‘একটা মুখ তো, কতা কম কবা’

‘ও মানুষ…দুডো চোখ দুডো কান, দ্যাখবা শোনবা, একটা মুখ তো, কতা কম কবা’।

'ও মানুষ…দুডো চোখ দুডো কান, দ্যাখবা শোনবা, একটা মুখ তো, কতা কম কবা'।

খুলনা-সাতক্ষীরা এলাকার আঞ্চলিক ভাষায় একজন অখ্যাত শিল্পীর গাওয়া এই গান বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে। তিনি গেয়েছিলেন বেশ দরদ দিয়ে। তখন তার গানের 'একটা মুখ তো, কতা কম কবা' লাইনটি মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

এখনও কেউ একটু বেশি কথা বললে বা অপ্রাসঙ্গিক কথা বললে লাইনটি রসিকতার ছলে কিংবা সিরিয়াসলিও অনেকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেন।

কথা বলার জন্য শরীরের একাধিক অঙ্গ ব্যবহৃত হলেও মূল ভূমিকা পালন করে জিহ্বা। যে কারণে জিহ্বা সংযত রাখার নির্দেশনা ধর্মেও আছে। নবী মুহাম্মদও (স.) বলেছেন, সেই প্রকৃত মুসলিম, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ। এখানে বোঝানো হয়েছে, যার কথার দ্বারা কেউ কষ্ট না পায়, তিনিই উত্তম ব্যক্তি। এটি একজন সাধারণ মানুষের বেলায় যেমন সত্য, তারচেয়ে বেশি সত্য সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।

মুশকিল হলো, আমাদের রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদেরও অনেকে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল বা অসম্মানিত ও অপদস্থ করার জন্য মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন, যা শালীনতা, ভদ্রতা ও রুচির মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়। এসব কথার দ্বারা তাদের প্রতিপক্ষ যতটা না অসম্মানিত হন, তারচেয়ে বরং যারা এসব কথা বলেন, তাদের সম্পর্কেই সাধারণ মানুষের মনে অশ্রদ্ধা তৈরি হয়।

বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যারা ভবিষ্যতে দেশের নীতিনির্ধারক হবেন, তারাও যখন দেখেন অগ্রজরাই কথাবার্তায় সংযত নন বা তাদের কথার মধ্যেই রুচি ও শালীনতার অভাব রয়েছে, তখন সেই তরুণরা হতাশ হন কিংবা তারাও ভাবেন যে, প্রতিপক্ষকে নিয়ে এভাবেই কথা বলতে হয়।

ভবিষ্যতে যখন তারা বড় রাজনীতিবিদ বা নীতিনির্ধারক হবেন, তারাও তখন পূর্বসূরিদের অনুসরণ করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এভাবেই জিহ্বার অপব্যবহার করবেন। অর্থাৎ যে রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণ তরুণদের জন্য মডেল হওয়ার কথা ছিল, তারাই প্রতিনিয়ত নিজেদের কথা ও আচরণে নিজেদেরকে হাস্যকর ও অশ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করছেন। কিন্তু নিজের জিহ্বাকে সংযত করতে না পারার এই প্রবণতা যদি সাংবিধানিক পদে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যেও ছড়িয়ে যায়, সেটি আরও দুর্ভাগ্যজনক, আরও বেশি হতাশার।

গত রোববার সকালে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল-এনডিএমের সঙ্গে সংলাপের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তলোয়ারের বিপরীতে প্রতিপক্ষকে রাইফেল নিয়ে দাঁড়াতে হবে। তবে তার এই কথা নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে সেদিন বিকেলেই বাংলাদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে সংলাপে তলোয়ার ও রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ না করার পরামর্শ দেন। অর্থাৎ সকালের বক্তব্য থেকে সরে আসেন।

সিইসি বলেন, 'নির্বাচন এক ধরনের যুদ্ধ। অনেকেই বলছেন— আসেন, যুদ্ধের মাঠে আসেন। সেখানে আসলে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করলে হবে না। আপনাদের আসলে জনসমর্থন নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। আপনারা তলোয়ার-রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করবেন না। আপনাদের জনসমর্থন যেগুলো আছে, তারা আসবে। আপনারা ব্যালট নিয়ে যুদ্ধ করবেন। সেই যুদ্ধটা আপনাদের করতে হবে।'

এর আগে সকালে প্রথম সংলাপে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোকে রাইফেল অথবা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়ে সিইসি বলেছিলেন, 'ভোটের মাঠের সহিংসতা নির্বাচন কমিশন বন্ধ করতে পারবে না। আপনাদের (রাজনৈতিক দলকে) দায়িত্ব নিতে হবে। আপনারা মাঠে যাবেন। মাঠে খেলবেন, আমরা রেফারি। সব দল সহযোগিতা না করলে আমরা সেখানে ব্যর্থ হয়ে যাব। আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কী করব? কাজেই আমরা সাহায্য করব। পুলিশের ওপর, সরকারের ওপর আমাদের কমান্ড থাকবে।'

এটা ঠিক যে, সিইসি তলোয়ারের বিপরীতে রাইফেল নিয়ে দাঁড়ানোর কথাটি বলেছেন প্রতীকী অর্থে। তার এই কথার মধ্যে একধরনের হতাশাও আছে। কারণ সিইসি হওয়ার আগেও তিনি রাষ্ট্রের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দলের আচরণ সম্পর্কে সম্যক অবহিত, অবগত।

একটি ভালো নির্বাচন করা যে কত চ্যালেঞ্জিং, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, যেটি সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন হলেও বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই পরাধীন, সেরকম একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অবাধ, সুষ্ঠু এবং সর্বোপরি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা খুব সহজ নয়। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখেই তিনি ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদেকে শক্তিশালী হওয়ার আহ্বান জানাতে গিয়ে মূলত তলোয়ার ও রাইফেলের উদাহরণ টেনেছেন। এটি নির্মম বাস্তবতা।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সিইসির মতো একটি সাংবিধানিক পদে থেকে তিনি প্রতীকী অর্থেও এ জাতীয় কথা বলতে পারেন কি না? দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, সিইসির এই বক্তব্য নির্বাচনে সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার শামিল।

তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিজের এই বক্তব্য থেকে সিইসি সরেও আসেন। হয়তো তিনি নিজেই এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, কথাটি প্রতীকী অর্থে বললেও এর প্রতিক্রিয়া ভালো হয়নি। তিনি যে নিজের বক্তব্যে অনড় থাকেননি, সেজন্য তিনি ধন্যবাদ পেতেই পারেন। তবে সেই সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ যারা ভোটের মাঠে প্রধান পক্ষ, তাদেরকে বরং এই উপলব্ধি করতে হবে যে, পরিস্থিতি কতটা খারাপ হলে একজন সিইসিকেও তলোয়ারেরও বিপরীতে রাইফেলে নিয়ে দাঁড়ানোর কথা বলতে হয়।

শুধু নির্বাচন কমিশনের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয়। একটি নির্বাচন কেমন হবে সেটি প্রধানত নির্ভর করে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দল ও প্রার্থীদের উপরে, মাঠ প্রশাসনের উপরে। নির্বাচন কমিশনকে কাগজে-কলমে স্বাধীন বলা হবে, অথচ এমন একটি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা বহাল রাখা হবে যেখানে নির্বাচন কমিশনের কথাকে মাঠ প্রশাসন পাত্তা না দিলেও কিছু হয় না—সেই ব্যবস্থায় একা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়।

স্মরণ করা যেতে পারে, সদ্য অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে নির্বাচনী এলাকা ছাড়ার চিঠি দিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি এই নির্দেশনা মানেননি। তখন সিইসি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছিলেন, 'সংসদ সদস্যের জন্য ইসির অনুরোধই "যথেষ্ট"। এরপরও না মানলে এবং মামলার ফলাফল না পেলে করার কিছু থাকে না।' তখনও সিইসির এই কথা নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়। কারণ নির্বাচনী আইন বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইসি যেকোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে—যা মানতে সংসদ সদস্যরাও বাধ্য।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালার ২২ ধারায় স্পষ্টত বলা হয়েছে, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচন পূর্ব সময়ে নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণায় নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না। তবে তিনি ওই এলাকার ভোটার হলে কেবল ভোট দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে যেতে পারবেন।

এই বিধিমালার ১৩ নম্বর সংজ্ঞায় সরকারি সুবিধাভোগীদের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেখানে সংসদ সদস্যও রয়েছেন। সুতরাং নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে যে স্থানীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করছেন, তাহলে তাকে এলাকা ছাড়তে বলার আইনি অধিকার আছে তাদের। কিন্তু কুমিল্লার সংসদ সদস্য বাহারকে এলাকা ছাড়তে বলার পরেও তিনি যখন সেই নির্দেশ বা অনুরোধ মানলেন না, তখন গণমাধ্যমের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন সিইসি।

তবে নির্বাচনের এইসব ইস্যু অন্য তর্ক। কথা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ তথা সাংবিধানিক পদে থাকা মানুষ কী বলবেন এবং বলবেন না—তা নিয়ে।

প্রয়াত লেখক সৈয়দ শামসুল হক 'মার্জিনে মন্তব্য' বইয়ে লিখেছেন, 'আপনি কী লিখবেন সেটি জরুরি। কিন্তু কী লিখবেন না, সেটি আরও জরুরি।' সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে কথাটি শত ভাগ সত্য। আমরা ফেসবুকে যা খুশি তা-ই লিখে দেওয়াকে বাক স্বাধীনতা বলে মনে করি। কী লিখলে আমার ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ন হয়; আমার সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়; মানুষের কাছে হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হই—সেটি অনেক সময়ই ভাবনায় থাকে না। অন্যের সম্পর্কে বিষোদগার; ভিন্নমতের মানুষকে গালি দেওয়া; সম্মিলিতভাবে আক্রমণ ইত্যাদি প্রবণতাও যে হারে বেড়েছে, সেখানে সৈয়দ হকের ওই কথাটি এখন অধিকতর প্রযোজ্য যে, আপনি কী লিখবেন সেটি যতটা না জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি কী লিখবেন না।

একইভাবে আপনি যখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকবেন, তখন কোনো কিছু বলার আগে ৩ বার ভাবতে হবে কথাটি বলা ঠিক হচ্ছে কি না। অর্থাৎ আপনি কী বলবেন সেটি যেমন জরুরি; তেমনি কী বলবেন না, সেটি আরও জরুরি। ওই গানের মতোই, আপনার দুটি চোখ, দুটি কান; সবই দেখবেন, শুনবেন; কিন্তু মুখ যেহেতু একটা, অতএব কথা কম বলবেন। এমন কথা বলা উচিত হবে না যা আপনার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়। যা মানুষের সামনে আপনাকে ছোট করে। এমন কথা বলা উচিত হবে না যে কথার জন্য আপনাকে অনুতপ্ত হতে হয় কিংবা সকালে বলে বিকেলেই সেই কথা প্রত্যাহার করতে হয়।

সবার জিহ্বা থেকে সবাই নিরাপদ থাকুক।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

1d ago