বউ-শাশুড়ির শখের আচার এখন রপ্তানি পণ্য, যাচ্ছে ইউরোপেও

একবার কালবৈশাখী ঝড়ে গাছ থেকে কিছু কাঁচা আম ঝরে পড়ে। ভাইয়ের পরামর্শে সেই আম দিয়ে আচার বানান নাসিমা বেগম। তারপর থেকে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। পুত্রবধূ শান্তাকে নিয়ে খুললেন ফেসবুক পেজ। এখন তাদের আচারের স্বাদ পৌঁছে গেছে কসবা উপজেলা ছাড়িয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের খাবার টেবিলে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার ইমামপাড়া এলাকার ভাড়া বাসা থেকে শুরু হয় বউ-শাশুড়ির আচারের যাত্রা।
পাঁচ বছর আগে যাত্রাটা ছিল শখ থেকে। বৌ-শাশুড়ি এখন আম ছাড়া আরও অন্তত ২০ জাতের আচার বানাচ্ছেন। পাশাপাশি নাড়ু, নকশি পিঠা ও কেক বানাচ্ছেন। এখান থেকে তারা সংসারের খরচ যোগানোর পাশাপাশি মাসে লাখ টাকা আয় করছেন। ফেসবুক পেজ ও স্থানীয় বাজারে তাদের পণ্যের এখন ব্যাপক চাহিদা। সফল উদ্যোক্তা হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন এই দুই নারী।
নাসিমা বেগম ডেইলি স্টারকে জানান, প্রতিটি পণ্যই ঘরের খাবারের মতো যত্ন নিয়ে বানান। তারা তেল, গুড়সহ অন্যান্য কাঁচামাল সর্বোচ্চ গুণগত মান দেখে ক্রয় করেন।
কলেজ পড়ুয়া শান্তা ইসলাম জানান, আচার ও পিঠাপুলি তৈরির পাশাপাশি তারা স্থানীয় নারীদের বেকিং প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে অনেক নারী তাদের থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন, কাজ করছেন অনলাইন বাজারে।
শান্তা ইসলাম জানান, দেশের বাইরে প্রথম অর্ডার গিয়েছিল সৌদি আরবে। এরপর মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, দুবাই, ওমান ও বাহরাইন। এখন তাদের তৈরি আচার ও পিঠা যাচ্ছে যুক্তরাজ্য, ইতালি ও জার্মানিতেও।
শান্তা ইসলাম বলেন, 'প্রথমবার বিদেশ থেকে অর্ডার পেয়ে নার্ভাস লাগছিল, ঠিকঠাক পৌঁছাবে তো? কিন্তু যখন নিরাপদে পৌঁছায় ও প্রশংসা আসে, তখন খুবই ভালো লাগে।'

নাসিমা বেগম জানান, তারা আম, জলপাই, চালতা, বরই, রসুন, গরুর মাংস ও নাগা মরিচের আচার, আমসত্ত্ব, নারিকেলের নাড়ু, নকশি পিঠা, কেকসহ নানা ঘরোয়া পণ্য বানান। তবে তারা প্যাকেজিং, মান ও ডেলিভারি—তিনটি ক্ষেত্রে কোনো আপস করেন না। দেশের বিভিন্ন এলাকা ও প্রবাসী গ্রাহকদের অনুরোধে তাদের পণ্য বিশেষভাবে সিল করে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, 'শুরুটা করেছিলাম শখ করে। পরে রুটি-রুজির অন্যতম ভরসা হয়ে ওঠে 'পাকের ঘর ডটকম'। এখন আমরা প্রতিমাসে গড়ে ৬০-৭০ হাজার টাকা আয় করছেন। ঈদ, বৈশাখ ও শীতকালে আয় আরও বাড়ে।'
নাসিমা বেগম বলেন, 'পুত্রবধূ শান্তাকে আমি নিজের মেয়ের মতো দেখি বলেই আমরা একসঙ্গে এতদূর আসতে পেরেছি। এই বন্ধুত্বই আমাদের শক্তি।'
অনলাইনে পাশাপাশি স্থানীয়দের মাঝেও বউ-শাশুড়ির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় স্কুল শিক্ষক শারমিন সুলতানা বলেন, 'শান্তার হাতের নাড়ু ও আম-চালতার আচার আমাদের বাসায় সবসময় স্টক থাকে। খাঁটি জিনিস। কোনো ভেজাল করে না বলে সবসময় আমি ওদের কাছ থেকে কিনে নেই।'

আরেক স্কুলশিক্ষক ফিরোজ মিয়া বলেন, 'এক সময় কসবা থেকে কিছু কিনে ঢাকায় উপহার পাঠাতে গেলেই চিন্তা হতো। এখন 'পাকের ঘর ডটকম' থেকে আমি নিজেই প্যাকেট করিয়ে পাঠাই। তাদের তৈরি আচার দুবাইতে একাধিকবার পাঠিয়েছি।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মো. মিজানুর রহমান বলেন, 'শান্তা ও তার শাশুড়িকে দেখে বোঝা যায়, বেকার না থেকে ঘরে বসেও উপার্জন করা সম্ভব। অল্প পুঁজিতে তাদের এই অনলাইনভিত্তিক উদ্যোগ নারীদের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।'
কসবা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রওনক ফারজানা রুবা বলেন, 'অনলাইন একটি বিশাল প্ল্যাটফর্ম নারীদের জন্য। এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করে ঘরে বসেই বিশ্ববাজার ধরা সম্ভব। আমরা নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা রাখছি। শান্তা-নাসিমারা চাইলে সেই সুযোগ নিতে পারেন। এমন উদ্যোগগুলো তৃণমূলে নারীর ক্ষমতায়ন ও আত্মনির্ভরশীলতার দারুণ উদাহরণ।'
Comments