মাতুয়াইল ময়লার ভাগাড়: দুর্ভোগে এলাকাবাসী, ঝুঁকিতে পরিবেশ

রাজধানীর মৃধা বাড়ি এলাকার দীর্ঘদিনের বাসিন্দা আবদুস সালাম। পাশের মাতুয়াইল ময়লার ভাগাড়ের দুর্গন্ধ গত পাঁচ থেকে ছয় বছরে অসহনীয় হয়ে ওঠেছে তার কাছে।

রাজধানীর মৃধা বাড়ি এলাকার দীর্ঘদিনের বাসিন্দা আবদুস সালাম। পাশের মাতুয়াইল ময়লার ভাগাড়ের দুর্গন্ধ গত পাঁচ থেকে ছয় বছরে অসহনীয় হয়ে ওঠেছে তার কাছে।

তিনি বলেন, 'তারা এখন খাল আর পুকুরেও ময়লা ফেলছে। এ পাড়ায় কেউ থাকতে চায় না। এমনকি আত্মীয়স্বজনও আমাদের দেখতে আসতে চায় না।'

আরশাদুল আলম নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, 'এখানে অনেক ফাঁকা বাসা খুঁজে পাবেন। যেসব বাড়ির মালিক ফ্ল্যাট ভাড়ার আয়ে চলেন, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে এখানে থাকতে না চাওয়ার জন্য কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। শুকনো মৌসুমে যখন ভাগাড়ে ময়লা পোড়ানো হয়, তখন আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে।'

ল্যান্ডফিলের কাছাকাছি স্থানে বসবাসরত লাখ লাখ মানুষের একই অবস্থা। প্রতিনিয়ত দুর্গন্ধ এবং বায়ু ও প্লাস্টিক দূষণের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করতে হচ্ছে তাদের।

১০০ একরের মাতুয়াইল স্যানিটরি ল্যান্ডফিল ঢাকার বৃহত্তম বর্জ্য নিষ্কাশন কেন্দ্র। দুর্বল তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ময়লা প্রতিদিন মাটি চাপা না দেওয়া এবং গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের কারণে এ ভাগাড় এখন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।

রাজধানীর ডেমরায় অবস্থিত ল্যান্ডফিলটিতে প্রতিদিন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকা থেকে প্রায় দুই হাজার ৫০০ টন কঠিন বর্জ্য (সলিড ওয়েস্ট) আনা হয়। যন্ত্রপাতি, জনবল ও ডাম্পিং স্পেসের ঘাটতির কারণে এর অবস্থা এখন শোচনীয়।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লা ফেলার জন্য আমিনবাজারে আরেকটি ল্যান্ডফিল আছে। এটিও নানা সমস্যায় জর্জরিত।

দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

কোনো রিসাইক্লিং সুবিধা না থাকায় মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ মারাত্মক দূষণ ঘটাতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ‍

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচিই) সিটিওয়াইড ইনক্লুসিভ স্যানিটেশন- এফএসএম সাপোর্ট সেলের চিফ অপারেটিং অফিসার আব্দুল্লাহ আল মুয়ীদ বলেন, 'আমাদের কঠিন বর্জ্যের একটি বড় অংশে ৭০ শতাংশের বেশি আর্দ্রতা থাকে। যখন এত বেশি পরিমাণ কঠিন বর্জ্য ল্যান্ডফিল সাইটে স্থানান্তরিত হয়, তখন বর্জ্য ম্যাট্রিক্সের ভেতরে বায়বীয় অবস্থা (অক্সিজেনের উপস্থিতি) বজায় রাখা খুব কঠিন। প্রচুর পরিমাণ কঠিন বর্জ্যের এ অতিরিক্ত চাপ ধীরে ধীরে বায়বীয় অবস্থাকে অ্যানেরোবিকে (অক্সিজেনের অনুপস্থিতি) পরিবর্তিত করে। ফলে মিথেনের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়।'

মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল থেকে বিপুল পরিমাণ মিথেন নির্গমন নিয়ে চলতি বছরের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের প্রকল্প পরিচালক শফিউল্লাহ সিদ্দিক ভূঁইয়া জানান, গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন হার বের করার জন্য তারা বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেন্সিং অর্গানাইজেশনের (স্পারসো) এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সহায়তায় আগের স্যাটেলাইট ছবি সংগ্রহ করছেন।

গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন পর্যবেক্ষণ করে- এমন একটি কোম্পানির হিসাব অনুযায়ী, মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল থেকে প্রতি ঘণ্টায় চার টন মিথেন নির্গত হয়। তবে, ল্যান্ডফিলটি পরিচালনাকারী ডিএসসিসি এ তথ্য স্বীকার করেনি। যদিও, কতটুকু মিথেন নির্গত হয়, সে ব্যাপারে তাদের নিজস্ব কোনো হিসাব নেই।

শফিউল্লাহ সিদ্দিক ভূঁইয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি একটি স্যানিটরি ল্যান্ডফিল। আমরা মনে করি না এ সাইট থেকে এত বেশি গ্যাস নির্গত হয়।'

সম্প্রতি ল্যান্ডফিলটি পরিদর্শনে গিয়ে এ প্রতিবেদক প্লাস্টিক ও রান্নাঘরের বর্জ্যসহ বিপুল পরিমাণ কঠিন বর্জ্য খোলা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। কিছু কিছু জায়গায় প্রায় ৭০ ফুট উঁচু বর্জ্যের স্তুপ দেখা গেছে, যা পাঁচতলা ভবনের সমান।

এ ছাড়া, তরল বর্জ্য সংগ্রহের ড্রেনগুলোকে পূর্ণ অবস্থায় বা কঠিন বর্জ্য দিয়ে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে থাকতে দেখা গেছে। ফলে পুরো জায়গাটি জুড়েই তরল বর্জ্য ছড়িয়ে পড়েছে।

তরল বর্জ্য উচ্চ আর্দ্রতা সম্পন্ন বর্জ্য থেকে উৎপন্ন একটি বিষাক্ত দ্রব্য। এটি ভূগর্ভস্থ পানিতে প্রবেশ করতে পারে এবং সেখান থেকে ভূপৃষ্ঠের পানির উৎসেও প্রবেশ করতে পারে। তাই এর সঠিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রকল্প পরিচালক শফিউল্লাহ বলেন, 'কঠিন বর্জ্যের প্রতি ২০ থেকে ২৫ ফুট স্তরে তরল বর্জ্য সংগ্রহের ড্রেন স্থাপন করতে হবে আমাদের। বর্তমানে কঠিন বর্জ্যের স্তর প্রায় ৭০ ফুট উঁচু। তাই অন্তত তিন স্তরের তরল বর্জ্যের ড্রেন থাকা উচিত। কিন্তু, আছে মাত্র একটি।'

এ ছাড়া, ল্যান্ডফিল এলাকার বেশিরভাগ অংশ খোলা। আবর্জনাকে মাটি চাপা দেওয়া হয় না সেখানে।

জমি, যন্ত্রপাতি ও জনবলের অভাব

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দৈনিক দুই হাজার ৫০০ টন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ভারি যন্ত্রপাতির মাত্র ৪০ শতাংশ আছে তাদের কাছে। এগুলোও ঘন ঘন নষ্ট হয়।

বর্জ্য সরানোর জন্য ব্যবহৃত দুটি ব্যাক লোডারের দুটিই, দুটি টায়ার ডোজারের একটি, দুটি বুলডোজার, পাঁচটি পে লোডারের মধ্যে তিনটি এবং পাঁচটি এক্সক্যাভেটরের মধ্যে দুটি বর্তমানে নষ্ট।

ল্যান্ডফিলে জনবলেরও ঘাটতি রয়েছে। মাত্র ১০ জন ক্লিনার এবং চারজন প্রকৌশলী বিশাল এ ডাম্পসাইটটি পরিচালনা করছেন। ফলে সংগৃহীত বর্জ্য খোলা অবস্থায় যেনতেনভাবে পড়ে থাকছে।

এ ছাড়া, ল্যান্ডফিলের বর্জ্য অপসারণের জায়গারও ঘাটতি রয়েছে।

প্রাথমিকভাবে ৫০ একর জমি নিয়ে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ল্যান্ডফিলটির বর্জ্য রাখার সক্ষমতা ২০০৬ সালেই শেষ হয়ে যায়। পরে আরও ৫০ একর জমি যুক্ত করা হলেও, গত বছর এ বর্ধিত জমির সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যায় বর্জ্যের পরিমাণ।

তার ওপর, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অফ বাংলাদেশের একটি হাই-ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়ার পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ল্যান্ডফিলের ২৫ একরেরও বেশি এলাকা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

এ কারণে ল্যান্ডফিল কর্তৃপক্ষ পাশের খালে বর্জ্য ফেলছে। ফলে পানি ও মাটি দূষিত হচ্ছে।  

জানতে চাইলে ল্যান্ডফিলের দায়িত্বে থাকা এক প্রকৌশলী বলেন, 'আমরা রিকশা ভ্যানের মাধ্যমে বর্জ্য নিয়ে খালে ফেলে দিই। ভেঙে পড়া বিদ্যুৎ লাইনের কারণে সব নিচু প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। অবশিষ্ট প্ল্যাটফর্মগুলো রিকশা ভ্যানের জন্য খুব উঁচু। তাই খালে ফেলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই আমাদের।'

এ ছাড়া, ল্যান্ডফিলটিতে কোনো বর্জ্য পৃথকীকরণ বা রিসাইক্লিং সুবিধা নেই। ফলে প্লাস্টিক বর্জ্য দিন দিন কেবল বাড়ছেই। শুকনো মৌসুমে এসব প্লাস্টিক বর্জ্য জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, যা আশপাশের এলাকায় মারাত্মক বায়ু দূষণ সৃষ্টি করে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রস্তাবিত সংস্কার

স্থানীয়দের দুর্ভোগ সত্ত্বেও ডিএসসিসি ইতোমধ্যে ল্যান্ডফিল সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্দেশ্যে আরও ৮১  একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর বদরুল আমিন বলেন, 'আমরা এ সম্প্রসারণের জন্য ডিওই থেকে ছাড়পত্র পেয়েছি। ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।'

তবে, ল্যান্ডফিল সম্প্রসারণকে সব সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।

বদরুল জানিয়েছেন, তারা 'ক্লিন ঢাকা মাস্টার প্লান ২০১৮-২০৩' প্রকল্পে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছেন।  

গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের কাছে পরিকল্পনার একটি খসড়া জমা দেয়। দুই সিটি করপোরেশনই খসড়াটিকে অনুমোদন দিয়েছে।

মাস্টার প্ল্যানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো নিয়মমাফিক বর্জ্য সংগ্রহ, পৃথকীকরণ, রিসাইক্লিং, পুনর্ব্যবহার ও ভস্মীকরণ ব্যবস্থা কার্যকর করা।

বদরুল বলেন, 'একবার অনুমোদন ও ফান্ড পেয়ে গেলে আমরা পুনর্ব্যবহার, রিসাইক্লিং ও পোড়ানোর মাধ্যমে ৭৫ শতাংশেরও বেশি বর্জ্য কমাতে সক্ষম হব। আগামী ১০ বছরে ধীরে ধীরে বর্তমানের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আমরা আশাবাদী।'

সংক্ষেপিত: ইংরেজিতে মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন A tale of a landfill and its ravages

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম।

Comments

The Daily Star  | English

Four of a family among five killed as private car, truck collide in Habiganj

The family members met the tragic accident while returning home after receiving someone at Dhaka airport

1h ago