লাশের স্তুপে শীতঘুমের বিলাসিতা

এদেশে প্রতিটি বড় দুর্ঘটনার পর একটা প্যাটার্ন দাঁড়িয়ে গেছে। বড় কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসবেন। উচ্চবাচ্য করবেন। একটা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করবেন। এর কিছু দিন পর হয় তদন্ত কমিটি হারিয়ে যাবে নতুবা তারা দুর্ঘটনার পেছনে দায়ীদের খুঁজে পাবেন না। নিমতলি, চকবাজার ট্রাজেডি থেকে শুরু করে তাজরিন, রানাপ্লাজা হয়ে সর্বশেষ সীতাকুণ্ড — মোটামুটি এ পদ্ধতিতে আমাদের দেশে দায়মুক্তি দেওয়ার একটা শক্তিশালী সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে। তদারকি সংস্থা ও প্রভাবশালীরা যারা আইন ভাঙাকে পৃথিবীর অন্যতম সহজ কাজে পরিণত করেছেন তারা এভাবে এসব হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন। মুক্তি দেওয়ার এ সংস্কৃতি তাদেরকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। আইন প্রয়োগ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের ইচ্ছাধীন বিষয়।

বাস-ট্রাক-লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর আমরা জানতে পারব এগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। জানতে পারব লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হয়েছে, নকশায় ত্রুটি ছিল। দুর্ঘটনার আগে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে কর্মকর্তাদের দেখভালের দায়িত্ব তাদের অবহেলার বিষয়টি সামনে আসবে না। আসলেও তাদের মৃদু শাস্তি হবে।

সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের আগে বিস্ফোরক অধিদপ্তর কেন জানতে পারল না যে এদের লাইসেন্স নেই, এখানে রাসায়নিক পদার্থ মজুদ করা হয়। দেশে কি পরিমাণ রাসায়নিক পণ্য আমদানি হয়, কি পরিমাণ উৎপাদিত হয়, কারা বা কোন প্রতিষ্ঠান এগুলোর ক্রেতা, এসব তথ্য কেন বিস্ফোরক অধিদপ্তরে থাকবে না? কেন রাসায়নিক পদার্থ মজুদের স্থানগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করা হয় না? কোন অদৃশ্য শক্তিবলে এসব গুদাম বা কারখানাকে আইন মানতে বাধ্য করা হয় না? সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য প্রতি মাসে বেতন ও নানা সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পরও এসব কর্মকর্তারা কিসের বলে, কাদের আশির্বাদে দিনের পর দিন দায়িত্ব পালন না করেও বহাল তবিয়তে টিকে থাকতে পারছে, সে প্রশ্নের উত্তর নেওয়ার সময় এসেছে।

সরকার কি একটা উদাহরণ দেখাতে পারবে যেখানে তারা দায়িত্বপালনে অবহেলা, ব্যর্থতার দায়ে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। নিমতলি ট্রাজেডি, চকবাজার ট্রাজেডি, তাজরিন গার্মেন্টস, রানাপ্লাজা, সাম্প্রতিক লঞ্চডুবি — এসব ঘটনায় কোনো কর্মকর্তা শাস্তি পেয়েছে? বার বার আগুন লেগে শত শত মানুষ মারা যাওয়ার পরও পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরকার সরাতে পারেনি। কোন জায়গায় সরকার ব্যর্থ হয়, কোন জায়গায় সফল হয় সেটার তালিকা করলে দেখা যাবে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যেটাকে তার স্বার্থের জন্য প্রয়োজন মনে করেছে সেখানে সফল হয়েছে। যেটাতে তারা ভেবেছে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে সফল হওয়ার কোনো চেষ্টা আমরা দেখি না।

সরকারের এক মন্ত্রী সীতাকুণ্ডে গিয়ে বললেন এ বিস্ফোরণের পেছনে কোনো নাশকতা আছে কি না খতিয়ে দেখবেন। একবারও বললেন না এখানে রাসায়নিক মজুদ করার যে নীতিমালা বা আইন সেটা মানা হয়েছে কি না সেটা খতিয়ে দেখবেন। কেন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিপজ্জনক পদার্থ মজুদ করা হলো, কেন ও কীভাবে বিশেষ স্থাপনা নির্মাণ ছাড়া, অগ্নিনিরাপত্তা ছাড়া তথ্য গোপন করে রাসায়নিক পদার্থ মজুদ করা হলো সে বিষয়ে খতিয়ে দেখতে একবারও বললেন না।

বিস্ফোরক অধিদপ্তর বলছে এ ধরনের পদার্থ মজুদ করার তথ্য তাদের কাছ থেকে গোপন করেছে বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ। এমনকি এখানে যে রাসায়নিক পদার্থ আছে সেটাও অগ্নিনির্বাপন কর্মীদের কাছে গোপন করা হয়েছে।

স্মার্ট গ্রুপের মালিক মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদমাধ্যমে রাগ করে বলছেন যে আগুন তারা নিজেরা লাগাননি। আগুন আপনারা লাগাননি মানলাম। কিন্তু আগুন লাগলে মানুষ যাতে না মরে, নিরাপদে বের হয়ে আসতে পারে, সে জন্য আপনারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন জাতিকে তার উত্তর দেন। রাসায়নিক পদার্থ রাখার তথ্য কেন গোপন করলেন তার জবাব দেন। কেন দমকলকর্মীদের জানালেন না যে ওখানে রাসায়নিক পদার্থ আছে সেই উত্তর দেন।

লাশের বিনিময়ে যে সরকারি কর্মকর্তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, যে মালিকরা হাজার কোটি টাকার মুনাফা করছেন, সে লাশ একদিন জীবন্ত হয়ে ফিরে আসবে। লাশের স্তুপে আপনাদের যে শীতঘুমের বিলাসিতা তা খুব শিগগির ভাঙবে।

তথ্য গোপন করে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে রাসায়নিক দ্রব্য মজুদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিস্ফোরক অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বলছে ওখানে যে রাসায়নিক বা বিপদজনক পদার্থ রাখা হচ্ছে সে সম্পর্কে তাদের কিছু জানানো হয়নি। অন্যদিকে বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিক মুজিবর রহমানের দাবি তিনি যথাযথ সকল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েছেন রাসায়নিক মজুদের জন্য।

মোস্তফা ইউসুফ: সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English
IMF World Bank Spring Meetings 2025

IMF-World Bank meetings end with little tariff clarity, but economic foreboding

Many participants in the Spring Meetings had a sense that Trump's admin was still conflicted in its demands from trading partners

1h ago