বাবার জন্যে ২৩ বছরের অপেক্ষা
১৬ ডিসেম্বর। এই তারিখে বাংলাদেশের আপামর মানুষ বিজয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা থাকে। উৎসব উদযাপিত হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। কিন্তু, সেই একই তারিখে নিখোঁজ হওয়া স্বামীর জন্য স্ত্রী, বাবার জন্য সন্তানরা অশ্রু-ভরা নয়নে চেয়ে থাকে ঘরের দরজায়। বুকের ভেতরে চাপা কষ্ট, বুক ভরা চাপা আর্তনাদ বন্দি রেখে একে অন্যের মুখপানে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না তাদের।
বিজয় দিবসের এই দিন আসলে বাবার জন্য হাহাকার বেড়ে যায় আব্দুল হান্নানের তিন সন্তানের। এই বুঝি আসবে বাবা। এই বুঝি দেশের বিজয়ের উল্লাসে সঙ্গে যোগ দিতে পারবে তারাও। কিন্তু, সেই অপেক্ষার অবসান হবে কবে?
১৯৯৫ সালে নিজের মালিকানাধীন মাইক্রোবাস ও চালকসহ নিখোঁজ আব্দুল হান্নানের কোনো সন্ধান আজ অবধি পাওয়া যায়নি। আব্দুল হান্নান কুলাউড়া পৌরশহরের উছলাপাড়া নিবাসী মরহুম আব্দুস ছাত্তারের প্রথম ছেলে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, কুলাউড়ার ডাকবাংলো মাঠে বিজয় মেলা-৯৫ এর সমাপনী অনুষ্ঠান চলছিলো। কুলাউড়াবাসীর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত সাতজন যুবক মেলায় অনেকক্ষণ ঘোরাফেরা করে মেলা থেকে বেরিয়েই প্রায় তিন শত গজ উত্তরে গিয়ে রাস্তায় একটি মাইক্রোবাস দাঁড়ানো দেখে চালককে তারা জানায়, তারা ঢাকার বাসিন্দা। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত দেখতে এসেছিলেন। তারা ঢাকায় ফেরত যেতে চান। গাড়িচালক তাদের কাছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা ভাড়া দাবি করে। চালক গিয়াস যখন যুবকের সঙ্গে আলাপ করে তখন গাড়ির মালিক আব্দুল হান্নান সেখানে উপস্থিত হন। আব্দুল হান্নান অবশেষে ঢাকার মালিবাগে যুবকদের নিয়ে যেতে রাজি হন। এক হাজার ২ শত টাকা অগ্রিম এবং বাকি টাকা ঢাকা যাওয়ার পর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
তখন সন্ধ্যা ৭টা। মাইক্রোবাসটির নম্বর ঢাকা মেট্রো-চ-০২-৪৫৭৭ চালক গিয়াস যাত্রীবেশী কথিত যুবক ও গাড়ির মালিক আব্দুল হান্নানকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। ঢাকায় যাওয়ার পথে সেই থেকে আজ পর্যন্ত গাড়ির মালিক আব্দুল হান্নান ও চালক গিয়াস নিখোঁজ।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৫ থেকে ২০১৮ সাল। কেটে গেলো ২৩ বছর। কিন্তু, পরিবার-পরিজন এখনও আশায় বুক বেঁধে আছেন, তারা ফিরবেন।
কুলাউড়া পৌর এলাকার উছলাপাড়ায় গিয়ে দেখা যায় আব্দুল হান্নানের স্ত্রী শেফালি অশ্রুসিক্ত চোখে পথ চেয়ে আজও অপেক্ষা করছেন তার স্বামীর ফেরার আশায়। হান্নানের ভাই-বোন ও সন্তানেরা আজও অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। তারা হান্নানের সন্ধান চান। জানতে চান তাদের হান্নান বেঁচে আছেন, নাকি পৃথিবী থেকে চলে গেছেন।
নিখোঁজ হান্নানের ছেলে শফিউল আলম সৌরভের মনে আজও প্রশ্ন জাগে- বাবা ফিরবে তো, বাবাকে স্বচক্ষে দেখতে পারবে তো? কেনোইবা বাবাকে তারা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো? সদা হাস্যোজ্জ্বল হান্নান দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় থেকে নিখোঁজ। মারা গেছেন নাকি বেঁচে আছেন- তা কেউ জানেন না।
নিখোঁজ আব্দুল হান্নানের ছোটভাই স্পেন-প্রবাসী তুতিউর রহমান জানান, আব্দুল হান্নান ও চালক গিয়াসকে গাড়িসহ অপহরণ করা হয়েছে বলে ঘটনার দুই দিন পর অনুমান করা হয়। তারা ফিরে না আসাতে পরিবারের পক্ষ থেকে কুলাউড়া থানায় জিডি (নং-৬৫১/১৮-১২-১৯৯৫ইং) করা হয়। পরবর্তীতে এর তদন্তভার ডিবিতে স্থানান্তরিত হয়। ১৫ এপ্রিল ১৯৯৬ ডিবি থেকে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু, অদ্যাবধি নিখোঁজ ব্যক্তিদ্বয়সহ ছিনতাইকৃত গাড়িটি উদ্ধার সম্ভব হয়নি।
সৌরভ অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, “আমরা আর কতকাল এভাবে পথ চেয়ে থাকব। বেঁচে থাকলে ফেরত চাই, মারা গেলে লাশের সন্ধান চাই। তবুও কবর দেখে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারবো, বাবা আমরা তোমার পাশে আছি। দেশে এখন গুম-খুন, অপহরণ অহরহ ঘটলেও তৎকালীন সময় চালক, গাড়িসহ মালিক আব্দুল হান্নানের নিখোঁজের বিষয়টি কুলাউড়াসহ সিলেট বিভাগজুড়ে ব্যাপক আলোচিত ছিলো।
হান্নান নিখোঁজের ৭ মাস পর স্ত্রী শেফালীর কোলে আসে পুত্রসন্তান পায়েল। আব্দুল হান্নানের তিন ছেলের মধ্যে রুবেল বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং, শফিউল আলম সৌরভ মাস্টার্স এবং পায়েল আলিমে এ অধ্যয়নরত।
Comments