জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে অক্টোবরে বিশ্ব বইমেলার ৭৩তম আসর

মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কারক ইয়োহানেস গুটেনবার্গের জন্ম জার্মানির মাইনস শহরের কাছে। তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত মাইনস বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এই জন্যই প্রতিবছর সোনালি শরতে মিষ্টি রোদের আমেজে মাইন নদীর বুকে জার্মানির পঞ্চম বৃহত্তম মহানগর ফ্রাঙ্কফুর্টে বসে বিশ্ব বইমেলার আসর।
৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী 'ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা' বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা। জার্মান পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি আয়োজিত প্রতিবছরের মেলা বিশ্বের খ্যাতনামা হাজারো লেখক, সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক, প্রকাশক ও বইপ্রেমী মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে।
আগামী ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত চার দিনব্যাপী এই মেলার ৭৩তম আসর বসছে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে। মেলার এবারের মূলমন্ত্র হচ্ছে 'পুনরায় সংযোগ'। গতবছরের মতো এবারও মেলার 'গেস্ট অব অনার' দেশ কানাডা। করোনা মহামারির কারণে ভার্চুয়ালি মেলা অনুষ্ঠিত হলেও এ বছর মেলার ৭৩তম আসর সরাসরি উপস্থিতির সঙ্গে ডিজিটাল প্রোগ্রামের মাধ্যমে উৎসবমুখর পরিবেশে আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
মেলা কর্তৃপক্ষ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, এই শরতে আবার হবে বিশ্বব্যাপী প্রকাশক-পাঠকের মহা মিলনমেলা, স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ফ্রাঙ্কফুর্ট। আমরা প্রকাশক, লেখক ও পাঠকদের আরও একবার একত্রিত হওয়ার জন্যে একটি জায়গা তৈরি করব। নিশ্চিত করব যে, সবার কাজ করার জন্য একটি নিরাপদ ও উৎপাদনশীল পরিবেশ রয়েছে।
কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে, জার্মান সরকারের 'সংস্কৃতির নতুন যাত্রা' কর্মসূচির তহবিল থেকে ৭৩তম ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলাকে সমর্থন করা হচ্ছে। এই সহায়তার কারণে এই বছর প্রদর্শনী স্ট্যান্ডের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে কম ফি দিতে হবে। এই সহায়তার উদ্দেশ্য শিল্পের বৈচিত্র্যকে তুলে ধরার উপায় হিসেবে ছোট ও মধ্য আকারের সংস্থাগুলোকে সহায়তা করা।
'স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার কারণে এবারের মেলার সবচেয়ে ছোট প্রদর্শনীটি আট বর্গমিটার আকারের হবে (চার বা ছয় বর্গমিটারের পরিবর্তে)। আমরা এই আকার স্ট্যান্ডে ৫০ শতাংশ ছাড় দেবো, যাতে প্রদর্শক এই প্রয়োজনীয়তার কারণে কোনো অতিরিক্ত ব্যয়ের মুখোমুখি না হন। আমরা সব প্রদর্শনী হলগুলোতে হাঁটাপথগুলো প্রশস্ত করব, যাতে সামাজিক দূরত্ব সর্বদা বজায় রাখা সম্ভব হয়, তা নিশ্চিত করা হবে', মেলা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
রীতি অনুযায়ী এবারও পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য 'শান্তি পুরস্কার' প্রদান করবে। শহরের পল গির্জায় অনুষ্ঠিত হবে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান।
মেলায় টিকিট কেটে সবাইকে ঢুকতে হয়। তবে, শেষদিন যারা বাহারি সাজে সেজে আসবে, তারা বিনা টিকিটে প্রবেশ করতে পারেন। অন্যদিকে কোভিড-১৯ এর এ বছর এককালীন পুরো সময়ের টিকিট দেওয়া হবে না। অনলাইনে নিবন্ধন করে প্রতিদিনই টিকিট নিতে হবে। টিকিট নিতে করোনা নেগেটিভ সনদ থাকতে হবে। তা ছাড়া, বেশিরভাগ ইভেন্ট সরাসরি ও অনলাইন ভিত্তিক হবে।
এই মেলায় প্রতিবছর তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের একজন প্রকাশককে বিনা মূল্যে স্টল ও ফ্রাঙ্কফুর্টে আসা-যাওয়ার খরচ ও হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়। বিশেষ করে নারী প্রকাশক ও নতুন প্রকাশকদের এই সুযোগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের প্রকাশকদেরও এই সুবিধা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
মহামারির কারণে এবার বাংলাদেশ থেকে প্রকাশকরা আসবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ। তবে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এবারের মেলায় বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগ বঙ্গবন্ধু কর্নার করা হবে বলে নিশ্চিত করেছেন দূতাবাসের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম।
বাংলাদেশের প্রকাশকরা বাংলাদেশের বাংলাবাজারে সীমাবদ্ধ না থেকে ফ্রাঙ্কফুর্টে বই মেলায় আসলে মুদ্রণ ব্যবসা হতে পারে আমূল সাফল্য। যদিও মেলা চলাকালীন সময় কোনো বই বিক্রি হয় না, শুধু বাণিজ্যিক চুক্তি হয়।
জার্মানরা ট্রেনে বসে কিংবা স্টেশনে দাঁড়িয়ে ও রাতে শোবার আগে বই পড়ে, বাচ্চাদের পড়ে শোনায়। প্রিয়জনকেও তারা বই উপহার দেয়। বেশিরভাগ রাস্তার মোড়ে আলমারিতে বই রাখা আছে। যার দরকার সে নিয়ে বই পড়ে আবার যথাস্থানে রেখে যায়। অনেকে নিজের পড়ার শেষে তার বইও এসব আলমারিতে রেখে যায়। আর এই কারণেই টিকে আছে ও থাকবে ফ্রাঙ্কফুর্টের বিশ্ব বইমেলা।
লেখক: জার্মানপ্রবাসী সাংবাদিক
Comments