি  
সোনার বাংলা  
আমি তোমায় ভালবাসি  
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে  
মরি হায়, হায় রে-  
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে  
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা খেতে কী দেখেছি  
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি  
সোনার বাংলা  
আমি তোমায় ভালবাসি    
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো!  
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে  
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো  
মরি হায়, হায় রে-  
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো  
মা তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন-  
ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি

ধারনা: কবিতাও কবির ভাবনা পাঠকের সাথে প্রকাশ করতে পারে। চিন্তার প্রকাশ ঘটায়। এইভাবে বার্তা বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা যোগাযোগ করি।  
ট্রিবিউটস: ট্রিবিউটারি কবিতাগুলি মানুষ থেকে প্রকৃতি পর্যন্ত যেকোন কিছুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে, যোগাযোগ করে যে শ্রদ্ধার বস্তুটি সম্মানিত, মূল্যবান এবং উদযাপন করা হচ্ছে। 

এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।  
 তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,  
 বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক ।।  
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,  
 অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।।  
 মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,  
 অগ্নি-স্নানে শুচি হোক ধরা।  
রসের আবেশরাশি   শুষ্ক করি দাও আসি,  
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।  
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।।

এভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতি, বৈশাখ আহবান জানিয়েছেন, শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। আমরা দর্শকশ্রোতা তার রচনা দিয়ে যোগাযোগ করছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা এভাবে যোগাযোগের নান্দনিক দিক এবং শৈল্পিক প্রকাশের জন্য একটি মূল্যবান হাতিয়ার, যুগে যুগে আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় যোগাযোগের উপাদান, উপকরণ, দৃষ্টিকোণ গবেষণা ও পঠন-পাঠনের বিষয়বস্ত হিসেবে পরিগণিত হবে।

Comments