‘সোয়ামি একটা থাকা লাগে তাই তারও আছে!’

২৭ বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে ছোট শিশুসন্তানসহ পরিবারকে রেখে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন জহর উদ্দিন ওরফে বাচ্চু। ১ মাস আগে হঠাৎ পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন তিনি। কুড়িগ্রামের এই কৃষক আকস্মিকভাবে বাড়িতে ফিরে আসায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে পরিবার ও প্রতিবেশী। তারা তাকে বীরের সম্মান দিয়ে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছে।

২৭ বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে ছোট শিশুসন্তানসহ পরিবারকে রেখে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন জহর উদ্দিন ওরফে বাচ্চু। ১ মাস আগে হঠাৎ পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন তিনি। কুড়িগ্রামের এই কৃষক আকস্মিকভাবে বাড়িতে ফিরে আসায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে পরিবার ও প্রতিবেশী। তারা তাকে বীরের সম্মান দিয়ে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছে।

বাহ, কী চমৎকার অভ্যর্থনা। এতদিন এই মানুষটি হাওয়া হয়ে থেকে ফিরে এসে যে কাহিনী বলেছেন, সবাই তা বিশ্বাস করেছেন।

জহির উদ্দিনের স্ত্রী জাহেদা বেগমও বেজায় খুশি। যদিও তিনি ২৭টি বছর ধরে ভিক্ষা করে, মানুষের বাড়িতে কাজ করে একমাত্র সন্তানকে বড় করেছেন। তিনি আশায় ছিলেন, তার স্বামী একদিন ফিরে আসবে। ছেলের দিকে তাকিয়ে অন্য কোথাও বিয়েও করেননি।

জহিরকে গ্রামবাসী ও তার স্ত্রী মেনে নিয়েছেন, তাতে আমাদের আপত্তির কিছু নেই। শুধু জানতে ইচ্ছা করছে, তার স্ত্রী জাহেদা বেগম যদি এইভাবে ২৭ বছর পর বা ২৭ দিন বা ২৭ ঘণ্টা পর ফিরে আসতো, তবে কি তার স্বামী বা সমাজ ঠিক এইভাবেই তাকে বরণ করতো? এইভাবে বরণ করাতো দূরের কথা, গ্রহণই করতো না। বরং জাহেদার চরিত্র নিয়ে নানান ধরণের আজেবাজে কথা বলতো। আর স্বামীও সময় নষ্ট না করে ইতোমধ্যে বিয়ে করে ফেলতো।

এটাই হচ্ছে আমাদের সমাজের ছবি। অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই, দুঃখ পাওয়ারও কিছু নেই। এখানে পুরুষ স্বাধীন, বহির্মুখী, ক্ষমতাধর, চরিত্রবান এবং চির বীর। নারী এভাবেই পুরুষকে মেনে নিয়েছে, সমাজও তাই। নিয়ম শুধু নারীর জন্য, লজ্জাও নারীর একার এবং পরাধীন শুধু নারী।

এই ঘটনার কথা পত্রিকায় পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. গীতিয়ারা নাসরিন তার ফেসবুক পেজে যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তা অসাধারণ। আপা বেশ আগের এক গবেষণার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, একজন নারীকে তার বৈবাহিক অবস্থা জিজ্ঞাসা করায়, একজন পোশাক কর্মী বলেছিলেন, তার একজন 'সোয়ামি' আছে। আর 'সোয়ামি একটা থাকা লাগে তাই তারও আছে!'

আপা লিখেছেন, জহির উদ্দিনকে কোনো দায়িত্ব পালন না করে ২৭ বছর পর ফেরায় জুতানো হচ্ছে না কেন—এমন প্রশ্ন অনেকে জিজ্ঞাসা করছেন। তার উত্তর হচ্ছে এই—একটা থাকা লাগে। একা সন্তান মানুষ করার পরেও 'সোয়ামি' না থাকার জন্য সমাজে একটি মেয়ের যা সহ্য করতে হয়, তার জন্য একটা কাকতাড়ুয়া স্বামীর দরকার হয়। পার্থক্য এই যে, এইসব কাকতাড়ুয়াকে শুধু খাওয়াতে, পরাতেই হয় না, তাদের গাল-মন্দ শোনা, মার খাওয়া ও সব ধরণের সেবাও করতে হয়।

বহুদিন ধরেই বাংলাদেশে উপার্জনকারী নারী শুধু নয়, সংসারের মুখ্য উপার্জনকারী হিসেবে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে, 'ভাত দেওয়ার মুরোদ নাই, কিল দেওয়ার গোঁসাই'রা যে সমাজে আগে থেকেই আছেন, এই প্রবাদের অস্তিত্বই প্রমাণ করে এবং এইসব 'সোয়ামি'দের কথাই জানান দেয়। অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটলেই নারীর মুক্তি ঘটবে, এটা যে কত বড় মিথ্যা কথা তা বহু আগে থেকেই অনেক নারী জানেন। শুধু তত্ত্ব দিয়ে নয়, জীবন দিয়ে জানেন পিতৃতন্ত্র কী।

আমাদের দেশে, এই ঢাকা মহানগরীতেও একজন চাকরিজীবি একক নারী কলেজে পড়ুয়া সন্তানসহ থাকবেন, তাও বাড়িভাড়া পান না। তাকে অফিস থেকে চরিত্রগত সনদ নিয়ে বাড়িভাড়া নিতে হয়। নারী অফিসের কাজে স্টেশন ত্যাগ করলে এখনো অনেক পরিবারই বিষয়টি সহজভাবে নেয় না। কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পর শুনতে হয়, কী করে এলে? কে গিয়েছিল সঙ্গে? ইত্যাদি প্রশ্ন। যাক এসব কথা, এগুলো নতুন কিছু নয়।

নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, বিভিন্ন খাতে নারীর চাকরির হার বেড়েছে, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর প্রাধান্য লক্ষণীয়, রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব চোখে পড়ার মতো, দেশের সার্বিক এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে নারীর ভূমিকার কথা গুরুত্ব দিয়ে বলা হচ্ছে। গ্রাম বা শহর সবখানেই কাগজে-কলমে নারীর এগিয়ে যাওয়া চোখে পড়ার মতো।

আজকের দিনে অনেক নারীই ট্র্যাডিশনাল কাজের বাইরে নানান ধরণের কাজের সঙ্গে জড়িত। তারা পুলিশ, সেনাবাহিনী, উড়োজাহাজ চালনা, গাড়ি চালানো, পর্বতারোহণ, সাংবাদিকতা, বিজ্ঞানী, ফুটবলার, ক্রিকেটার, রেফারি, গ্লাইডার, সার্ফার ইত্যাদি। কিন্তু তারপরও সিংহভাগ নারীকে কারো না কারো 'কেয়ারঅফে' থাকতে হয়। মোটামুটি সবাইকে মানতে হয় 'সোয়ামি একটা থাকা লাগে, তাই তারও আছে'।

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে নারীর সার্বিক উন্নতি হলেও এই একটা জায়গায় এসে যেন স্থবির হয়ে আছি আমরা। সেখানে জাহেদা বেগমও যা, অনেক শিক্ষিত নারীরও তা। সবসময়ই তাকে অন্যের পরিচয়ে বাঁচতে হয়। বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধ, নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে পড়ে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। যার কারণে অনেক নারী প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়িত হতেই পারেন না। নারী যতই যুদ্ধ করে এগিয়ে যাক না কেন, সমাজ তাকে পেছন থেকে টেনে রাখে।

অথচ ভারতের ইতিহাস অন্য কথা বলে। সেদিন এক লেখায় পড়লাম ভারতবর্ষে পশ্চিমা আক্রমণের আগে (২৫০০ বছর আগে) নারী-পুরুষ সমঅধিকার ছিল। দক্ষিণ ভারতে যতগুলো পুরুষ দেবতার মন্দির ছিল, ততগুলোই নারী দেবতার মন্দির ছিল। পরে নারীদেরগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। তখন ধর্ম ছিল শিক্ষা ও জ্ঞানের অংশ। পরে বিদেশি আক্রমণ ধর্মকে করেছে রাজার দোসর বা হাতিয়ার। যার শুরু হয়েছে রোমান ইংল্যান্ড থেকে।

এতগুলো বছর পরে সেইসব দেশে নারীর একটা পরিচয় তৈরি হলেও ভারত কিংবা বাংলাদেশে হয়নি। নারীর একটি নাম থাকার পরও স্বামীর নামের বা পদবীর সঙ্গে ভাবি যোগ করে ডাকা হয়। আবার একথাও সত্য যে নারী যেমন স্বামীর পরিচয়ে পরিচিত হতে গর্ববোধ করেন, অধিকাংশ পুরুষই তা করেন না। বরং লজ্জাবোধ করেন। আর সেই কারণেই বহু স্বামী চান না স্ত্রীর অর্জন তার থেকে বেশি হোক। সমাজ নারীর মর্যাদাবোধটাকে জাগ্রত হতে দেয় না। বড় হতে দেয় না তার অহংবোধকে। আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি না হলে একজন নারীর পক্ষে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আরও কঠিন।

কীভাবে নারীর অহংবোধকে ধ্বংস করা হয় তা আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করি। কারণ এই অহংবোধকে সরিয়ে দিতে পারলে নারীকে 'কেয়ারঅফে' রাখা সুবিধা হয়। একজন নারী চিকিৎসককে দেখেছি কীভাবে ডাক্তারি বিদ্যা ভুলে পুরোপুরি স্বামীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেল। দেখেছি ৩০ বছর আগে বেক্সিমকো গ্রুপের বড় পদে চাকরিরত আরেক নারীকে 'স্বামী চায় না' বলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে গৃহবন্দি এবং স্বামীর হাতেই দিনের পর দিন নিপীড়িত হতে। চলমান ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলো নাহিদ। কারণ স্বামীর পরিবার চায় না। অফিস থেকে দেশের ও ঢাকার বাইরে মাঝে মাঝে যেতে হয় বলে আরেকটি ব্রাইট মেয়েকে এনজিও থেকে ভালো চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে। এমনকি বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করতে হয়েছে মিতাকে, কারণ শ্বশুরবাড়ি রাজী নয়। এ রকম আরও অসংখ্য উদাহরণ শহরে ও গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু একজন পুরুষকে স্ত্রী বা সংসারের বা শ্বশুরবাড়ির কথা শুনে নিজের কাজ বা পড়াশোনাকে বলি দিতে শুনেছেন কেউ? ভারসাম্যের জন্য অগণিত নারীর পাশে অন্তত ২/৪টা পুরুষের উদাহরণ থাকা প্রয়োজন।

নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার খাটুরিয়া গ্রামের এক নারীর গল্প দিয়ে লেখা শেষ করতে চাই। যে নারীর সামাজিক অবস্থান জহির উদ্দিনের স্ত্রী জাহেদা বেগমের মতো হলেও, তিনি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন। যিনি কোনো শিক্ষাদীক্ষা ছাড়াই শুধু আত্মমর্যাদাবোধ দিয়েই জয় করেছেন তার প্রতিকূলতাকে। সেই নারীর নাম চেপ্টি। আমার মতো অনেকের কাছে চেপ্টি আইডল হতে পারেন। গ্রামে গিয়ে দেখা হলো চেপ্টির স্বামীর সঙ্গে। বেজায় মন খারাপ তার, স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগও বিস্তর।

রংপুরের ভাষায় বললো, 'ওমরালা মোক আর সোয়ামি হিসাবে গ্রাহ্যি কারেনা, মান্যিগন্যিও কারেনা, নামাজ-ওজা নাই। মায়াছইল বেটাছেলের নাকান কাম কাইজ করে, বেটা ছেলের নাকান চলাফিরাও করে। ট্যাকা কামাই কারে বলে ওমরালার কাছোত বড়-ছোট কোনো দিগজ্ঞান নাই। মাইয়া ছাওয়াল হইছে কিন্তুক কোনো পর্দা পুসিদা নাই।' কথা বলে বুঝলাম স্ত্রীর এই বাইরে কাজ করা এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা চেপ্টির স্বামীর পছন্দ হয়নি।

চেপ্টির কাছে জানতে চাইলাম, সে কেন স্বামীর কথা শোনে না? চেপ্টি পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, 'মোর কাছোত কাম আগত। খায়া দায়া, ছেলে ছোট নিয়া নিজে বাঁচিম, নাকি ওমারলার কথা শুনি ঘরত সেন্দে থাকিম? মুই একটা মাইনসি, মুই ক্যানে কাম কারিম না? মোর বাঁচার জন্যই কাম আগত। খালি বকতিমা দিবার তানে সোয়ামি নাগে না হামার।'

শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Will there be any respite from inflation?

To many, especially salaried and fixed-income individuals, this means they will have no option but to find ways to cut expenditures to bear increased electricity bills.

5h ago