একটি হবুচন্দ্রীয় আইনের খসড়া ও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক

ইতিহাসে থাকুক বা নাই থাকুক, গল্পে তো আছে! আর কে না জানে যে কখনো কখনো গল্পের কাহিনী ইতিহাসের চেয়েও বেশি গণ-মননকে নাড়া দেয়।

ইতিহাসে থাকুক বা নাই থাকুক, গল্পে তো আছে! আর কে না জানে যে কখনো কখনো গল্পের কাহিনী ইতিহাসের চেয়েও বেশি গণ-মননকে নাড়া দেয়।

এমনই এক গল্প রাজা হবু চন্দ্র আর তার মন্ত্রী গবু চন্দ্রের। আমাদের এই বঙ্গদেশের ঢাকার অদূরস্থ সাভারে জন্ম নেওয়া প্রখ্যাত লোকসাহিত্যিক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের বদৌলতে এ দেশের মানুষ অনেক আগে থেকেই হবুচন্দ্রের সঙ্গে পরিচিত। অবশ্য তারও আগে বঙ্কিমচন্দ্র এবং পরে রবীন্দ্রনাথও তাদের সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করার জন্য হবুচন্দ্রের দ্বারস্থ হয়েছেন।

তবে এ ক্ষেত্রে আমার প্রজন্মের (ষাটোর্ধ বয়সের) মানুষ মনে হয় হবুচন্দ্র সম্ভারের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হয়েছেন বিক্রমপুরের কবি সুনির্মল বসুর সেই বিখ্যাত কবিতাটির মাধ্যমে। 'হবুচন্দ্র রাজা কহেন গবুচন্দ্র ডেকে/ আইন জারী করে দাও রাজ্যেতে আজ থেকে/ কাঁদতে কেহ পারবে নাকো যতই মরুক শোকে/ হাসবে আমার যতেক প্রজা হাসবে যত লোকে।'

সুনির্মল বসুর কবিতাটির কথা ভুলতেই বসেছিলাম। কিন্তু সম্প্রতি খবরের কাগজে একটা খবর দেখে প্রায় ৬ দশক আগের পড়া কবিতাটি মনে পড়ল।

গত ১৭ এপ্রিল বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, ভবিষ্যতে ফেসবুকে 'আজ আমার মন খারাপ' এমন স্ট্যাটাস দিলেও আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য সরকার আইন করতে যাচ্ছে। খবরে আরও বলা হয়েছে, 'ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্লাটফর্মে'র জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন নতুন যে বিধিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে তাতে এ ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে।

অর্থাৎ, সরকার চায় দেশের সব মানুষ হাসিখুশি থাকুক। কোনো অবস্থাতেই কেউ মন খারাপ করতে পারবে না। হোক তা প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে বিচ্ছেদ কিংবা আপনজনের লোকান্তরগমন! কোথায় যেন শুনেছিলাম, হাসলে হৃদযন্ত্রের ব্যায়াম হয়। আমাদের সরকার মনে হয় সেই সূত্র ধরেই এগুচ্ছে। তাই যত কষ্টই থাকুক, সবাইকে হাসতে হবে। মন খারাপ করলে চলবে না।

গল্পের রাজা হবুচন্দ্র তার দেশকে খুব ভালোবাসতেন। তাই তো তিনি চাইতেন, সারা বিশ্বে তার দেশের সুনাম হোক এই বলে যে—তার দেশের সবাই সুখী। আমাদের কর্তাব্যক্তিরাও দেশকে ভালোবাসেন। তারাও চান দেশের সুনাম হোক। কেউ যেন বলতে না পারে যে এই দেশে কারো মন খারাপের অসুখ আছে। তাই তো তারা এমন একটা আইন তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছেন। তবে জানি না তারা হবুচন্দ্র দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই এমন একটা আইন তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছেন কিনা।

এ দিকে, সারা দেশ যখন তেল নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ডের মাঝেও ঈদ উদযাপনে ব্যস্ত, তখনই রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডার (আরএসএফ) বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে তাদের ২০২২ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

তাতে দেখা যায়, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের ১০ ধাপ অবনমন ঘটেছে। বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় ১০ ধাপ পিছিয়ে ১৮০ দেশের মধ্যে ১৬২তম স্থান দখল করেছে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র মিয়ানমার ছাড়া সব দেশই, এমনকি আফগানিস্তানও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের উপরে রয়েছে।

উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্রতি বছর ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করা হয়। সেই সূত্রেই প্যারিসভিত্তিক আরএসএফ প্রতি বছর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

২০২২ সালের জন্য দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল 'ডিজিটাল অবরোধে সাংবাদিকতা' (জার্নালিজম আন্ডার ডিজিটাল সিজ)। বিশ্বাস করতে পারি, আরএসএফ বিভিন্ন দেশের এ সংক্রান্ত তথ্যাদি যাচাই-বাছাই করেই তাদের সূচক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে 'ডিজিটাল' শব্দটা উচ্চারণ করলেই যে একধরনের আতঙ্কে মানুষ শিউরে ওঠে, তা তারা কতটুকু বিবেচনায় নিয়েছে তা আমার জানা নেই।

২০১৮ সারের নির্বাচনের আগে সরকার যখন এই দেশে 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' নামে নতুন আইনটি করে, তখন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এর পক্ষে যা-ই বলে থাকুন না কেন, জনগণের কাছে যে এটি বিরোধী মত দমনের এক নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা বলেই খ্যাতি অর্জন করেছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। তাই, ইউনেস্কোর এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টি যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক তা বলাই বাহুল্য।

ঘটনাক্রমে এবারের প্রতিবেদন প্রকাশের দিনটির সঙ্গে বাংলাদেশে ঈদ উদযাপনের দিনটিও মিলে গেছে। হতে পারে এটি নিতান্তই কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু ধীমান ব্যক্তিদের জন্য এই খবরটি কিছুটা হলেও যে 'মন খারাপের' কারণ হতে পারে, তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু তারপরও বলা যাবে না, মন খারাপ। বললেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধরা খেতে হবে।

তাই আসুন, সবাই আমরা হাসি। হাসতে হাসতে বলি, আমার মন খুব ভালো। মনে রাখবেন গবুচন্দ্ররা আশপাশেই আছে এবং সবসময় আশপাশেই থাকে।

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা

[email protected]

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

49m ago