সুস্থ সমাজের জন্য আইনের শাসন জরুরি
বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম, লিজা রহমানের মৃত্যুর খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে। রাজশাহীর একটি থানা থেকে বের হয়েই এইচএসসি পড়ুয়া মেয়েটি গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাঁচদিন পর মারা যায়।
এরই মধ্যে আরো দুটি খবর তো পুরো দেশই নাড়িয়ে দিলো। এক, যুবলীগের নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও তার সহযোগী গ্রেফতার। দুই, তার পরদিন বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদের মৃত্যু।
এবারের আশ্বিনের প্রকৃতিও যেনো বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। বর্ষা যেনো যেতেই চাইছে না। প্রতিদিনই কালো মেঘে বারবার আকাশ ঢেকে যাচ্ছে। অবিরাম ধারায় বৃষ্টি ঝরে চলেছে। তবু প্রকৃতির খেয়ালে কিছু ছেদ আছে, যেখানে সুনীল আকাশে শরতের সাদা মেঘের ভেলা হাওয়ায় দুলে বিষণ্ণ মানুষগুলোর দিকে চেয়ে হাত নাড়ে। কিন্তু, বিষণ্ণতার কোনো কুল-কিনারা মেলে না।
গাইবান্ধার মেয়ে লিজার বাবা মোহাম্মদ আলম আমাকে বলছিলেন, “আমার মেয়ে যখন তার সমস্যা নিয়ে থানায় গেলো, তখন পুলিশ তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত দেখলো। তারা তখন তার অভিভাবকদের কেনো ডাকল না, কেনো একা-একা ছেড়ে দিলো যে ও গায়ে আগুন ধরিয়ে দিতে পারলো?” পুলিশের কর্মকর্তারা অবশ্য তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে ঘটনাটা এমনভাবে ঘটেছে যে তারা সময় মতো কোনো পদক্ষেপই নিতে পারেনি।
আবার দ্য ডেইলি স্টারে খবর এসেছে, ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুন বলেছেন, “কীভাবে জানি না, আমি আমার ছেলেকে জীবন্ত ফেরত চাই।” জানি না রাষ্ট্র কীভাবে ফাহাদের মার এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়াবে।
অন্যদিকে দেখলাম, অনেক ঢাক গুড়গুড় করে সম্রাট আর তার সহযোগী গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের সরাসরি জেলে পাঠানো হলো বিদেশি ক্যাঙ্গারুর চামড়া ঘরে রাখার দায়ে। পরে অবশ্য আরো অভিযোগ আসবে বা এসেছে তাদের বিরুদ্ধে।
কিন্তু, আমার কাছে মনে হয়েছে, বন্যরা তবু কিছুটা দামি। ওদের কারো চামড়ার জন্যও তাৎক্ষণিক দণ্ড পেতে হয়। আর মানুষ? এদের কেউ মরলে প্রথমে আসে কথার মালা, বিচারের দাবি, দৃঢ় সংকল্প। দাবি রাস্তায় না গড়ালে তো হারিয়েই গেলো। চলতে থাকে তদন্ত, বিচার। কে দণ্ড পেলো কে পেলো না- তার হিসাব মেলে না। একই মৃত্যু নানান নামে ফিরে আসে। কাছের ব্যথায় দূরবর্তী ব্যথাগুলো ফিকে হতে থাকে।
অবৈধ টাকার জোর, বেআইনি ক্ষমতা প্রয়োগের জোরের কাছে অনেক মন চুপ করে থাকে। ভীরুতায়, কাপুরুষতায় সমাজ বড় হতে থাকে। এরপর আর ভাবতে সাহস হয় না। বড় প্রজন্ম নিজেই অন্ধকারে আছে। নতুন প্রজন্ম পথ হাতরে মরছে। বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে তার সমস্যা। সমাধান নেই কারো কাছে।
থাকবেই বা কী করে, কাউকে না কাউকে তো একটা না একটা দর্শন মেনে চলতে হবে। অন্তত আমাদের মহান সংবিধান- যেখানে বলা আছে “সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত” হবে।
মানুষের একটাই জীবন। এ জীবনে মানুষ তার স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ পেতে চায়, তার সৌকর্যের চরমতম বিকাশ দেখতে চায়। এর জন্য সে নির্ভয়ে যুক্তি দেবে, পাল্টা যুক্তি আসবে, মত-ভিন্নমতে বেরিয়ে আসবে সৌকর্যতা।
আর এটা তখনই সম্ভব যখন দেশে সব নাগরিকের জন্য আইনের পূর্ণ শাসন নিশ্চিত থাকে। আইনের শাসন বাস্তবায়নে শুধু রাষ্ট্র একাই ভূমিকা রাখবে তাও নয়, প্রতিটি নাগরিকের, ব্যক্তি-মানসে এর প্রতিচ্ছবি পরিস্ফুট থাকা চাই। তবেই আমরা পাব সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক এক উন্নয়নশীল সমাজ।
আনোয়ার আলী, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
Comments