বিসিএস কেন চাকরি প্রার্থীদের পছন্দের শীর্ষে

পড়ালেখার বিষয় যাই হোক না কেন, ক্যারিয়ার গড়তে বিসিএস বা সরকারি চাকরিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী।

পড়ালেখার বিষয় যাই হোক না কেন, ক্যারিয়ার গড়তে বিসিএস বা সরকারি চাকরিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী।

শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা বিসিএসের পেছনে ছুটছেন তাই না প্রকৌশল বা মেডিকেল কলেজের অনেক শিক্ষার্থীও এখন ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ হতে চাচ্ছেন।

দীর্ঘদিনের পড়ালেখার বিষয় ছেড়ে শিক্ষার্থীরা কেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের পেশায় যেতে চাচ্ছেন? সাধারণ শিক্ষার্থীরাই বা কেন বিসিএস বা সরকারি চাকরিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বিভিন্ন মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন তাদের আগ্রহের কারণ।

সম্মান-মর্যাদা-ক্ষমতা সবই বিসিএস ক্যাডারে

গত ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হলো ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। এই বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৮১৪ জনকে নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আবেদন করেন ৪ লাখ ৪২ হাজার ৮৩২ জন।

সব কিছু ছেড়ে শুধু বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য একটানা ৪ থেকে ৫ বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন বহু শিক্ষার্থী।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রকৌশল ও মেডিকেলের অনেক শিক্ষার্থীও মনে করছেন বিসিএস ক্যাডারে, বিশেষ করে পররাষ্ট্র, প্রশাসন বা পুলিশের মতো ক্যাডারে যোগ দিলে চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়ার চেয়ে বেশি সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা পাওয়া যায়। এ কারণে তারা নিজেদের পড়ালেখার বিষয় ছেড়ে পুলিশ বা প্রশাসন ক্যাডারের দিকে ঝুঁকছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করে ইন্টার্নশিপ করার পাশাপাশি বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ফেরদৌস রায়হান সৈকত। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশে থেকে ভালো কিছু করতে হলে বিসিএস এখানে বেস্ট অপশন। এমনকি বুয়েটের শিক্ষার্থীদের কথাও বলা যায়, সেখানকার অধিকাংশ শিক্ষার্থী দেশের বাইরে চলে যান। যারা এখন দেশে থাকেন তারাও নিজেদের পেশায় যথেষ্ট সম্ভাবনা না দেখে পররাষ্ট্র বা প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিতে চাচ্ছেন বা দিচ্ছেন।'

সৈকত আরও বলেন, 'আমি যেহেতু দেশে থাকতে চাই। তাই বিসিএস ক্যাডারই আমার জন্য সবচেয়ে ভালো সুযোগ বলে মনে করি। তাছাড়া, দেশের সেবা করতে হলে আমি যে শুধু চিকিৎসা দিয়ে করতে পারব তা না। অন্য কোনো ক্যাডার সার্ভিসের মাধ্যমেও সেটা করা যাবে।'

বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ালেখা শেষ করে নিজের সেক্টরে পাওয়া চাকরি ছেড়ে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন মারুফ। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়েছি। দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে জবও করেছি কিছুদিন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তারপরও আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে খুব বেশি উন্নতি করা সম্ভব না। তাই পররাষ্ট্র ক্যাডারের জন্য চেষ্টা করছি। দেশে ক্যাডার সার্ভিসের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা আছে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পরিসংখ্যান বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করে বিসিএসের জন্য চেষ্টা করছেন আজিজুল হক। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে বিসিএস ক্যাডাররাই দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সবারইতো স্বপ্ন থাকে একটা জায়গায় পৌঁছে নেতৃত্ব দেওয়ার। সেই হিসেবে বিসিএস ক্যাডার হতে পারলে আমি জনগণের জন্য কাজ করতে পারব।'

ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ হওয়ার ইচ্ছা বেশিরভাগ চাকরি প্রার্থীর

প্রতিবছর ক্যাডার সার্ভিসে যত নিয়োগ দেওয়া হয় তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিয়োগ হয় প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে। সর্বশেষ ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে ছিল ৩০০ জন, পুলিশ ক্যাডারে ১০০ জন ও পররাষ্ট্র ক্যাডারে ২৫ জন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।

চাকরি প্রার্থীদের আগ্রহের শীর্ষে আছে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডার। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ডেন্টিস্ট্রি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. কামরুজ্জামান তুহিন সেই লক্ষেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার পছন্দের ক্যাডার প্রশাসন। মেডিকেল কলেজে পড়ালেখা করে প্রশাসন ক্যাডারে কেন চাকরি করতে চান, জানতে চাইলে তুহিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণভাবে বললে, একজন ডাক্তার এত বছর কষ্ট করে পড়ালেখার পর দেখা যায় তার প্রমোশনের জন্য বসে থাকতে হয়। কিন্তু, তার সমসাময়িক যারা প্রশাসন বা অন্যান্য ক্যাডারে থাকেন, তারা প্রমোশন পেয়ে ততদিনে ষষ্ঠ গ্রেডে চলে যান। অনেক চিকিৎসককে দেখেছি নবম গ্রেডে জয়েন করার পর একই গ্রেডে থেকে অবসর নিতে।'

তুহিন আরও বলেন, 'এ ছাড়া, সুযোগ-সুবিধার কথা যদি বলি, সবাই তো সেটাই প্রথমে দেখবে। সরকারি যেসব সুযোগ-সুবিধা আছে, ডাক্তারদের চেয়ে প্রশাসন বা পররাষ্ট্র ক্যাডারে অনেক বেশি। এটাও একটা কারণ। তা ছাড়া, আপনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে গেলে ডাক্তারদের অবস্থা দেখবেন। পাশাপাশি প্রশাসন ক্যাডারদের বাসভবন থেকে শুরু করে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাগুলো দেখবেন। সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান বিপ্লব একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডারের জন্য। এর কারণ হিসেবে বিপ্লব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রশাসন ক্যাডার থেকে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার সময় জনগণের সঙ্গে ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। মানুষ তাদের অনেক সম্মান করে। তা ছাড়া পদোন্নতি পেয়ে সচিব পর্যন্ত হওয়া যায়। সে কারণে সবার মতো আমারও প্রশাসন ক্যাডারই বেশি পছন্দ।'

বিপ্লব আরও বলেন, 'দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে পুলিশ ক্যাডার দেওয়া আছে। তার কারণ, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট চিন্তা করে দেখেন। এই ক্যাডারে কিছুই লাগে না। শুধু ইউনিফর্ম হলেই অনেক। একজন পুলিশ কনস্টেবলের যেখানে অসম্ভব রকমের ক্ষমতা, সেখানে একজন এএসপি হলে তো আকাশ ছোঁয়া ব্যাপার।'

বেসরকারি খাতে অনিশ্চয়তা, সরকারি চাকরিতে নিশ্চয়তা

অধিকাংশ চাকরি প্রার্থী সরকারি চাকরিকেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করেন। মহামারিতে তাদের এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী আজিজুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশে বেসরকারি খাতে ভালো চাকরি পাওয়া খুব সহজ না। তারপরও মহামারির কারণে যেটা দেখলাম, এই সেক্টরে খুব বেশি অনিশ্চয়তা। উপযুক্ত কারণ ছাড়াই যেকোনো সময় ছাঁটাই করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিসিএস বা সরকারি চাকরিতে অনেক বেশি নিশ্চয়তা রয়েছে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আহাদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারি চাকরির সবচেয়ে বড় সুবিধা চাকরির নিরাপত্তা। আমার পরিচিত যারা আছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, বেসরকারি চাকরিতে কোনো নিরাপত্তা নেই। যেকোনো সময় চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ দিক দিয়ে দেখলে সরকারি চাকরি হুট করে চলে যাওয়ার কোনো ভয় নেই।'

একাডেমিক বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ কম

বর্তমান সময়ে একাডেমিক বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছে নেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর। অনেকের আবার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ নেই। কারণ জানতে চাইলে শিক্ষার্থীরা এর জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক ব্যবস্থাকেও দায়ী করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী রশিদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি গণিতে মাস্টার্স শেষ করেছি। কিন্তু দেশে থেকে এ বিষয়ে শিক্ষকতা ছাড়া আর কী করার আছে? দেশে আরও বেশি গবেষণা বা পড়ালেখা করে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগও খুব একটা নেই। তাছাড়া যাই করি না কেন বিসিএসকেই সামাজিকভাবে সবচেয়ে বেশি সম্মানজনক মনে করা হয়। তাই দেশে ভালো কিছু করতে হলে বিসিএস ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখি না।'

পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী আজিজুল হক বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় মেধাক্রম অনুসারে এই বিভাগে ভর্তি হই। শিক্ষকরাও আমাদের পরিসংখ্যান পড়িয়েছেন। কিন্তু তারা কখনো পরিসংখ্যানের প্রতি আমাদের আগ্রহ তৈরির চেষ্টা করেননি বা ক্যারিয়ার গড়ার বিষয়ে কোনো দিক নির্দেশনা দেননি। ফলে, পড়ালেখা শেষ করে নিজেদের কাছে যেটা ভালো মনে হয়েছে সেভাবে ক্যারিয়ার গঠনের পরিকল্পনা করছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

1h ago