স্বৈরতন্ত্র ঠেকাতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আলোকে সংবিধান সংশোধনের দাবি

এই রাজনৈতিক সংস্কার ও সংবিধান সংশোধনের কাজটি এমনভাবে করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো সরকার, কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার মতো নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে না উঠতে পারেন।
ডেইলি স্টার সেন্টারে ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও সংবিধান সংস্কারের রূপরেখা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীরা। ছবি: রাশেদ সুমন

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারি শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আলোকে জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সু্বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনার দাবি জানিয়েছেন একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বক্তারা।

আলোচকদের ভাষ্য, এই রাজনৈতিক সংস্কার ও সংবিধান সংশোধনের কাজটি এমনভাবে করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো সরকার, কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার মতো নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে না উঠতে পারেন।

আজ শনিবার রাজধানীর ফার্মগেটে দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে 'ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও সংবিধান সংস্কারের রূপরেখা' শীর্ষক এ আলোচনা অনুষ্ঠানে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। কথা বলেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম।

সার্বিক আলোচনায় সংবিধান সংশোধনের যে রূপরেখা উঠে আসে তার উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রগুলো হলো—প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, একজন ব্যক্তি যাতে টানা দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন না করতে পারেন সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, নির্বাচন কমিশনকে আর্থিকভাবে স্বাধীন করে দেওয়া ও নির্বাচনকালীন প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টনে কমিশনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, সংসদে নিজ দলের বিরুদ্ধে সদস্যদের ভোট না দিতে পারার যে বিধান আছে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষেত্রে সংসদের ক্ষমতা বিলোপ করা, বিশেষ প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সরকারি আয়-ব্যায়ের হিসাব নেওয়া এবং সরকার সাংবিধানিকভাবে চলছে কি না, তা নজরদারির জন্য আলাদা কমিশন গঠনের বিষয়টি যুক্ত করা।

আলোচনায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরিফ খান বলেন, বাহাত্তরের সংবিধান কোনো দলীয় সংবিধান ছিল না। এই সংবিধান এক বিপুল গণজাগরণের মধ্য দিয়ে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে যারাই ক্ষমতায় গিয়েছে, সংবিধানের প্রতি অবিশ্বস্ততার কারণেই জনগণ তাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সর্বশেষ যে ফ্যাসিস্ট রেজিমকে আমরা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিদায় করেছি, সেটারও কারণ কিন্তু এই সাংবিধানিক নীতির প্রতি অবিশ্বস্ততা।'

এ কারণেই বর্তমান প্রচলিত সংবিধানের অন্তত চারটি জায়গা সংশোধনের তাগিদ দেন আরিফ খান। বলেন, 'এই সংশোধনীর জায়গাগুলো নিশ্চিত করতে পারলে তা ভবিষ্যতে কাউকে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পথে বাধা তৈরি করবে।'

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আলী আর রাজির অভিমত, 'বাংলাদেশে আমরা যা-ই করি, তা যদি আমাদের কৃষ্টি বা সংস্কৃতি থেকে না আসে, উপরে উপরে করি, তাহলে আমরা জানি যে সেটা বদলে যাবে। হাসিনা যেমন বদলে দিয়েছেন।'

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক শাহ নিস্তার জাহান কবীর সংবিধান সংশোধনের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, 'সংবিধান একেবারেই বদলে ফেলাটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। আমি সংস্কারের পক্ষে। সংস্কারের এই জায়গাগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে।'

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের আরেক শিক্ষক সরোজ মেহেদী অবশ্য 'বিপ্লব পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের জন্য' চলতি সংবিধান পুরোপুরি বাতিল করে নতুন সংবিধান তৈরির পক্ষে মত দেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার মুখে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী। তিনিও সংবিধান সংস্কারের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, 'যে ধরনের সংস্কারই আমরা করি না কেন, সেটার জন্য আমাদের বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে বসতে হবে। এখানে এখন পর্যন্ত যতগুলো সংস্কার এসেছে সেগুলো আমলে নিয়ে বাকি সংস্কারের পথে যেতে হবে এবং সেটা অবশ্যই করতে হবে ২৪ এর গণআন্দোলনের চেতনাকে সঙ্গে নিয়ে।'

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মালিহা মান্নান বলেন, 'আমরা বাঙালি না বাংলাদেশি—সংশোধনে সে বিষয়টির মীমাংসা করতে হবে আগে।'

ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাসেল আহমেদের অভিমত, 'যে কারণে ফ্যাসিস্ট জন্ম নেয়, সেই কারণগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে। তারপর আসবে সংবিধান সংশোধনের প্রশ্ন।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার সংবিধানে সংসদ সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা বেঁধে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। বলেন, ন্যায়পাল নিয়োগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার কথা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আকরাম হুসাইন নতুন বাস্তবতায় সংবিধান সংশোধনের পক্ষে-বিপক্ষে অনলাইনে মতামত নেওয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক মেহেদী সজীব সংবিধানকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া ও সহজবোধ্য করে তোলার ব্যাপারে মত দেন।

একইভাবে সংবিধানের চেতনা ও ভাষাকে জনপরিসরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাগিদ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শামীমা সুলতানা। গণআন্দোলন চলাকালীন তিনি তার বিভাগীয় কার্যালয় থেকে শেখ হাসিনার ছবি নামিয়ে ফেলে আলোচনায় এসেছিলেন।

আলোচনায় ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের অধ্যাপক ও লেখক আহমাদ মোস্তফা কামাল বলেন, 'সংবিধান বদলালেই ভাগ্য বদলায় না। ভাগ্য বদলানোর জন্য যেটা দরকার সেটা হলো, যারা এটাকে ইমপ্লিমেন্ট করবে তারা যেন নিজেরা বদলান।'

এই সংশোধন প্রক্রিয়া জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করার তাগিদও দেন এই লেখক।

আলোচনার শুরুতে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম স্বাধীনতার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক পালাবদলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সংবিধান সংশোধনের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কারের ওপরেও জোর দেন। শেখ হাসিনার পতনের অন্যতম একটি কারণ হিসেবে তার তীব্র অহংকারী মনোভাবের কথাও বলেন তিনি।

শেষে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য মাহফুজ আনাম বলেন, 'তোমরা আন্দোলন করেছ। একটা বিরাট বিপ্লব করেছ। তোমাদের মধ্যে যেন অহমিকা না আসে। বিনয় যেন তোমাদের চরিত্রে গেঁথে থাকে। তোমরা পরিবর্তন এনেছ। জাতি তোমাদের মাথায় করে রাখবে।'

আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন—প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিল্লাল হোসেন, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মাঈনুল হাসান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুলাইমান আহসান, সাংবাদিক মাসরুর শাকিল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক রাসেল আব্দুর রহমান, গবেষক রাশেদ রাহুম, দারুন নাজাত মাদরাসার শিক্ষার্থী আবদুল আহাদ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইশতিয়াক হাসান, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী রকিবুল ইসলাম হৃদয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ঐতিহ্য আহমেদ ও নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়াতুল্লাহ।

আলোচনা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডেইলি স্টারের সাংবাদিক ইমরান মাহফুজ

Comments

The Daily Star  | English
economic challenges for interim government

The steep economic challenges that the interim government faces

It is crucial for the interim government to focus on setting a strong foundation for future changes.

16h ago