দুজন আম্পায়ারের অভিষেক এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটের অব্যক্ত সত্য

বিসিবির কর্মকর্তারা যদি এই পথে চেষ্টা করেন, জেসি ও অন্য আম্পায়ারদের প্রস্তুত করেন বড় দায়িত্বের জন্য, ডিপিএল ম্যাচে দায়িত্ব দেন। তাহলে এই উদ্যোগ তো প্রশংসা করা উচিত।
Shathira Jakir Jessy
সাথিরা জাকির জেসি। ছবি: ফিরোজ আহমেদ

গত পাঁচ দিনে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে বাংলাদেশের দুজন আম্পায়ারের লিস্ট-এ ম্যাচে মাঠের আম্পায়ার হিসেবে অভিষেক হয়েছে। তবে তাদের অভ্যর্থনা ছিলো একদম ভিন্ন।

এরমধ্যে একজন হচ্ছেন আইসিসির ডেভোলাপমেন্ট প্যানেলের আম্পায়ার, যিনি এরমধ্যেই আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন, খেলেছেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। অন্যজন এখনো আইসিসির প্যানেলের স্বীকৃতি পাননি, মূলত বয়সভিত্তিক পর্যায়েই তিনি আম্পায়ারিং করেন।

প্রথমজন, যার এসিসির ইভেন্টে আম্পায়ারিং করার অভিজ্ঞতা আছে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন ডিপিএলের সুপার লিগের ম্যাচে আম্পায়ারিং করার। যে ম্যাচে লড়েছিল দেশের ক্রিকেটের বড় দুই ক্লাব মোহামেডান ও প্রাইম ব্যাংক। বড় দলের খেলা হলেও শিরোপা দৌড়ে ম্যাচটির গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। কারণ এই দুই দলই পয়েন্ট টেবিলে শীর্ষে আবাহনী লিমিটেড থেকে বেশ পিছিয়ে।

অন্য আম্পায়ার, যিনি কিনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে এখনো পরীক্ষিত নন। তাকে দেওয়া হয়েছিলো রেলিগেশন লিগের শেষ ম্যাচের দায়িত্ব। যে ম্যাচের জয়ী দল টিকে থাকবে প্রিমিয়ার লিগে, পরাজিত দল নেমে যাবে প্রথম বিভাগে।

কিন্তু সোমবারের রেলিগেশন লিগের ম্যাচে গাজী টায়ার্স ক্রিকেট একাডেমি ও রূপগঞ্জ টাইগার্স ক্রিকেট ক্লাব অভিষিক্ত আম্পায়ারের বেলায় কোন উদ্বেগ জানায়নি, প্রশ্ন তুলেনি। কিন্তু অন্য আম্পায়ারের বেলায় মোহামেডান ও প্রাইম ব্যাংক দুই ক্লাবই তুলেছিলো প্রশ্ন, জানিয়েছিল নিজেদের উদ্বেগ, অনীহা।

তাদের এই অখুশি মনোভাবের কথা জানা যায় খেলার পরদিন শুক্রবার। যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)'র আম্পায়ার্স কমিটির প্রধান ইফতেখার আহমেদ মিঠু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিসিবি নারী আম্পায়ারকে দায়িত্ব দেওয়ায় তারা অখুশি ছিলো। কিন্তু ম্যাচ চলেছে। তারা মন্তব্য করে নিজেদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তারা আমার কাছে কোন অভিযোগ করেনি, সিসিডিএমকে করেছে। তবে এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও একজন নারী। আমাদের এই ধরনের নিয়োগকে উৎসাহ দেওয়া উচিত।'

দুই ক্লাবের কর্মকর্তারা যদিও জানান তারা সিসিডিএমকে কোন অভিযোগ করেননি। তাদের মূল অভিযোগ ছিলো আম্পায়ারের অনভিজ্ঞতা।  মোহামেডানের ক্রিকেট সমন্বয় তরিকুল ইসলাম টিটু দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, মৌখিকভাবে নিজেদের অখুশি মনোভাব প্রকাশ করেন তারা, 'আমরা আসলে আপত্তি তুলিনি। আমরা এমনিতে বলাবলি করছিলাম যে ম্যাচের মেরিট অনুযায়ী তো এত বড় ম্যাচে জেসি আম্পায়ার হতে পারে না। আমরা বলছিলাম এত বড় ম্যাচে আরও ভালো আম্পায়ার দরকার ছিলো। আমরা অফিসিয়ালি অভিযোগ করিনি, অফিসিয়ালি অভিযোগ করব কেন। আমরা ওরকমভাবে রিপোর্ট টিপোর্ট করিনি।'

এমনকি আবাহনীর কোচ, বিসিবির পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজনও সোমবার মিরপুরে বলেছেন 'বড় ম্যাচে' অভিজ্ঞ আম্পায়ারদের নিয়োগ দেওয়া উচিত, 'বড় ম্যাচে অভিজ্ঞ আম্পায়ার, যাদের সবাই রেসপেক্ট করে তাদেরই দায়িত্ব দেওয়া উচিত। জেসির জন্য ব্যাপারটা তাড়াতাড়িই হয়ে গেছে।'

কিন্তু অন্য ক্লাব কর্মকর্তা বা সুজন বিকেএসপিতে রেলিগেশন লিগের ম্যাচে নতুন আম্পায়ার দেওয়া নিয়ে কিছুই বলেননি। ওটা কোন নজরেই আসেনি কারো। যেখানে প্রথম আম্পায়ারের বেলায় হয়ে গেছে তুলকালাম।

একই রকম ঘটনার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিক্রিয়া কেন, প্রশ্ন করতে পারেন। উত্তরটা নিশ্চিতভাবেই হবে বেদনাদায়ক এবং অব্যক্ত। এর কারণ একজন হচ্ছেন পুরুষ আরেকজন নারী।

Shathira Jakir Jessy
ছবি: ফিরোজ আহমেদ

'কেন অভিযোগ করব যেখানে আম্পায়ার বদল হবে না'

বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাবেক তারকা সাথিরা জাকির জেসি পেশাদার আম্পায়ারিং ক্যারিয়ার শুরু করেছেন দুই বছর হলো। মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংক ম্যাচে দায়িত্ব পালন করে তুমুল বিতর্কের চলে আসেন। সাম্প্রতিক আবহাওয়ার মতই উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায়।

অন্য আম্পায়ারের নাম জাহেদুর রহমান শামীম, যার অভিষেক একদম শিরোনামে আসেনি। জেসির প্রথম ম্যাচ বাড়তি গুরুত্ব পায় কারণ এর আগে ডিপিএলে কোন নারী আম্পায়ারিং করেননি। এবং তিনি যখন আম্পায়ার হিসেবে মাঠে প্রবেশ করেন, তাকে দেখে অবাক হয়ে যান ক্লাব কর্তারা। এমন দৃশ্য তারা আগে কখনই দেখেননি।

প্রাইম ব্যাংক ম্যানেজার শিকদার আবুল হাশেম কঙ্কণ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন,  'মহিলা আম্পায়ার দেবে এটা তো জানি না আমরা। বাংলাদেশে মহিলা আম্পায়ারের অভিজ্ঞতা কেমন এটা তো আমরা সবাই জানি। আপত্তি করি না। যেহেতু এটা বড় ম্যাচ, এখানে নিয়মিত যারা করে তাদের আশা করছিলাম। মহিলা আম্পায়ার দেখেন যেটা এলবিডব্লিউ সেটা দেয় নাই, যেটা হয় নাই সেটা দিছে।'

শিকদারের পরের মন্তব্যে পরিষ্কার যে আম্পায়ার বদলানোর আর সময় না থাকাতেই তারা লিখিত অভিযোগ করেননি, 'আমরা ম্যাচ শুরুর আগেও কিছু বলিনি। এমনিতে নিজেরা আলাপ করেছি। সিসিডিএমের কাউকে বলিনি। নিজেরাই আলাপ করেছি। জানিয়ে কি হবে, তাৎক্ষণিকভাবে বদল করার তো কোন সুযোগ ছিলো না।'

kim kotton
প্রথম নারী হিসেবে ছেলেদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেন কিম কটন। ছবি: সংগ্রহ

সময় বদলাচ্ছে

ছেলেদের খেলায় নারী অফিসিয়াল এখন আর নতুন কিছু নয়। জেসির ইস্যু তৈরির ঠিক আগে রোববার ইতালিয়ান লিগ সিসি আ'তে সম্পূর্ণ নারী রেফারিদের দিয়ে ম্যাচ পরিচালনা করা হয়েছে। যে লিগটি কিনা প্রায়ই ভক্তদের দ্বারা খেলোয়াড়দের বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হওয়ার কারণে আলোচনায় আসে।

ফুটবলে বাংলাদেশের নারী রেফারিরা নারী লিগ পরিচালনা করেন। এএফসির এলিট প্যানেলে আছেন সালমা আক্তার। যিনি ২০২১ সালে দেশের সবচেয়ে বড় ফুটবল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে সহকারি রেফারির দায়িত্ব সামলেছেন।

গত বছর এপ্রিল মাসে নিউজিল্যান্ডের কিম কটন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ডানেডিনে কিউইদের ম্যাচে প্রথম নারী আম্পায়ার হিসেবে ছেলেদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। পরে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ডের ম্যাচেও আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।

অস্ট্রেলিয়া তাদের প্রথম শ্রেণীর আসর শেফিল্ড শিল্ডে নারী আম্পায়ারদের দায়িত্ব দেওয়া শুরু করেছে। গত বছর থেকে নারী আম্পায়ারদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্ব দেওয়া শুরু করেছে অন্য দেশগুলোও।

কাজেই, বিসিবির কর্মকর্তারা যদি এই পথে চেষ্টা করেন, জেসি ও অন্য আম্পায়ারদের প্রস্তুত করেন বড় দায়িত্বের জন্য, ডিপিএল ম্যাচে দায়িত্ব দেন। তাহলে এই উদ্যোগ তো প্রশংসা করা উচিত।

Khaled Mahmud SUjon

ন্যায্যতার প্রসঙ্গ

মোহামেডানের হাবিবুর রহমানের বিপক্ষে দেওয়া জেসির একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। হাবিবুরকে তিনি এলবিডব্লিউ আউট দিয়েছিলেন কিন্তু রিপ্লে দেখে মনে হচ্ছিলো বল তার গ্লাভসে লেগেছে আগে। এই দৃশ্যের কারণ দেখিয়ে কিছু ভক্ত ও গণমাধ্যম ক্লাব কর্তাদের তাকে নিয়ে দেখানো অনীহাকে সাফাই গেয়েছেন।

কিন্তু ডিপিএলে অভিষেকে একজনের স্রেফ এক ভুল নিয়ে কথা বলতে হলে টুর্নামেন্টের অতীত ইতিহাস দেখা জরুরি।

মাত্র দুই মৌসুম আগে এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত না দেওয়ায় সাকিব আল হাসান স্টাম্পে লাথি মেরেছিলেন। মাহমুদউল্লাহ তাকে দেওয়া একটি আউটের সিদ্ধান্ত হজম করতে না পেরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তৃণমূল পর্যায়ের আম্পায়ারিং তো আরও ভয়াবহ।

২০১৭ সালে লালমাটিয়া ক্লাবের সুজন মাহমুদ পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের প্রতিবাদে ৪টি বৈধ ডেলিভারিতে দিয়েছিলেন ৯২ রান। ফিয়ার ফাইটার্সের তাসনিম হাসান ইচ্ছে করে ১৫টি নো বল ও ১৩টি ওয়াইড দিয়ে ৭ বলে হজম করেছিলেন ৬৯ রান। এমন প্রতিবাদ করায় তাদেরকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। কিন্তু যাদের কর্মকাণ্ডে তারা এমন প্রতিবাদ করেছিলেন তাদের কিছুই হয়নি।

সুতরাং জেসিকে আম্পায়ার হিসেবে অসম্মান করা এবং তার একটি মাত্র ভুল সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ক্লাবগুলোর অবস্থান নায্য হয় না।

বিভ্রান্তি ও মানহানি

এই বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠে যখন কিছু গণমাধ্যম অতি উৎসাহী হয়ে খবরটির রঙ বদলে দেয়। অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ এবং তামিম ইকবাল নারী আম্পায়ারের বেলায় আপত্তি জানিয়েছেন বলে ভিত্তিহীন খবর প্রচার করে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ক্লিক পাওয়ার জন্য কয়েকজন ক্রিকেটারের ভাবমূর্তি ক্ষতি করে পুরো বিষয়টাকেই ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

আম্পায়ার হিসেবে জেসির বিরুদ্ধে ক্লাবগুলো যে অনীহা, উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তা চিহ্নিত করে, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে তা উন্নতি করার সুযোগ ছিলো। কিছু গণমাধ্যমের দায়িত্বজ্ঞানহীন সাংবাদিকতার কারণে মূল বিষয়টি এলোমেলো হয়ে গেছে। 

Comments

The Daily Star  | English

Bangladeshi students terrified over attack on foreigners in Kyrgyzstan

Mobs attacked medical students, including Bangladeshis and Indians, in Kyrgyzstani capital Bishkek on Friday and now they are staying indoors fearing further attacks

3h ago