জর্জিয়ায় ৬ দিন
ইউরোপ ও এশিয়ার সঙ্গমস্থলে ২৬ হাজার ৯১১ বর্গমাইল আয়তনের ছোট দেশ জর্জিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জর্জিয়া। জর্জিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী বাটুমি। দেশটির একমাত্র সমুদ্র বন্দরও এখানেই।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশে প্রবেশের ভিসা বা রেসিডেন্ট পারমিট থাকলে জর্জিয়া ভ্রমণের জন্য আলাদা ভিসার প্রয়োজন হয় না। দেশটিতে অন অ্যারাইভাল সিল নিয়েই প্রবেশ করা যায়।
জর্জিয়ার কুতাইসির এয়ারপোর্ট আয়তনের দিক থেকে খুব বেশি বড় নয়, তবে পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে বেশ এগিয়ে। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসার থেকে শুরু করে বেশিরভাগ কর্মী নারী।
জর্জিয়াতে কেন গিয়েছি, কোথায় কোথায় ঘুরব, হোটেল বুকিংয়ের কনফার্মেশন, রিটার্ন টিকেট, টিকার সনদসহ প্রয়োজন সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এবং দলিলাদি দেখিয়ে এয়ারপোর্টের সব কার্যক্রম শেষ করি।
সব মিলিয়ে প্রায় ৬ দিন জর্জিয়ায় ছিলাম। প্রথম দিনে কুতাইসি ও এর আশেপাশে ঘুরেছি। এরপর আমার গন্তব্য হয় বাটুমি।
জর্জিয়ার অবকাঠামো ও গণপরিবহন খুব একটা আশানুরূপ নয়। অভ্যন্তরীণ রুটে দেশটির বেশিরভাগ মানুষ বাস বা ট্রেনের পরিবর্তে মিনিবাসের ওপর অধিকমাত্রায় নির্ভরশীল। মিনিবাসে কুতাইসি থেকে বাটুমি পৌঁছাতে প্রায় ৩ ঘণ্টার লাগে।
জর্জিয়ান সরকারের বেশিরভাগ উন্নয়ন পরিকল্পনা রাজধানী তিবিলিসি, দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বাটুমি এবং কয়েকটি দর্শনীয় স্থান কেন্দ্রিক। এগুলো বাদ দিলে জর্জিয়ার রূপ অনেকটা ফিকে হয়ে চোখের সামনে ধরা দেয়।
কুতাইসি থেকে বাটুমি পৌঁছে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। কুতাইসিকে অনেকটা ধ্বংসস্তূপের মতো মনে হয়েছিল। সোভিয়েতের সেই পুরাতন দিনগুলোর ছাপ আজও শহরটিতে প্রবল। সে তুলনায় বাটুমি বেশ উন্নত, আধুনিক ও পরিচ্ছন্ন।
বাটুমিতে এক রাত থাকার জন্য আমাকে ২৫ জর্জিয়ান লারি খরচ করতে হয়েছিল। জর্জিয়ার অফিসিয়াল মুদ্রার নাম জর্জিয়ান লারি। এক জর্জিয়ান লারি বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৮ টাকা।
জর্জিয়াতে থাকার হোটেলের সংজ্ঞা আমাদের চেনা-পরিচিত সংজ্ঞার চেয়ে খানিকটা ভিন্ন। বেশিরভাগ হোটেলের মালিক তাদের বাড়ির একটা অংশ আলাদা করে সেটা ভাড়া দেন হোটেল হিসেবে। এ কারণে অনেক সময় হোটেলের সাইনবোর্ডই খুঁজে পাওয়া যায় না। ট্যাক্সি ড্রাইভারও সঠিক লোকেশন খুঁজে পেতে হিমশিম খায়। এসব জায়গায় সেবার মানও আশানুরূপ নয়। ওয়েবসাইটে বুকিং দেওয়ার সময় যা দেখেছিলাম বাস্তব চিত্র তার থেকে আলাদা।
বাটুমিতে ম্যাচাখেলা ন্যাশনাল পার্ক, গোনিও ফোরট্রেস, সারপি, বাটুমি বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং মূল শহর ঘুরে দেখতে ট্যাক্সি ভাড়া করেছিলাম। এর জন্য খরচ হয়েছিল ২২০ জর্জিয়ান লারি।
মূলত কৃষ্ণসাগরের তীরে অবকাশ যাপনের জন্য বেশিরভাগ দর্শনার্থী বাটুমিতে আসেন। হাইড্রোজেন সালফাইডসহ সালফারের বিভিন্ন যৌগের উপস্থিতির কারণে কৃষ্ণসাগরের জলরাশি কালচে নীল বর্ণ ধারণ করে। মাঝে মাঝে সাগরের তট বরাবর হাঁটলে সালফারের মৃদু গন্ধ পাওয়া যায়। তবে কৃষ্ণসাগরের তীরবিধৌত অঞ্চলগুলো বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। গ্রীষ্মকালে বাটুমিতে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের সমাগম হয়। তবে বাটুমির সৌন্দর্য কেবল কৃষ্ণসাগরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ম্যাচাখেলা ন্যাশনাল পার্ক, মেটিরালা ন্যাশনাল পার্ক এবং বাটুমি বোটানিক্যাল গার্ডেনও কৃষ্ণসাগরের তীরে অবস্থিত সমুদ্র সৈকতগুলোর মতো সমানভাবে আকর্ষণীয়।
বেশিরভাগ পর্যটক বাটুমিতে আসেন একদিনের জন্য। তাই তাদের পরিকল্পনায় বোটানিক্যাল গার্ডেন ছাড়া বাকি ২টি জায়গা তেমন গুরুত্ব পায় না। এ ছাড়াও, ম্যাচাখেলা ও মেটিরালা ন্যাশনাল পার্ক বাটুমি মূল শহর থেকে বেশ খানিকটা বাইরে। রাস্তা ভালো না থাকায় এবং গণপরিবহন আশানুরূপ না হওয়ায় স্থান ২টি অন্তরালেই থেকে যায়।
বাটুমিতে আগত দর্শনার্থীদের সিংহভাগ জর্জিয়ার নাগরিক। সম্প্রতি তুরস্ক, রাশিয়া, বেলারুশ, ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা জর্জিয়াতে আসছেন। মূলত রিয়েল স্টেট ব্যবসায় বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে এসব দেশের অনেক নাগরিক জর্জিয়াকে বেছে নিচ্ছেন।
অবকাঠামোগত দিক থেকে জর্জিয়া পিছিয়ে থাকায় অভ্যন্তরীণ যাত্রায় গুগল ম্যাপের ওপর নির্ভর করা যায় না। তরুণ প্রজন্মের বাইরে জর্জিয়ার বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ ইংরেজিতে খুব একটা পারদর্শী নন। অবশ্য সোভিয়েত শাসনামলে যাদের বেড়ে উঠা, তারা রাশিয়ান ভাষায় বেশ দক্ষ। জর্জিয়ার ভাষা অন্যান্য ভাষা থেকে বেশ আলাদা। প্রতিবেশি কোনো দেশের সঙ্গে জর্জিয়ার ভাষার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এ কারণে এ ভাষায় ব্যবহৃত বর্ণমালাও আমাদের কাছে একেবারে অপরিচিত।
দেশটির তরুণ প্রজন্ম ছাড়া অন্য অধিবাসীরা ইংরেজিতে খুব একটা পারদর্শী নয়। এ কারণে জর্জিয়াতে বেড়াতে হলে সঠিক পূর্বপরিকল্পনা জরুরি। বিশেষত কোনো অভিজ্ঞ টুরিস্ট গাইডের সাহায্য ছাড়া জর্জিয়া ভ্রমণ কঠিন হতে পারে।
ইরাসমাস প্লাস একচেঞ্জ স্টাডি প্রোগ্রামের সুবাদে দীর্ঘ প্রায় ৪ মাস তুরস্কে থাকার সুযোগ পেয়েছি। ২০১৮ সাল থেকে স্লোভেনিয়ায় অবস্থান করছি। এখন পর্যন্ত ইউরোপে প্রায় ২৫টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছি। সে বিবেচনায় জর্জিয়ানদেরকে আমার কাছে খুব একটা বন্ধুবৎসল মনে হয়নি।
জর্জিয়াতে ডিজিটাল পেমেন্ট এখনও জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। তাই ভরসা নগদ অর্থেই।
বাটুমি থেকে ম্যাচাখেলা ন্যাশনাল পার্কের দূরত্ব প্রায় ২৫ মাইল। ছোট-বড় বিভিন্ন আয়তনের পাহাড়, হ্রদ এবং পাহাড়ের ঢাল বেয়ে প্রবাহিত হওয়া নদ-নদী ম্যাচাখেলা ন্যাশনাল পার্ককে অপার্থিব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উত্তরাধিকারী করেছে। ম্যাচাখেলা ন্যাশনাল পার্ক দক্ষিণ বরাবর তুরস্কের সীমানার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। গ্রীষ্মকালে অনেক পর্যটক স্কুটি চালিয়ে এ পার্কের রাস্তা ধরে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যান।
ওয়াইন ও মধু উৎপাদনে জর্জিয়া বেশ প্রসিদ্ধ। জর্জিয়ার ওয়াইন শিল্প বেশ কয়েক হাজার বছরের পুরনো। অনেকে বলেন, পৃথিবীতে প্রথম দিকের ওয়াইন উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি জর্জিয়া। ওক ব্যারেলের পরিবর্তে জর্জিয়া সম্পূর্ণ নিজস্ব ফর্মুলায় ওয়াইন প্রস্তুত করে।
একইভাবে জর্জিয়াতে মধু উৎপাদনের ইতিহাসও বেশ প্রাচীন এবং কয়েক হাজার বছরের পুরনো। ম্যাচাখেলা ন্যাশনাল পার্ক ঘুরতে এসে জর্জিয়ার ওয়াইন শিল্প ও মধু উৎপাদনের দীর্ঘ দিনের ইতিহাস সম্পর্কেও জানার সুযোগ হয়েছে। পার্কের চারপাশের গ্রামগুলোর অর্থনীতি এই ২টি জিনিসের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
ম্যাচাখেলা ন্যাশনাল পার্ক থেকে যাই গোনিও ফোরট্রেস। গোটা ককেশাস অঞ্চলে রোমান সাম্রাজ্যের যে কয়েকটি নিদর্শন রয়েছে তার মধ্যে গোনিও ফোরট্রেস অন্যতম। প্রথম দিকে রোমান সেনাবাহিনীর সদস্যরা গোসলের কাজে এই স্থানটি ব্যবহার করতেন। ফোরট্রেসের ভেতরে সবচেয়ে প্রাচীন যে প্রকোষ্ঠটি রয়েছে সেটি শস্য সংরক্ষণ করার কাজে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে আঞ্চলিক প্রতিরক্ষার কাজে এটি ব্যবহার করা হতো। ফোরট্রেসের ভেতরে যেতে ৫ জর্জিয়ান লারি দিয়ে টিকেট কিনতে হয়।
গোনিও ফোরট্রেস থেকে কৃষ্ণসাগরের তীর ঘেঁষে দক্ষিণে কয়েক মাইল গেলে বিশাল এক দেওয়ালের মতো চেকপোস্টের দেখা মিলবে। সেটাই জর্জিয়ার শেষ সীমানা। চেকপোস্টের ওপাশে তুরস্কের পতাকা উড়ছে।
সার্বিকভাবে জর্জিয়াকে বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ মনে হয়েছে। জর্জিয়ার প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাস রয়েছে। তাছাড়া দেশটিতে অঞ্চলভেদে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়।
ঐতিহাসিকভাবে বাটুমি আচারা নামক এক ভূখণ্ডের অন্তর্গত। আচারা বর্তমানে জর্জিয়ার অন্যতম স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ এবং বাটুমি এই প্রদেশের রাজধানী। বাটুমির স্থানীয় অধিবাসীরা নিজেদের আচারিয়ান হিসেবে পরিচয় দেন।
খাচাপুরি জর্জিয়ার একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। পিৎজার সঙ্গে খাচাপুরির কিছুটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এ কারণে অনেকে খাচাপুরিকে জর্জিয়ান পিৎজা বলেও আখ্যা দেন। অঞ্চলভেদে খাচাপুরি তৈরির প্রক্রিয়াতেও ভিন্নতা আছে।
বাটুমির বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রবেশ করতে ১৫ জর্জিয়ান লারি দিয়ে টিকেট কাটতে হয়। এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ থেকে বিভিন্ন গাছ ও লতাপাতা নিয়ে সাজানো হয়েছে এটি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতরে প্রতিটি মহাদেশের নামে আলাদা আলাদা সেকশন রয়েছে।
বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে এক অসাধারণ রূপে কৃষ্ণসাগরকে দেখা যায়। সাগরের তীর ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে রেললাইন। প্রতিদিন এই রেললাইন দিয়ে তিবিলিসি-বাটুমি ট্রেন চলাচল করে।
বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে যাত্রা বাটুমি বুলেভার্ডে। দূর থেকে বাটুমি বুলেভার্ডকে দেখলে দুবাই মনে করে অনেকে ভুল করে বসতে পারেন। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর বিভিন্ন দালানকোঠা এই জায়গাটিকে চাকচিক্যময় করে তুলেছে।
জর্জিয়ার জলসীমা দিয়ে চলাচলকারী নৌযানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় বাটুমি বুলেভার্ডে রয়েছে লাইট হাউস। লাইট হাউসের পাশেই নাগরদোলার দেখা পেলাম। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার কাছেই সেই নাগরদোলা বিশেষ আকর্ষণের বস্তু।
আইফেল টাওয়ার যেভাবে প্যারিসের প্রতিনিধিত্ব করে, ঠিক তেমনি বাটুমির প্রতিনিধিত্ব করে আলী অ্যান্ড নিনো স্ট্যাচু। লাইলী-মজনুর মতো আলী-নিনো প্রেমকাহিনী নির্ভর লোকগাথা। জর্জিয়ান ভাস্বর তামারা কেভিসিতাজে এই স্ট্যাচুর কারিগর।
অর্থোডক্স খ্রিস্টানিটির পর জর্জিয়াতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন। দেশটির সরকারের তথ্য অনুযায়ী, জর্জিয়ায় মোট জনসংখ্যার ৮ থেকে ১০ শতাংশ মুসলমান। বাটুমিতে অবস্থিত একমাত্র জামে মসজিদটি দেখার জন্যও অনেক দর্শনার্থী আসেন। ১৮৮৬ সালে আসলান বেগ কিমশিয়াসভিলি নামের একজন ধনাঢ্য জর্জিয়ান মুসলিম ব্যবসায়ী নিজস্ব অর্থায়নে এই মসজিদ নির্মাণ করেন।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সখ্যতা নিত্যদিনের। আর সেই সখ্যতা যদি হয় সাগরের সঙ্গে তাহলে তো কথাই নেই। কৃষ্ণসাগরের প্রতি এমনই ভালোবাসা থেকে আবারও কোনদিন বাটুমি ফেরার আশা নিয়ে ফিরে যাই স্লোভেনিয়ায়।
রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, শেষ বর্ষ, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া
Comments