অভ্যন্তরীণ অনিয়মে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম প্রশ্নের সম্মুখীন: মাহবুব তালুকদার
অভ্যন্তরীণ অনিয়মের কারণে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম এখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।
আজ (২৫ নভেম্বর) রাজধানীর নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমি মনে করি, অভ্যন্তরীণ অনিয়মের কারণে, এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। অনেক ক্ষেত্রে সচিবালয়ের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু, নির্বাচন কমিশনকে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দায় বহন করতে হয়।”
“এই অনভিপ্রেত অবস্থার অবসানের জন্য নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত বিষয়ে সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ও নির্বাচন কমিশন কার্যপ্রণালী বিধিমালা কঠোরভাবে পরিপালন করা আবশ্যক,” বলে মন্তব্য করেন নির্বাচন কমিশনার।
মাহবুব তালুকদার বলেন, “নির্বাচন কমিশন ও সচিবালয়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।”
“নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে এক ধরণের স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসছে,” উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “এগুলো সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ও নির্বাচন কমিশন কার্যপ্রণালী বিধিমালা সমর্থন করে না।”
গতকাল (২৪ নভেম্বর) কমিশনের এখতিয়ারের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত পাওয়ায় সাংবাদিকরা কমিশনারের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে তার এই অভিমত জানান।
মাহবুব তালুকদার বলেন, “গত ১২ নভেম্বর আমি সংবাদ পাই যে, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাম্প্রতিক কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় ১৩৫ জন পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু, কারো বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বিষয়টি সম্পর্কে বিশদভাবে জানার জন্য আমি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কাছে লিখিতভাবে কিছু তথ্য ও জিজ্ঞাসার জবাব জানতে চাই।”
“গত ১৪ নভেম্বর আমাকে জানানো হয় যে, হাতের লেখার অমিল বা পরিচয়পত্রের অমিলের কারণে ভাইবার সময় ওই ১৩৫ জনকে বহিষ্কার করা হয়। তাদের প্রতারণার দায়ে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, আমার এমন প্রশ্নের জবাবে জানানো হয়− ‘মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য দেখানো হয়েছে। কারো কারো কাছ থেকে লিখিত স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে’।”
“লিখিতভাবে আমাকে আরও জানানো হয়, কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় ৩৩৯টি শূন্যপদের বিপরীতে ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তরপত্র যাচাইয়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদকে ৪ কোটি ৮ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে।”
“এই অর্থ প্রধান নির্বাচন কমিশনার অনুমোদন করলেও কতোজন পরীক্ষককে কীভাবে এই টাকা দেওয়া হয়েছে, তার কোনো হিসাব নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই। এমনকী, নিয়োগ কমিটির সদস্যরা এবিষয়ে অবহিত নন। কমিশন সচিবালয় পরীক্ষা সম্পর্কে কিছুই জানে না। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের ধরণ বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ।”
তিনি বলেন, “১৪ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে তার অফিসকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় নির্বাচন কমিশনাররা অভিযোগ করেন যে, কমিশন সচিবালয় উক্ত নিয়োগ পরীক্ষা সংক্রান্ত ও অর্থ ব্যয় সম্পর্কিত বিষয়ে কমিশনকে কোনো পর্যায়েই অবহিত করেনি। উত্তরে কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব জানান, উল্লিখিত নিয়োগ বা এতদসংক্রান্ত ব্যয় নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার বহির্ভূত। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও তার বক্তব্য সমর্থন করেন।”
“স্বাভাবিক কারণেই নির্বাচন কমিশনারবৃন্দ ২৪ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে একটি ইউ, ও নোটের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কার্যাদির বিষয়ে কমিশনের এখতিয়ার সম্পর্কে অবহিত হতে চান।”
সিইসির সঙ্গে ৪ কমিশনারের বিরোধ
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে নিয়োগকে কেন্দ্র করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নূরুল হুদার সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়েছে চার নির্বাচন কমিশনারের। কমিশনারদের কোনো মত না নিয়ে, না জানিয়ে চলতি মাসে কমিশনে ৩৩৯ জন কর্মচারীর নিয়োগ চূড়ান্ত করায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
কর্মচারী নিয়োগ চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে চার কমিশনারের মতামত বা অনুমোদন না নিয়েই সিইসি তা অনুমোদন দেওয়ায় কমিশনাররা সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা তুলে ধরে ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কার্যক্রমের বিষয়ে ‘নির্বাচন কমিশন’র এখতিয়ার’ নিয়ে কথা বলেন।
নির্বাচন কমিশনাররা হলেন: মাহবুব তালুকদার, মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী।
গতকাল (২৪ নভেম্বর) চার কমিশনার সম্মিলিতভাবে সিইসিকে একটি চিঠি দেন। সেই চিঠিতে কমিশনাররা সংবিধান মোতাবেক বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব তুলে ধরেন। দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, “কমিশন শুধুমাত্র সংবিধান ও আইনের অধীন থাকবে”।
এ প্রসঙ্গে কমিশনাররা ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন’ প্রসঙ্গও তুলে ধরেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্যে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় গঠিত হয়েছে। “নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণে অর্পিত সকল দায়িত্ব পালন করিবে এবং সচিব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের নিকট দায়ী থাকিবেন,” বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী “নির্বাচন কমিশন সচিবালয় নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় সব সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে এবং নির্বাচন কমিশন থেকে দেওয়া অন্যান্য দায়িত্বও সম্পাদন করবে।”
কমিশন সচিবালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৩৩৯ জন কর্মচারী নিয়োগ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সচিবালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে কমিশনের চার কমিশনারকে না জানানোর অভিযোগ করা হয়। কমিশনাররা সচিবালয়ের এমন আচরণ আইন ও বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেছেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ১৪ নভেম্বর সিইসির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়ের ১২তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত শূন্যপদে কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম বিষয়টি তুলে ধরা হয়। সেই সভায় সব কমিশনার, সিনিয়র সচিব ও অতিরিক্ত সচিব উপস্থিত ছিলেন।
Comments