আদর্শবান শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্যামল ভট্টাচার্যের দেহ গবেষণায় দান
বগুড়ার প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং বগুড়া জেলা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক শ্যামল ভট্টাচার্যের দেহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দান করেছে তার পরিবার।
তার ছোট ছেলে অভ্য ভট্টাচার্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বাবার ইচ্ছানুসারে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে চিকিত্সা বিজ্ঞানের গবেষণায় তার মরণোত্তর দেহ আইনগতভাবে আজ দুপুরে দান করা হয়েছে।’
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল আলম জুয়েল বিষয়টি স্বীকার করে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আইনগত প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে শ্যামল ভট্টাচার্যের দেহ আমাদের এনাটমি বিভাগে দান করেছে তার পরিবার। ভবিষ্যতে চিকিত্সা শাস্ত্রে তার দেহ (ব্যবচ্ছেদ বিদ্যায়) অনেক কাজে লাগবে।’
বগুড়া জেলা স্কুলের এই বরেণ্য শিক্ষক গতকাল বুধবার সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে দেহত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
এর আগে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে গত বৃহস্পতিবার তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়েছিল। পরে ১ নভেম্বর তাকে বগুড়ার এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানে তিনি কোমায় ছিলেন বলে জানায় তার ছেলে।
বগুড়ার কথাসাহিত্যিক এবং কবি বজলুল করিম বাহার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘শ্যামল ভট্টাচার্য অনেক গুণী মানুষ ছিলেন। তিনি একাধারে একজন শিক্ষক, নাট্যকার এবং মানুষের পথপ্রদর্শক ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও তিনি হয়েছিলেন জেলা স্কুলের একজন শিক্ষক। সক্রিয় রাজনীতি না করলেও তিনি বামধারার রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। আমরা তাকে পেয়েছি এবং মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে। তিনি বগুড়া নাট্য গোষ্ঠী (১৯৭২) এবং পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে বগুড়া নাট্য দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য অনন্য ভূমিকা রেখেছিল।’
‘চেকভের অনুদিত নাটক ‘নানা রঙের দিনগুলো’তে তিনি একক অভিনয় করেছিলেন। নাটকে তার বাগ্মিতা এবং বাচনভঙ্গি ছিল অনন্য সাধারণ। এছাড়া নুরুল দিনের সারাদিন নাটকসহ প্রায় ৪০-৫০ নাটকে তিনি দীর্ঘদিন অভিনয় করেছিলেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ছায়ানটসহ ঢাকার প্রায় সব বড় গুনি মানুষের সংস্পর্শে ছিলেন তিনি। তিনি যদি বগুড়া ছেড়ে ঢাকায় থাকতেন তাহলে আমরা তাকে একজন দেশ বরেণ্য নাট্যকার হিসেবেই পেতাম,’ বলেন অনুজ এই কবি।
শিক্ষকতা, অভিনয়, নাটক নির্দেশনা ছাড়াও তিনি লেখালেখি করতেন। তিনি কদবানু বেগম নামে একটি উপন্যাস এবং শ্যামাপাখি নামে একটি শিশুতোষ উপন্যাস লিখেছেন।
শ্যামল ভট্টাচার্য ১৯৩৯ সালের ১০ আগস্ট বগুড়ার জলেশ্বরীতলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি প্রকৌশল নিয়ে ডিপ্লোমা পাশ করেন ঢাকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। এর পরে প্রকৌশলী হিসাবে কিছুদিন সরকারি চাকরিও করেন। পরে ১৯৬৭ সালের ১৬ জানুয়ারি বগুড়া জিলা স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় বগুড়ায় তিনি সংগঠক হিসেবেও কাজ করেন। এই সময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জলেশ্বরীতলা লাইব্রেরির দায়িত্বে ছিলেন শ্যামল ভট্টাচার্য।
বগুড়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সমন্বয়কারী এটিএম রাশেদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘শ্যামল স্যার আমরণ বগুড়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাণ ছিলেন। বগুড়ার মানুষের জন্য ছিলেন একটি আলোকবর্তিকা। পড়া পাশাপাশি তিনি মানবিক গুণাবলী অর্জনের জন্য ছাত্রদের নির্দেশনা দিতেন। সিলেবাসের বাইরে বই পড়তে সবাইকে উত্সাহিত করতেন। তিনি প্রায় বলতেন, ‘একজন শিক্ষক তখনই সফল, যখন তার ছাত্র শিক্ষকের সাহায্য ছাড়া একাই চলতে পারে। আবার একজন শিক্ষক তখনই বিফল যখন তার ছাত্র সেটা করতে ব্যর্থ হয়।’
Comments