নোয়াখালীতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

‘অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় নির্যাতন, ভিডিও ধারণ’

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে স্থানীয় বাদলের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন লোক গৃহবধূর বাড়ি ঘিরে রাখে। এসময় ১৬-১৭ জন দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে নির্যাতন চালায় বলে জানান নির্যাতিতা নারী।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে স্থানীয় বাদলের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন লোক গৃহবধূর বাড়ি ঘিরে রাখে। এসময় ১৬-১৭ জন দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে নির্যাতন চালায় বলে জানান নির্যাতিতা নারী।

তিনি আজ সোমবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অব্যাহত কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় বাড়িতে দরজা ভেঙে ঢুকে নিপীড়ণ চালানো হয় এবং সেই ঘটনার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।'

দুপুরে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় নির্যাতনের শিকার ওই নারী জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পর্ণোগ্রাফি আইনে তার করা দুই মামলাতেই এ কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।

দুই মামলায় বাদলকে (২২) প্রধান আসামি করে ৯ জনের নাম উল্লেখসহ ৭-৮ জন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। তবে মামলায় স্থানীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান দেলোয়ারকে আসামি করা হয়নি। 

এজাহারের আসামিরা হচ্ছেন-একলাশপুর ইউনিয়নের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের বাদল (২২), মো. রহিম (২০), আবুল কালাম (২২), মধ্যম একলাশপুর গ্রামের ইসরাফিল হোসেন মিয়া (২২),রহমত উল্যাহ (৪১), পূর্ব একলাশপুর গ্রামের সাজু (২১), সামসুদ্দিন সুমন (৩৯), একলাশপুর গ্রামের আবদুর রব ওরফে চৌধুরী মিয়া (৪০) ও আরিফ (১৮)। 

এ ঘটনায় বেগমগঞ্জ থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে রোববার বেগমগঞ্জ থেকে আবদুর রহিম ও রহমত উল্যাহকে গ্রেপ্তার করে। অন্যদিকে র‌্যাব সোমবার সকালে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে মামলার প্রধান আসামি বাদল ও এজাহার বহির্ভূত দেলোয়ার বাহিনী প্রধান দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করে।

নির্যাতিতা নারী জানান, ২০০১ সালে তার বিয়ে হয়। তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। ৮-৯ বছর আগে তার অমতে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এ ঘটনায় তিনি ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন। 

তিনি জানান, গ্রামের বাদল, সাইফুল, সুমন, আবুল কালামসহ উল্লেখিত আসামিরা দফায় দফায় কুপ্রস্তাব দিয়ে আসছিল। তাতে সায় না দেয়ায় বাদল ও তার লোকজন তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। প্রায় প্রতি রাতেই তারা ঘরের চারপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করত এবং ভয় দেখাতো। দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি স্বামী তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ নিয়ে বাদল ও তার লোকজন তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়।

ওই নারী জানান, গত ২ সেপ্টেম্বর রাত আনুমানিক ৯-১০টার দিকে তার স্বামী বাড়িতে আসেন। এর কিছুক্ষণ পরই বাদলের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন লোক তার ঘর ঘিরে ফেলে। এক পর্যায়ে বাদল ও তার লোকজন লাথি মেরে ঘরের দরজা ভেঙ্গে ঢুকে তার স্বামীকে পিটিয়ে পাশের একটি ঘরে আটকে রাখে। এরপরই বাদলসহ তার লোকেরা তাকে মারধর শুরু করে। বাদল তার মাথায় স্টিলের টর্চলাইট দিয়ে আঘাত করেন। এরপর তিনি চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়।

তিনি জানান, নির্যাতনের ঘটনা ভিডিও করে হামলাকারীরা। তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলেও সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ কাছে আসতে সাহস পায়নি। নির্যাতনকারীরা চলে যাওয়ার সময় এ ঘটনা কাউকে জানালে ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেবে বলে হুমকি দেয়।  

তার ঘরে বিদ্যুৎ না থাকায় হামলার সময় দেলোয়ার ছিলেন কিনা তা তিনি বলতে পারেননি। 

ঘটনার পরদিন সকালে নির্যাতিতা নারী স্থানীয় একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বিচার চান। মেম্বার সুষ্ঠ বিচারের আশ্বাস দিলেও তিনি কিছুই করেননি। 

এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে নির্যাতনকারীরা তাকে পুনরায় অনৈতিক প্রস্তাব দেয়। একপর্যায়ে তিনি সন্ত্রাসীদের ভয়ে বসতঘরে তালা দিয়ে তার বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন বলে জানান নির্যাতিতা ওই নারী। 

নির্যাতনকারীদের সর্বোচ্চ সাজা ও ইউপি মেম্বারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।

ঘটনার বিচার দিলেও কারা নির্যাতন করেছিল তাদের নাম ওই নারী জানাননি বলে দাবি করেছেন ইউপি মেম্বার মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগ। তিনি বলেন, তাই তিনি এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি।

এলাকাবাসীদের কয়েকজন জানান, নির্যাতনকারীরা স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনন্তপুর ও জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের একাধিক বাসিন্দা বলেন, বাদল, রহিম, আবুল কালাম, ইসরাফিল, আরিফসহ ৩০-৪০ জন যুবক স্থানীয় যুবলীগ নেতা দেলোয়ারের অনুসারী। তারা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সাথে জড়িত। দেলোয়ার যুবলীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় মামলা থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ। 

এ ব্যাপারে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আসাদুজ্জামান আরমান বলেন, নির্যাতনকারীরা ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। একটি মহল ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে।

তিনি বলেন, ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের উদ্যোগে একলাশপুরে মানববন্ধন হয়েছে।

জেলা যুবলীগ আহ্বায়ক ইমন ভট্ট বলেন, নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা মধ্যযুগীয় বরবর্রতাকে হার মানায়। হামলাকারীরা যুবলীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয় দাবি করে তিনি বলেন, নির্যাতনকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। যুবলীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কোন ব্যক্তি এ ধরনের বর্বোরচিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না বলেও দাবি করেন তিনি।

এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী-৪ আসনের (সদর-সুবর্ণচর উপজেলা) সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী আজ এক ভিডিও বার্তায় নারীর ওপর নির্যাতনের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে নির্যাতনকারীদের শাস্তি দাবি করেছেন।

বেগমগঞ্জ মডেল থানার ওসি হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, নির্যাতনের শিকার নারীকে রোববার রাতে তার বোনের বাড়ী থেকে উদ্ধার করে থানায় আনা হয়। রাতে তার লিখিত অভিযোগগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নথিভুক্ত করা হয়েছে। 

মামলার আসামিরা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা তা জানেন না বলে জানান ওসি।  

নোয়াখালী পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘নারী নির্যাতনের এই ঘটনায় এজাহারের ৯ আসামির মধ্যে পুলিশ ও র‌্যাব ইতোমধ্যে ৩ জনকে ও এজাহার বহির্ভূত একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। আসামিরা কোন দলের বা কোন নেতার অনুসারী সেটা বিবেচ্য নয়। সে যেই হোক না কেন তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

Comments

The Daily Star  | English

Former planning minister MA Mannan arrested in Sunamganj

Police arrested former Planning Minister MA Mannan from his home in Sunamganj's Shatiganj upazila yesterday evening

1h ago