বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস

গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ কী অর্জন করেছে?

একটি মুক্ত গণমাধ্যম যেভাবে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারে, সেটা কোনো সরকারি সংস্থা বা দলীয় নেটওয়ার্ক দিতে পারে না। কেউ-ই ক্ষমতাসীনদের কাছে খারাপ সংবাদগুলো পৌঁছে দিতে চায় না। সেখানে ভয় ও ব্যক্তিস্বার্থ কাজ করে।
ভিজ্যুয়াল: শেখ সুলতানা জাহান বাঁধন

এক সময় মুক্ত গণমাধ্যম ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহির আওতায় আনতো। কিন্তু এখন ক্ষমতাসীনরাই উল্টো গণমাধ্যমকে 'জবাবদিহি'র আওতায় আনছেন। তবে নিশ্চিতভাবেই সেটা সত্য প্রকাশের জন্য নয়, বরং বড় আকারে বৈষম্য ও দরিদ্রদের কাছ থেকে লুণ্ঠনকে ন্যায্যতা দিতে।

বাংলাদেশে 'বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস' পালন করার সময় আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, দেশে মুক্ত গণমাধ্যমের কার্যকারিতাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধাগ্রস্ত করছে এমন নয়টি আইন এই মুহূর্তে কার্যকর রয়েছে এবং আরও চারটি আইন পাস করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে।

মজার বিষয় হলো, মুক্ত গণমাধ্যমের কার্যকারিতাকে খর্ব করার জন্য যতগুলো আইন রয়েছে, তার তুলনায় গুরুতর ও সমাজের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বিঘ্নিত করতে পারে এমন অপরাধ, যেমন: হত্যা, মৃত্যু, হামলা, ধর্ষণ, অপহরণ, শিশু নির্যাতন বা বাল্যবিয়ে ঠেকানোর আইনের সংখ্যা বেশ নগণ্য।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সড়ক পরিবহন আইন একইসঙ্গে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পাস হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আনুষ্ঠানিকভাবে সাইবার অপরাধ দমনের জন্য চালু করা হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই শতাধিক সাংবাদিক, শিল্পী, কার্টুনিস্ট, শিক্ষক ও লেখককে এর আওতায় কারাবন্দি করা হয়। অপরদিকে আমাদের সড়কগুলোতে হাজারো মানুষের মৃত্যু সত্ত্বেও সড়ক পরিবহন আইনের পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর বাস্তবায়ন এখনো দেখিনি।

২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংস্কারের কথা বলা হলেও আজ পর্যন্ত তা করা হয়নি। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৮২৭ কোটি মার্কিন ডলার পাচার হচ্ছে। সাম্প্রতিক তীব্র ডলার সংকটের মধ্যেও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

দেশের জরুরি ক্ষেত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নে হেলাফেলা এবং গণমাধ্যমের জন্য প্রযোজ্য আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দ্রুতগতি দেখলেই বোঝা যায় যে আমাদের প্রাধান্যটা ঠিক কোথায়। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে সমাজের জন্য বড় বিপদের উৎস কোনটি, সেটাও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

এ ছাড়া, সাংবাদিকদের সমাজের সেবা করার সুযোগকে সীমিত করতে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন প্রশাসনিক ডিক্রি দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ নির্দেশনাই এর উত্তম উদাহরণ হতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনানুষ্ঠানিকভাবে একটি ধারার প্রচলন করেছে, যার ফলে সাংবাদিকরা আর বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে প্রবেশ করে জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থে প্রতিবেদন তৈরির জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে পারছেন না। সাংবাদিকরা শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্রের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন এবং এর জন্যও আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে।

কেন এই ধারার প্রচলন করা হলো? এটা কীভাবে জনগণের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করবে? সাংবাদিকরা কি কোনোভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করেছেন? আমাদের প্রতিবেদনগুলো কি দেশের অর্থনীতিকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে?

আমরা সাংবাদিকদের কাজ, ব্যবহার, আদব-কায়দা বা নৈতিকতা নিয়ে গভর্নরের অভিযোগ শুনতে আগ্রহী। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাই, যাতে পেশাদার সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত না করে এসব সমস্যার সমাধান করা যায়।

যেহেতু এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি, আপাতদৃষ্টিতে আমরা সাংবাদিকদের ওপর আরোপিত এই বিধিনিষেধকে অগণতান্ত্রিক, মুক্ত গণমাধ্যম পরিপন্থী ও জনস্বার্থবিরোধী হিসেবেই বিবেচনা করছি।

এই বিধিনিষেধের ফলে দুর্নীতি ও প্রতারণা ধামাচাপা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে, অবৈধভাবে এক বা একাধিক ব্যাংকের মালিকানা দখলের বিষয়ে মানুষকে অন্ধকারে রাখা হতে পারে, বড় ধরনের অনিয়মের তথ্য প্রকাশের সুযোগ বন্ধ হতে পারে এবং সার্বিকভাবে, জবাবদিহির বাইরে রেখে ব্যাংকিং খাতকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

তারপর প্রশ্ন জাগে, আদৌ কি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের এই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সংস্থার বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রতিবেদন প্রকাশে গণমাধ্যমকে বাধা দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে? জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সামরিক সংস্থা ছাড়া অন্য কোনো সংস্থাকেই উন্মুক্ত নিরীক্ষার বাইরে রাখা উচিত নয়।

কয়েকটি উদাহরণ বিবেচনায় নেওয়া যাক:

১. সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি

২. বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি

৩. বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি (যা জনতা, প্রাইম ও যমুনাসহ সাতটি ব্যাংককে প্রভাবিত করেছে)

৪. জনতা ব্যাংকে অ্যাননটেক্স ঋণ কেলেঙ্কারি

৫. জনতা ব্যাংকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি

৬. চারটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিকপ্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) থেকে পিকে হালদারের ১০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া

৭. ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি

৮. এনআরবিসি ঋণ কেলেঙ্কারি

৯. স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি

ওপরের প্রতিটি ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করেছে, কিন্তু সেগুলোর কোনো তদন্ত প্রতিবেদন জনগণের সামনে আনা হয়নি। আমরা জানি না, কোনো সমঝোতার কারণে কিংবা স্বভাবগুণে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ডেস্কে সেই তদন্ত প্রতিবেদনগুলোর ওপর ধুলো জমছে কি না।

এসব অবিশ্বাস্য কেলেঙ্কারির কাহিনী জনগণ কেবলমাত্র তখনই জানতে পারে, যখন কিছু বিবেকবান কর্মকর্তা দেশপ্রেম ও জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় গণমাধ্যমের হাতে এসব প্রতিবেদন তুলে দেন।

বর্তমানে যে ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে সেগুলো যদি আগেও থাকতো, তাহলে এসব কেলেঙ্কারির খবর জনসাধারণ মোটেই জানতে পারতো না। তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক কাদের স্বার্থে এসব বিধিনিষেধ আরোপ করছে?

বাংলাদেশের কিছু ব্যাংকে মালিকানা সংক্রান্ত নিয়ম লঙ্ঘন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজ মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নেওয়া এবং ব্যাংকিং আইন লঙ্ঘন করে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে একে অপরের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা চালু রয়েছে। গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত এসব ঘটনায় প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিচ্ছে।

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সৎ ও নিয়ম অনুযায়ী সব কর পরিশোধকারী যেকোনো ব্যবসায়ীর কাছে জানতে চাইলে তারা আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগের কথাই জানাবেন।

শুধু খেলাপি ঋণের (নন-পারফর্মিং লোন-এনপিএল) উদাহরণ থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকবছর ধরে খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে না ধরায় বর্তমানে তা পর্বতসম উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন ভূমিকার কারণে নিয়মিত ব্যাংক ঋণ পরিশোধকারীরা কার্যত হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছেন।

দেশের নির্বাহী শাখার কার্যক্রমের ওপর নজর রাখার দায়িত্ব সংসদের, বিশেষত অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের বিষয়গুলোতে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয় না। ফলে, কেবলমাত্র গণমাধ্যমেই খেলাপি ঋণের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয় এবং একইসঙ্গে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর লোভ ও ক্ষতিকর ভূমিকার সামনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতজানু হয়ে থাকার নিন্দা করা হয়।

গত বেশ কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যমের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে বাংলাদেশ কি কোনো দিক দিয়ে কিছু অর্জন করতে পেরেছে? ওপরের উদাহরণগুলোতেই এ প্রশ্নে আমাদের উত্তর সুন্দর করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ প্রশ্নের আরও বিস্তারিত জবাব পাওয়া যায় ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতা না থাকা, আমলাতন্ত্রে স্বচ্ছতার অনুপস্থিতি, পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা এবং জনগণের হাতে কোনো ধরনের ক্ষমতা না থাকার বিষয়টি দেখলে। সার্বিকভাবে গণমাধ্যমকে সংকুচিত করায় বড় আকারে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে দেশ, দেশের মানুষ।

গণমাধ্যমে সময়োপযোগী প্রতিবেদনের মাধ্যমে এসব কর্মকাণ্ড প্রকাশের সুযোগ থাকলে এই মাত্রায় দুর্নীতির বিকাশ ঘটত না। সরকার যদি প্রতিরোধমূলক না করে বরং সাংবাদিকতাকে উৎসাহ দেওয়ার আইন করত, তাহলে দুর্নীতির সার্বিক চিত্রে আমূল পরিবর্তন দেখা যেতো। একই পরিবর্তন আসতো ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, চাটুকারিতা, কর ফাঁকি, ঋণখেলাপিসহ সব ধরনের অন্যায়ের ক্ষেত্রেও।

আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা দেওয়ার ফলে গণমাধ্যম দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে—এমন উদাহরণের অভাব নেই। অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, উন্নয়নের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হচ্ছে স্বাধীনতা।

তার পরিবর্তে এক ধরনের শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, যেখানে সরকার ও মুক্ত গণমাধ্যম পরস্পর বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের অত্যাবশ্যক উপকরণ হচ্ছে মুক্ত গণমাধ্যম। এটা না থাকলে উন্নয়ন থমকে যাবে। জবাবদিহির সংস্কৃতি চালুর জন্য মুক্ত গণমাধ্যমের বিকল্প নেই।

একটি মুক্ত গণমাধ্যম যেভাবে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারে, সেটা কোনো সরকারি সংস্থা বা দলীয় নেটওয়ার্ক দিতে পারে না। কেউ-ই ক্ষমতাসীনদের কাছে খারাপ সংবাদগুলো পৌঁছে দিতে চায় না। সেখানে ভয় ও ব্যক্তিস্বার্থ কাজ করে।

উন্নয়নের পরবর্তী ধাপের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো একটি নির্ভরযোগ্য জবাবদিহির অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর সবচেয়ে সুনিশ্চিত উপায় হলো মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments