বুয়েট শিক্ষার্থীদের মতো আমিও ছাত্ররাজনীতি চাই না, তবে...

ছাত্ররাজনীতির নামে যা চলছে, এর নাম যদি রাজনীতি হয়, তার বন্ধ আমিও চাই।

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আছে, তা বাতিল চেয়ে ছাত্রলীগ মিছিল-সমাবেশ করেছে। তারা বুয়েট কর্তৃপক্ষকে সময় বেঁধে দিয়ে বলেছে যে অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। তারা তাদের সমর্থকদের নিয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে মহড়াও দিয়েছেন। তাদের প্রধান অভিযোগ ছাত্ররাজনীতি বন্ধের এই সুযোগে সেখানে হিযবুত তাহরির, শিবির ও মৌলবাদী সংগঠনগুলো ধর্মীয় লেবাসের আড়ালে সংগঠনের কাজ করছে। তাহলে তারা কেন সংগঠন করতে পারবে না?

বুয়েটে কেন সংগঠন নিষিদ্ধ? আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যার বেদনাদায়ক ঘটনার মধ্যে দিয়ে সেই সময় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এ সময়ে এই হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের ২০ নেতাকর্মীর মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।

যিনি খুন হয়েছেন এবং যারা খুন করেছেন, তাদের প্রত্যেকের বাবা-মাই সন্তানকে প্রকৌশলী বানাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তারা খুনের মামলার দণ্ডিত আসামি। এই অধপতিত ছাত্ররাজনীতির কারণে ২৫ জন মেধাবী শিক্ষার্থীকে খুনের মামলার আসামি হতে হবে, সেটা কারো কাম্য ছিল না। এমনটা কেউ আশাও করেনি।

ছাত্ররাজনীতির নামে যা চলছে, এর নাম যদি রাজনীতি হয়, তার বন্ধ আমিও চাই। আমি তাদের ভাষা বুঝেছি। তাদের ক্ষোভ-ক্রোধ, চাওয়া বুঝেছি যে, কেন তারা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়েছে, কোন পরিস্থিতিতে তা চেয়েছে।

যে রাজনীতি তাদের পড়তে দেয় না, ঘুমাতে দেয় না, শান্তিতে থাকতে দেয় না, স্বাধীনভাবে চলাফেরা, মতপ্রকাশ করতে দেয় না, চাঁদাবাজি, হল দখল করে, হলে হলে টর্চার সেল তৈরি করে, ক্ষমতার লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করা সেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হোক, আমিও চাই! তাদের সঙ্গে আমি একমত। তারা আরও একটু বুঝলে, পরিপক্ব হলে আরও অনেক কিছুই নিষিদ্ধ করার কথা বলত। সেটা বলছে না!

কেন আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল? ভারতের সঙ্গে সরকারের পানি চুক্তির বিরোধিতা করে সে তার মত প্রকাশ করেছিল। কোথায় মত প্রকাশ করেছিল? ফেসবুকে। তাহলে তাকে মূলত হত্যা করা হয়েছে মতপ্রকাশের কারণে? তাই না? মত প্রকাশ কি নিষিদ্ধ করা হয়েছে? সংবিধানে কি মত প্রকাশ নিষিদ্ধ? খুন হলো মতপ্রকাশের কারণে, খুন করলো ছাত্রলীগ, আর নিষিদ্ধ করা হলো সব ছাত্রের রাজনীতি করার অধিকারকে, সেটা কি ঠিক?

আবরারকে হত্যা করেছে কারা? ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা! তাহলে এর জন্য দায়ী কে? ছাত্রলীগ। তাহলে শাস্তি হওয়া উচিত ছাত্রলীগের। তাদের কি শাস্তি হয়েছে? তাদের অপকর্ম কি বন্ধ হয়েছে? হয়নি। কিন্তু আপনারা শাস্তি দিতে চাইছেন কাদের? সব ছাত্র সংগঠনকে? সব ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি করার অধিকার কেড়ে নিতে চাইছেন কেন? একের দায় কি অন্যের ওপর চাপানো যায়? কেন আপনারা এক সংগঠনের দায় অন্য সংগঠনের ওপর দিচ্ছেন? এটা কোন যুক্তি ও ন্যায়ের কথা বলতে পারেন?

মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। রাজনীতি করতে কেউ বাধ্য নয়। কিন্তু কেউ যদি সংগঠন ও রাজনীতি করতে চায়, তাকে বাধা দেওয়া হবে কেন? আপনি তাকে বাধা দেওয়ার কে? যার ইচ্ছে রাজনীতি করবে, যার ইচ্ছে হয় করবে না। কিন্তু কারো আচরণ-অধিকার বেঁধে দেবেন কোন ক্ষমতায়? কেন অনির্দিষ্টকাল তা বন্ধ থাকবে? এই সিদ্ধান্ত কি সংবিধান ও মৌলিক মানবাধিকার বিরোধী নয়?

ছাত্রলীগের এরকম কর্মকাণ্ড কখন ছিল না? ডাকসুর ব্যালট বাক্স ছিনতাইসহ স্বাধীনতার আগে-পরের অনেক ঘটনাই আছে। ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক ধারা সবসময়ই ছিল। পরিস্থিতির পরিবর্তনে যুক্ত হয়েছে তার মাত্রাগত তারতম্য শুধু। পচন শুধু ছাত্র রাজনীতিতে নয়, পতন-পচন সমাজ-রাজনীতির সর্বত্রই হয়েছে। সেই সময় যদি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হতো, তাহলে কি স্বাধীনতা আসত? নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান হতো? ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন হতো? এসব না হলে আজকে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন, তারা কি তা করতে পারতেন?

ছাত্ররাজনীতির আদর্শিক ও নীতিনিষ্ঠ অবস্থান না থাকার কারণেই আবরার হত্যার ঘটনা ঘটছে। ছাত্ররাজনীতি নয়, এর দায় আদর্শিক ও নীতিনিষ্ঠ অবস্থান না থাকার। ক্ষমতাকেন্দ্রীক সেই অন্যায়-অনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। ছাত্রলীগ-ছাত্রদল-শিবির যে যখন ক্ষমতায়-অবস্থানে থাকে, তখন অন্যদের রাজনীতি করতে দেয়নি, দেয় না। আপনারও কি তাই করছেন না? পার্থক্য কোথায়? এটাও কি দখলদারিত্ব নয়?

বুয়েট শিক্ষার্থীদের এই ভাবনা ধর্মান্ধ সংগঠন ও জঙ্গীবাদের জন্ম দেবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নেই। কিন্তু সেখানে জঙ্গী তৈরি হচ্ছে কীভাবে? হলি আর্টিজানের হামলায় কারা অংশ নিয়েছিল? তারা কোথায় জঙ্গীবাদের প্রশিক্ষণ পেয়েছে, বলতে পারেন? সেটা কি ছাত্ররাজনীতির কারণে হয়েছে? মাদ্রাসায় ছাত্রী-শিশু ধর্ষণসহ ভয়াবহ ও নৃসংশ ঘটনা ঘটে। এজন্য কি মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করতে হবে?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি-শিক্ষক-প্রশাসকদের নিয়োগ দিচ্ছে কে? পত্রিকার নানা খবর নিশ্চয়ই দেখছেন। জাতীয় রাজনীতিতে যে পচন ধরেছে, তাকে কি বন্ধ করতে পারছেন? বুয়েট বাংলাদেশের বাইরের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ভোগ করবেন আর ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ চাইবেন, তা কী করে হয়? আপনার যে প্রতিবাদ করছেন, সেটাও ছাত্ররাজনীতিরই ফল।

শিক্ষকরা যে রাজনীতি করছেন, তারা নানা বর্ণে বিভক্ত, সেটা কি বন্ধ করতে পারছেন? এসব আবেগ ও বিরাজনীতিমূলক অবস্থান প্রত্যাহার করে সুস্থ ধারার রাজনীতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা বলুন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ফি বাড়িয়ে দিয়ে দরিদ্র-মেধাবীদের লেখা-পড়ার সুযোগ বন্ধ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে আলাপ-প্রতিবাদ করুন। ছাত্রলীগের কারণে যেমন শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, ছাত্রদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, সেই একই সমীকরণে তো জাতীয় রাজনীতিও নিষিদ্ধের কথা বলতে হয়। সেই দাবি কি করতে পারবেন?

বুয়েটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছেন, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না চাওয়া মানেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মতাদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়া নয়। আমরা শুধু চাই না, ক্ষমতার লোভ ও অপচর্চা আবারও এসে আমাদের শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে ফেলুক।

শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা সবাই গর্বের সঙ্গে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনার চর্চা আমাদের অন্তরে লালন করি। আমরা হিযবুত তাহরীরের সম্পূর্ণ বিপক্ষে এবং কারও শিবির-সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে তার বহিষ্কার চাই।

ছাত্ররাজনীতি না চাওয়া মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে যাওয়া নয়—ভালো কথা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শটা কি? মুক্তিযুদ্ধের চাওয়া ও দেশপ্রেম তাহলে কী? সেটা কি তাহলে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া? ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি না থাকলে কি মুক্তিযুদ্ধ হতো? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন। সেই আকাঙ্ক্ষার একটি প্রধান বিষয় মতপ্রকাশ ও সংগঠন করার অধিকার। তাকে অস্বীকার করে কি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হয়? দেশপ্রেম ও রাজনীতির বিরোধ কোথায় বলতে পারেন?

তাদের আরেকটি বিষয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। আমি শিবিরের রাজনীতি কোনোভাবেই সমর্থন করি না। কিন্তু তাদের সংগঠন-রাজনীতি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয়। তাহলে তাদের কোনো সদস্য যদি এই আন্দোলনে যুক্ত থাকে, তাকে কেন বহিষ্কার করা হবে? সেটা কোন যুক্তিতে? শিবির করলে কি তারা কোনো দাবি করতে পারবে না? কোনো আন্দোলনে অংশ নিতে পারবে না? এই বক্তব্য আসলে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার মতোই ফ্যাসিবাদী ও বিপদজনক ভাবনা। আমি তাই কোনোটাকেই সমর্থন করি না।

ঘোষণা ছাড়াও সংগঠন করা যায়। মিছিল-মিটিং না করা মানেই রাজনীতি না করা নয়। হয়তো সেখানে পেশিশক্তির মহড়া থাকে না। কিন্তু রাজনীতি হয় এবং হচ্ছে। মৌলবাদী সংগঠনগুলো মানুষের ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে সংগঠন গড়ে তুলছে। সেক্ষেত্রে বলা যায় তাদের রাজনীতি বন্ধ নেই। কখনো ছিলও না। তারা যদি সে কাজ করতে পারে, তাহলে অন্যান্য সংগঠন কেন তা করতে পারবে না? কোনো সংগঠন যদি সন্ত্রাস, সমাজ ও দেশ বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তা যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য হুমকি হয়, তাকে নিষিদ্ধ করাসহ নানা ধরনের শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাদের কারণে অন্যদেরও অভিন্ন দণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়।

বুয়েটে ছাত্র বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'আমি রাজনীতি করি, সেজন্য বুয়েটে আমি যেতে পারব না? এটা কোন ধরনের আইন?' তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করি। কিন্তু একই দাবি যদি বিএনপি পক্ষ থেকে করা হয়, তখন ওবায়দুল কাদের কি তাদের সেই কথা মেনে নেবেন? বা তিনি মানলেও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ কি সেটা মানবে? রাজনীতির এই স্ববিরোধী অবস্থান ও চরিত্র আগে ঠিক করুন, তারপর এমন নীতিকথা বলুন।

সবশেষে যে কথা বলতে চাই, কোনো সংগঠন ও তার সদস্যদের আচরণ, কর্মকাণ্ড যদি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরোধী হয়, সেজন্য প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নীতিমালা ও আচরণবিধি প্রণয়ন করুন। শিক্ষার পরিবেশ পরিষদ গঠন করুন। সব সংগঠনের সমন্বয়ে নিয়মিত বৈঠকের ব্যবস্থা করুন। সেখানে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হোক। কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিন। এই বিষয়ে কঠোর হোন, কিন্তু ছাত্ররাজনীতি ও মতপ্রকাশের অধিকার বন্ধের সিদ্ধান্ত পরিহার করুন।

ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Comments