নির্বাচন কমিশন গঠন

আ. লীগের রাজনৈতিক দৈন্যতা না নিছকই কৌশল?

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর একটা আইন করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন রাষ্ট্রপতি। সাবেক সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্বও নিয়েছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর একটা আইন করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন রাষ্ট্রপতি। সাবেক সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্বও নিয়েছে।

নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে এখনই কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। কমিশনের কাজেই কমিশন ভবিষ্যতে মূল্যায়িত হবে।

এখন আসুন আমরা সার্চ কমিটির নাম চাওয়া, দল এবং বিভিন্ন সংগঠনের এবং ব্যক্তিবিশেষের নাম প্রস্তাব করা, সার্চ কমিটির সিলেকশন, রাষ্ট্রপতির সিলেকশন এবং সর্বপরি নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।

সার্চ কমিটির আহ্বানের সাড়া দেয়নি বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল। তারা কোনো নাম প্রস্তাব করেনি সার্চ কমিটির কাছে। এমনকি ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপেও অংশ নেয়নি দলগুলো।

অন্যদিকে নাম প্রস্তাব করা দলগুলোর মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি), গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) এবং অন্যান্য কয়েকটি ছোট দল।

এ ছাড়াও কিছু সংগঠন এবং ব্যক্তি উদ্যোগে সার্চ কমিটির কাছে ইসি গঠনে নামের সুপারিশ করে।

অনুসন্ধান কমিটিতে মোট ৩২২ জনের নাম প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল থেকে আসে ১৩৬ জনের নাম, বাকি নামগুলো পেশাজীবী সংগঠন, বিশিষ্ট নাগরিকদের ব্যক্তি উদ্যোগে পাঠানো।

সার্চ কমিটি ৩২২ জনের নাম প্রকাশ করলেও তারা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাবিত ১০ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেনি। অনেক দল তাদের প্রস্তাবিত নামের তালিকা প্রকাশ করেনি। অন্যদিকে কয়েকটি দল তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে।

সার্চ কমিটি নাম প্রস্তাব করার ২ দিন পর ২৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করেন।

১ দিন পরেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিবৃতির মাধ্যমে নতুন ইসিকে স্বাগত জানান। পাশাপাশি তিনি বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগের তালিকা থেকে কেউ ইসিতে স্থান পাননি।

সংসদে বড় প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় পার্টি, ওয়াকার্স পার্টি, জাসদ, বিকল্পধারা বাংলাদেশ থেকেও প্রস্তাবিত কোনো নাম বর্তমান ইসিতে স্থান পায়নি।

আসুন দেখা যাক কোন রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির প্রস্তাবিত তালিকা থেকে নাম নিয়ে ইসি গঠিত হলো।

এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করতে হবে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের নাম।

২০১৭ সালে সার্চ কমিটিকে দেওয়া তরিকত ফেডারেশনের প্রস্তাবে সিইসি হিসেবে নুরুল হুদা এবং কমিশনার হিসেবে সাবেক সচিব মো. রফিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী, সাবেক সচিব আলী কবির এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক জিনাতের নাম ছিল।

যাদের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ৩ জনকে নতুন ইসিতে নিয়োগ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি।

এবারও তরিকতের প্রস্তাবিত ১০ নামের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ আরও একজন নিয়োগ পেয়েছেন ইসিতে।

এ ছাড়াও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, বাসদ-বিএসডি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) থেকেও প্রস্তাবিত নাম এসেছে নবগঠিত ইসিতে।

এদের মধ্যে তরিকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি) এবং গণতন্ত্রী পার্টি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটের অংশীদার।

২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রস্তাবিত তালিকায় ছিল না প্রধান নির্বাচন কমিশনার একেএম নুরুল হুদার নাম। প্রধান ২ দলের প্রস্তাবিত নাম থেকে একজন করে কমিশনার নিয়োগ পান।

২০১৭ সালেও ইসি গঠনে প্রাধান্য পেয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটভুক্ত শরিক দলগুলোর প্রস্তাবিত নাম।

এখন একটু দেখা যাক বর্তমান সংসদে কোন দলের প্রতিনিধিত্ব কেমন।

৩৫০ আসন বিশিষ্ট সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আছে ৩০২ জন সংসদ সদস্য, প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির আছে ২৬ জন, বিএনপির ৭ জন, ওয়াকার্স পার্টির ৪ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ২ জন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের ২ জন, গণফোরামের ২ জন। এ ছাড়া তরিকত ফেডারেশন এবং জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) একজন করে সংসদ সদস্য আছেন।

আরেকটা উল্লেখ করার বিষয় হলো, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ব্যক্তি উদ্যোগে প্রস্তাবিত ৮ জনের নামের তালিকার সর্বশেষ নামটি ছিল কাজী হাবিবুল আউয়াল।

ইসি গঠনের পর নির্বাচন কমিশনকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন তিনি। নিজের প্রস্তাবিত নাম থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়ায় সরকারকেও স্বাগত জানিয়েছেন তিনি।

বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করা কিংবা নতুন ইসিকে স্বাগত জানানোতে খুশি হয়নি বিএনপি।

সম্প্রতি জানা গেছে বিএনপির হাইকমান্ড জাফরুল্লাহকে বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএনপির কোনো অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ না জানানো এবং তিনি কোনো অনুষ্ঠানে থাকলে সেখানে নেতাকর্মীদের না যেতে মৌখিক নির্দেশ দিয়েছে দলটি।

শুধু বিএনপির সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া নয়, জাফরুল্লাহর এই উদ্যোগ আওয়ামী লীগকেও একটা রাজনৈতিক মাইলেজ দিয়েছে।

কারণ সার্চ কমিটির নাম প্রস্তাবের পর পরই দলটির নেতারা দাবি করেছিল, নির্বাচন কমিশন গঠনে বিএনপি সার্চ কমিটিতে নাম প্রস্তাব না করলেও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যে নাম দিয়েছেন, সেটাই বিএনপির নাম।

শুধু নাম প্রস্তাবই নয়, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রস্তাবিত নাম সিইসি হয়েছে, এটা সামনের দিনে নিশ্চই ঘটা করে বলবে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।

এখন একটু দেখে নেওয়া যাক সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে কতটা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে, রাষ্ট্রপতি কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।

সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ইসি গঠনের আগে নিশ্চই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তার দল প্রস্তাবিত কাউকে নির্বাচন কমিশনে রাখার পরামর্শ দেননি?

নিজের দলের প্রস্তাবিত নাম বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কি ছোট ছোট রাজনৈতিক দল, যাদের না রাজপথে, না সংসদে তেমন কোনো প্রতিনিধিত্ব আছে বা যাদের জনভিত্তি নেই, তাদের নাম বাছাই করার পরামর্শ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতিকে?

নাকি প্রধানমন্ত্রী কোনো পরামর্শ না দিয়েই রাষ্ট্রপতির ওপর পুরো সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন? তাহলে এটাকে তো প্রধানমন্ত্রী উদারতা বলেতেই হবে।

সঙ্গত কারণে অন্য একটা প্রশ্নও উঠতে পারে। দেশের প্রাচীনতম এবং স্বাধীনতা সংগ্রামসহ অন্যান্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া দলটি কি এমন একটিও যোগ্য নাম প্রস্তাব করতে পারেনি, যেখান থেকে একজনকে নিয়োগ দিতে পারলেন না রাষ্ট্রপতি।

২০১৭ সালেও তো একই ঘটনাই ঘটেছিল। তাহলে তো বর্তমানে দলটির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

নাকি আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতের সমালোচনা এড়াতে এই কৌশল নিয়েছে? তাদের তালিকা থেকে কেউ ইসিতে আসলে দলটিকে আরও সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে এটা ভেবে কি আওয়ামী লীগ সমমনা বা সরকারঘেঁষা অন্য ছোট দল দিয়ে তাদের পছন্দের নাম প্রস্তাব করিয়েছে? যদি সেটা হয়ে থাকে তবে সেটা হবে আপৎকালীন কৌশল।

তাহলে নির্বাচন কমিশন গঠনের পুরো প্রক্রিয়াটি ক্ষমতাসীন দলটির নিছকই রাজনৈতিক কৌশল না রাজনৈতিক দৈন্যতা ?

Comments

The Daily Star  | English

Foreign airlines’ $323m stuck in Bangladesh

The amount of foreign airlines’ money stuck in Bangladesh has increased to $323 million from $214 million in less than a year, according to the International Air Transport Association (IATA).

11h ago