ডিপ্লোমাকে বিএসসির সমমান করা: তেলা মাথায় তেল

আসলে কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কাউকে শিক্ষার সনদ বা সম্মান দেওয়া যায় না। তাই গুরুত্বপূর্ণ দুই পেশাজীবী গোষ্ঠীর মধ্যে এমন বিরোধের বীজ নতুনভাবে রোপন না করি, যা ডালপালা ছড়াতেই থাকবে।

মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নিয়োগ দিতে চায় সরকার। সেই লক্ষ্যে ডিপ্লোমাধারীদের ন্যূনতম দুই বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকলে বিএসসি সমমান ডিগ্রি দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এই লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপনও দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আগে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের এক অনুষ্ঠানে গত ২ এপ্রিল শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এ বিষয়ে যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তার প্রতিফলন এই প্রজ্ঞাপন।

শিক্ষামন্ত্রী চেয়েছেন, সুতরাং এটা হয়ে যাবে—এমনটি ধারণা করা যায়। এত বড় একটি উদ্যোগ নেওয়ার আগে বিদেশে পড়াশোনা করা শিক্ষামন্ত্রী এ দেশের শিক্ষা নিয়ে কাজ করা লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা বা আলোচনা করেছেন—এমনটি শুনিনি। এ নিয়ে কারও কোনো দাবি, আন্দোলন বা যুক্তি কানে আসেনি।

বিষয়টি সহজভাবে দেখলে মন্ত্রী ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের একটি অনুষ্ঠানে গেলেন, তাদের দাবির কথা শুনলেন এবং ঘোষণা দিলেন দাবি পূরণ করার। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এর চেয়ে বেশি ভেবে দেখার সুযোগ নেই।  
তবে সরকারি পর্যায়ে কোনো আলোচনা হতে পারে অথবা সরকারের শীর্ষপর্যায়ের মতামত হয়তো মন্ত্রী নিয়েছেন। এটি আমজনতার জানার কথা নয়।

বিষয়টি যে প্রক্রিয়ায় জনসমক্ষে আসুক, এটা এখন সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। জাতীয় শিক্ষানীতি নামে যে ‌‌‌‌‌কাগুজে নীতি আছে, সেখানেও এমন কোনো সুপারিশ বা পরামর্শ পাইনি। কোনো শিক্ষাবিদের লেখা বা বক্তব্যে এমন পরামর্শ বা প্রস্তাবের কথা শুনিনি। অনেকটা আকস্মিকভাবে বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষকদের চাহিদা মেটানোর কথা বলে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের এই বাড়তি সুবিধা দেওয়া বা তেলা মাথায় তেল দেওয়ার উদ্যোগে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসে।
 
একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী যিনি দুই বছর চাকরি করছেন, তাকে বিএসসি সমমান ডিগ্রি দিতে হবে কেন? তিনি তো চাকরি করছেন বা করতে পারবেন। যিনি চাকরি করছেন, তাকে ছুটিয়ে এনে শিক্ষক বানানোর এই উদ্যোগ কেন?

আর লাখো বেকারের মধ্যে স্কুলে পড়ানোর মতো শিক্ষক পাওয়া যায় না—এটা যদি সত্য হয়, তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা কোথায় গেছে ভেবে দেখুন। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্য মতে, বাংলাদেশে ১০০ জন স্নাতকধারীর ৪৭ জনই বেকার। আর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক তথ্য হচ্ছে, দেশে মোট বেকারের ১২ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত।

রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি হিসেবে সংখ্যার মারপ্যাঁচে বলা যেতে পারে, শিক্ষার হার বেড়েছে, মান বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। সেই নব্বইয়ের দশক থেকে যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন থেকেই শুনছি এ কথা, শিক্ষার মান বাড়ানোর তুমুল প্রচেষ্টা চলছে। এ কথা যতই শুনছি, ততই যেন নামছে শিক্ষার মান!

এতদিনে তা এতটাই নেমেছে যে, এখন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের গ্রেস দিয়ে বিএসসি সমমান করে তাদের দিয়েই গণিত ও বিজ্ঞান পড়াতে হবে। আর বিএসসি, এমএসসি পাস করা লাখো ছেলেমেয়ে বেকারত্বের যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। তারা যদি স্কুলের গণিত বা বিজ্ঞান পড়াতে না পারে, তাহলে ১৫ বা ১৬ বছরে তাদের কী শেখানো হলো? এর জবাব কে দেবে?

আমি কোনোভাবেই ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের লেখাপড়া, যোগ্যতা বা দক্ষতাকে খাটো করে দেখতে চাই না। বরং যারা ডিপ্লোমা পড়েছেন-পড়ছেন, তাদের সাধুবাদ জানাই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি, ভোকেশনাল ও ডিপ্লোমা শিক্ষার খুবই প্রয়োজন। যারা কারিগরি শিক্ষায় অংশ নেন, তাদের বেকারত্ব সাধারণ শিক্ষার চেয়ে অনেক কম। এ জন্য জোর করে উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার চেয়ে ছেলেদের ডিপ্লোমা ও মেয়েদের নার্সিং পড়ার পক্ষে আমার অবস্থান।
চাকরির বাজারের এই খারাপ সময়েও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কেউ হাত গুটিয়ে বসে থাকেন, এমন দেখা যায় না। বিদেশেও চাকরির সুযোগ তারাই বেশি পেয়ে থাকেন। শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তি বিবেচনায় তাদের কদর বেশি।  তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটাল বাংলাদেশ, ইলেকট্রনিক খাত, নির্মাণ খাতসহ সর্বত্রই তাদের কাজের ক্ষেত্র।

বিশেষায়িত শিক্ষার সুফল কাজে লাগিয়ে দেশে-বিদেশে যখন তারা এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন তাদের জন্য এই সহানুভূতি কতটা প্রয়োজন, তা ভেবে পাই না। বিপুল সংখ্যক ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পেশা বা সামাজিক মর্যাদার কারণে বিএসসি বা এমএসসি পাস করেছেন বা করছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকায় তাদের এই ডিগ্রি অর্জন করা কিছুটা সহজ হয়েছে। তাই তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের সবাই সরকারের এই বিশেষ সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি গ্রহণ করবেন বা সমর্থন করবেন—এটা আমার মনে হয় না।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান কাঠামোয় ধাক্কা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধগম্য নয়। এমন একটি আঘাতের কথা এ দেশের মানুষ অনেকদিন মনে রাখবে। পঞ্চম শ্রেণি শেষে পিএসসি বা সমমান এবং অষ্টম শ্রেণি শেষে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমান পরীক্ষার নামে এক যুগের বেশি সময় ধরে যা ঘটল, তা সহজে ভুলবে না এ দেশের শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা অভিভাবকেরা। ব্যক্তিবিশেষের পছন্দ-অপছন্দের কারণে মূলত এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়, আবার বাতিলও করা হয়।

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু সমমানের নজির আছে; যেমন: এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা সমমান ধরা হয়। ইংরেজি মাধ্যমের 'ও' লেভেল এবং 'এ' লেভেলের সমমান কোনো কোনো শিক্ষার্থীর প্রয়োজন হয় মেডিকেল বা উচ্চশিক্ষায় পড়ার জন্য। কিন্তু ডিপ্লোমাকে বিএসসি ডিগ্রি সমমান দেওয়ার বিষয়টি একেবারেই নতুন, অনেকটা বিস্ময়করও বটে!

শিক্ষায় একসময় পাসের হার বাড়াতে গ্রেস নম্বর দেওয়া হতো, যা তুলে দেওয়া হয়েছে। এক সময় ৩০ পেলে ৩৩ দেওয়া হতো, সেটিও এখন নেই। ৭৯ পেলে ৮০ নম্বর দেওয়ার রেওয়াজ ছিল, যাতে ওই বিষয়ে লেটার নম্বর বলা যায়। এটাও উঠে গেছে। এসএসসি, এইচএসসি বা ডিগ্রিতে এক বিষয়ে ফেল করলে বা কাঙ্ক্ষিত নম্বর না পেলে পরের ব্যাচের সঙ্গে ওই বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করা বা ভালো নম্বর পাওয়ার নিয়মও তুলে দেওয়া হয়েছে।  
এভাবে একে একে শিক্ষায় উটকো ঝামেলা কমিয়ে ফেলা হয়েছে।

ডিপ্লোমাদের বিএসসি সমমান দিতে গিয়ে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, কারিগরি শিক্ষাবোর্ড ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাড়তি কাজে জড়াতে হবে। এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হিমশিম খায়। তার ওপর একটি বাড়তি কাজ চাপিয়ে দেওয়া হবে।

ডিপ্লোমাধারীদের বিএসসি সমমান করতে গেলে অনেকগুলো ঝামেলা সামনে চলে আসবে, যার একটি সমাধান করতে গেলে আরেকটি সামনে চলে আসবে। শিক্ষাজীবনে তৃতীয় বিভাগ থাকলে কেউ শিক্ষক হতে পারে না।  
ডিপ্লোমাধারীদের এমন ফল যাদের রয়েছে, তারা দুই বছর চাকরির অভিজ্ঞতা দিয়ে শিক্ষক হতে পারবে?

বেসরকারি মাধ্যমিকে শিক্ষক নেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যায়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে। ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নিশ্চয়ই এনটিআরসিএ পরীক্ষা দিতে হবে না। সেখানে বৈষম্যের প্রশ্ন আসবে। কারণ এনটিআরসিএ পরীক্ষা অনেকটাই প্রতিযোগিতামূলক, যেটি সাধারণ শিক্ষার ছেলেমেয়েরা পাস করে আসবে।

দেশে লাখো শিক্ষিত ছেলেমেয়ে বেকার। তাদের কথা না ভেবে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কথা কেন ভাবতে হবে, যারা চাকরির বাজারে এমনিতেই তুলনামূলক ভালো আছেন?

গত ২ মার্চ শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এক অনুষ্ঠানে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসি (পাস) মর্যাদা দেওয়ার পক্ষে মত দিয়ে বলেন, 'আমরা মনে করছি, ৬০ হাজারের মতো গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সেখানে আমাদের ডিপ্লোমা পাস করা ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োজিত করতে পারলে শিক্ষক সংকট সমাধান করা সম্ভব হবে।'

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সদের স্নাতক মর্যাদা দেওয়ার প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, 'একজন এসএসসি পাস শিক্ষার্থীর বিএসসি (পাস কোর্স) পাস করতে সময় লাগে পাঁচ বছর। অন্যদিকে ডিপ্লোমা পাস করতে সময় লাগে চার বছর। সেক্ষেত্রে ডিপ্লোমা পাস করা একজন শিক্ষার্থী এক বছর কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে তাকে বিএসসি (পাস) সমমানের মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে।'

একটি সরল প্রশ্ন রাখতে চাই মন্ত্রীর কাছে। ডিপ্লোমা পাস করে দুই বছর চাকরি করলে যদি বিএসসি ডিগ্রি পাওয়া যায়, তাহলে বিএসসি পাস করা কেউ যদি এক বা দুই বছর চাকরি করে তাহলে তাকে এমএসসি ডিগ্রি দেওয়া যাবে না কেন? আবার কেউ যদি এমএসসি ডিগ্রি নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই-তিন বছর পড়ায়, তাহলে তাকে এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রি দিলে ক্ষতি কী?

এই সিদ্ধান্তের ফলে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী এবং বিএসসি প্রকৌশলীদের মধ্যে বিরোধ, দূরত্ব ও রেষারেষি বাড়বে ছাড়া কমবে না। ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা সাধুবাদ জানালেও ইতোমধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন বিএসসি প্রকৌশলীরা। জাতীয়করণকৃত শিক্ষক ও বিসিএস শিক্ষকদের মনস্তাত্বিক বিরোধের কথা আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। ডিপ্লোমা পাস করে ফিজিওথেরাপিস্টরা ডাক্তার উপাধি ব্যবহার করতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্নের সুরাহা হয়নি যুগ যুগ ধরে। আবার নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে এক ধরনের যুক্তিতর্ক শুরু হবে, যা চলতেই থাকবে। বিচ্ছিন্ন একটি উদ্যোগ সংকট বা জটিলতা বাড়াবে ছাড়া এতটুকু কমাবে না।

আসলে কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কাউকে শিক্ষার সনদ বা সম্মান দেওয়া যায় না। তাই গুরুত্বপূর্ণ দুই পেশাজীবী গোষ্ঠীর মধ্যে এমন বিরোধের বীজ নতুনভাবে রোপন না করি, যা ডালপালা ছড়াতেই থাকবে।

শরিফুজ্জামান পিন্টু: সাংবাদিক

[email protected]

Comments