আবদুল্লাহ আল মামুন: সৃষ্টি সুখের উল্লাসে এক নির্মোহ স্রষ্টা

মঞ্চ থেকে টিভি নাটক, চলচ্চিত্র থেকে অভিনয়, নাট্য রচনা থেকে নির্দেশনা, কিংবা উপন্যাস কোথায় নেই তার ছোঁয়া। আবদুল্লাহ আল মামুন, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে যিনি ছাপিয়ে গেছেন সব গণ্ডি।
দেশে টিভি নাটকের শুরুটা কেমন হবে, কেমন হবে চিত্রনাট্য কারোই ধারণা ছিল না তখন। অনেকে নাকি ভেবেছিলেন চলচ্চিত্রের মতো হতে পারে, কিন্তু ভারটা ছিল তার কাঁধে। এই যে প্রথমের সূচনা, সেই সূচনা তার হাতেই। 'মেরাজ ফকিরের মা', 'কোকিলারা', 'উজান পবন', 'এখনও দুঃসময়', 'দ্যাশের মানুষ, সুবচন নির্বাসনে'র মতো নাটকের স্রষ্টা যে একজনই তা অবিশ্বাস্য মনে হয়। আবার তার হাতেই চিত্রায়ন হয়েছিল শহীদুল্লা কায়সারের অমর উপন্যাস 'সারেং বৌ'।
তিনি জানতেন উপন্যাস থেকে কতো নিখুঁতভাবে চিত্রায়ন করা যায় চলচ্চিত্রে। অন্যদিকে তিনি নিজেই তো পরবর্তীতে ঔপন্যাসিক হয়েছেন, কিংবা ততোদিনে টিভি নাট্যকার হিসেবেই তিনি দারুণ সফলতা পেয়েছেন সুতরাং তার ক্ষেত্রে বিষয়টি অনেকটাই সহজাত হলেও এতো নিখুঁত দৃশ্যায়ন সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রে বাংলাদেশে খুব কমই হয়েছে। তার এই যাত্রার সূচনা হয়েছিল সেই শহীদুল্লা কায়সারের অমর উপন্যাস 'সংশপ্তক' যখন তিনি চিত্রায়ন করলেন টিভি নাটকে।

বাংলাদেশের প্রথম ধারাবাহিক নাটকের সূচনা তার হাতে। প্রথম চাপা উত্তেজনা, ভয় ভাবনা সবার মধ্যেই। কেবল আবদুল্লাহ আল মামুনেরই স্বভাব ছিল সমস্ত কিছু স্বাভাবিক করে নেয়ার অদম্য শক্তি। আবদুল্লাহ আল মামুনের মৌলিক নাটক সৃষ্টির হাত ষাটের দশকের শুরুতে। প্রথম নাটক 'নিয়তির পরিহাস'। এই নাটকটি তিনি লিখেছিলেন ১৯৬১ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে। এরপর ক্রিস্টোফার মার্লোর বিখ্যাত নাটক 'ডক্টর ফস্টাস' বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়। এই নাটকের বাংলায় অনুবাদ ছিল বেশ জটিল। তবুও কী দারুণ অনুবাদ করেছিলেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন সময়ে তিনি লিখেছিলেন 'বিন্দু বিন্দু রঙ' নামে আরেকটি মৌলিক নাটক। তবে আবদুল্লাহ আল মামুন আলোচনায় এসেছিলেন 'শপথ' নাটক রচনার মধ্য দিয়ে। সে বছর সংস্কৃতি সংসদের উৎসব হবে। সেই উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে মঞ্চায়িত হয়েছিল শপথ নামের যুদ্ধবিরোধী নাটকটি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মৌলিক নাটক রচনায় পূর্ণ মাত্রায় মনোনিবেশ করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। ঝুঁকে পড়েন মঞ্চ নাটকে। ১৯৭৪ সালে মঞ্চে এলো তার হাতে সৃষ্টি হলো বিখ্যাত নাটক 'সুবচন নির্বাসনে' আর ১৯৭৫ সালে 'এখনও দুঃসময়'। তারপর একে একে 'এবার ধরা দাও', 'সেনাপতি', 'অরক্ষিত মতিঝিল', 'ক্রসরোড ক্রস ফায়ার', 'আয়নায় বন্ধুর মুখ', 'এখনও ক্রীতদাস', 'শাহজাদীর কালো নেকাব, 'চারদিকে যুদ্ধ' কিংবা 'এখনও ক্রীতদাস' এর অসামান্য সব নাটকের।
আধুনিক মঞ্চ নাটক বা টিভি নাটক- দুটিরই জনপ্রিয়তার কারিগর ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। তার নাটকে উঠে এসেছে সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের নানা দিক। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে নব্য ধনীক শ্রেণির পাশাপাশি মধ্যবিত্ত সমাজের নানা সঙ্কটের কথা তার নাটকে বারবার ধ্বনিত হয়েছে।
সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আল মামুনের এতোটাই দক্ষতা ছিল যে তিনি খুব সহজেই সাধারণ দর্শকের মন ছুঁতে পারতেন। বুঝতে পারতেন বাঙালি মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের হৃদস্পন্দন। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পেল শহীদুল্লা কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস সারেং বৌ অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র সারেং বৌ যা চলচ্চিত্রের এক অসামান্য মাইফলক।
সারেং বৌ নির্মাণ করেই থেমে থাকেননি আবদুল্লাহ আল মামুন। রাজ্জাক, শাবানা ও ফারুককে নিয়ে তিনি নির্মাণ করেছিলেন চলচ্চিত্র 'সখী তুমি কার'। ১৯৮০ সালে তিনি নির্মাণ করলেন আরেক অসামান্য চলচ্চিত্র 'এখনই সময়'। যে চলচ্চিত্রে আব্বাস আলী তালুকদার নামে এক প্রগতিশীল যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। 'এখনই সময়' চলচ্চিত্রে তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন ববিতা।

আবদুল্লাহ আল মামুন আফজাল হোসেন, দিতি, কবরী ও বুলবুল আহমেদকে নিয়ে নির্মাণ করেছিলে আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'দুই জীবন'।
নতুন নির্দেশক ও অভিনেতা তৈরির ক্ষেত্রে এক নিপুণ স্রষ্টা ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। প্রখ্যাত অভিনয় শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার বলেছিলেন, 'আমি নাটকের বৈরী পরিবেশে বড় হয়েছি। যদি আব্দুল্লাহ আল মামুন আমার জীবনে না আসতেন তাহলে আজকের এই ফেরদৌসী মজুমদার হতে পারতাম না।'
আবদুল্লাহ আল মামুন অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। নাট্যদল থিয়েটার তো বটেই, যার আরেকটি প্রমাণ ১৯৯০ এ অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে অধ্যক্ষ করে আবদুল্লাহ আল মামুনের হাতে গড়া থিয়েটার স্কুল। পাশাপাশি এরশাদ শাসনামলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আবদুল্লাহ আল মামুনের ভূমিকা ছিল অসামান্য। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারির সৈনিক। ঔপন্যাসিক হিসেবেও আবদুল্লাহ আল মামুন সফল। 'মানব তোমার সারা জীবন', 'হায় পার্বতী' কিংবা 'খলনায়ক' উপন্যাসগুলো তারই প্রমাণ।
সবশেষে আবদুল্লাহ আল মামুনের দুটো নাটকের কথা অবশ্যই বলতেই হয়। একটি 'কোকিলারা' দ্বিতীয়টি 'মেরাজ ফকিরের মা'। যে দুটো নাটক শুরু থেকেই আজ পর্যন্ত ঢাকার মঞ্চের সবচেয়ে বড় সঙ্গী।

একক নাটকের ক্ষেত্রে কোকিলারা নাটক তো বাংলাদেশের মঞ্চে পথিকৃৎই বলা যায়। ১৯৯০ সালে মঞ্চে আসা এই নাটকে কী দোর্দণ্ড অভিনয় ফেরদৌসী মজুমদারের। যেখানে আমরা দেখি এক নারীর গল্প। পিতা হারানো এক মেয়ের দুই বোনকে সঙ্গী করে বসবাস। যেখানে কোকিলার বাবার মৃত্যুর পর তার মায়ের বাধ্য হয়ে গ্রাম্য মাতবরকে বিয়ে করতে হয়। একসময় কিশোরী কোকিলা সম্ভ্রম হারায় সৎ বাবা তথা সেই বুড়ো মাতবরের কাছে। তারপর ঢাকা নামক এক শহরে পাড়ি জমানো। গৃহকর্মী হিসেবে আশ্রয় নিয়েও পান থেকে চুন খসলেই ইচ্ছে অনিচ্ছায় চরম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন অতঃপর এক যুবকের হাত ধরে পলায়ন। কিন্তু সেখানেও মন মতো কাজ না পেয়ে দোষারোপ গর্ভে আসা সন্তান এবং ট্রেনের নিচে নিজ সন্তানকে বিলিয়ে দেয়া। সোয়া দুই ঘণ্টার এই গোটা নাটকটি স্রেফ বুঁদ করে রাখে দর্শকদের। আবদুল্লাহ আল মামুন দেখিয়েছেন এরকম কোকিলা তো একজন নয়, সংখ্যাতীত। এই দারুণ নাটকটি একসময় অসম্ভবই ছিল বলা চলে। সোয়া দুই ঘণ্টার নাটক, টানটান মর্মস্পর্শী কথন। প্রথম যখন ফেরদৌসী মজুমদারকে আবদুল্লাহ আল মামুন কোকিলারা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ফেরদৌসী মজুমদার বলেছিলেন, 'অসম্ভব, এ পারব না।' কিন্তু আবদুল্লাহ আল মামুন হাল ছাড়েননি। তিনি বললেন, 'সংলাপগুলো মুখস্থ করুন। আপনি পারবেন না তো কে পারবে?' আবদুল্লাহ আল মামুন নিজেও বলেছিলেন, একক অভিনয়শিল্পীর প্রথম দেখাতেই ভালো না লাগলে দর্শক ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।'
মেরাজ ফকিরের মা নাটকের মঞ্চায়নে আরেক মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। এই নাটকেও মেরাজ ফকিরের মা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার।
যেখানে আমরা দেখি কোনো একসময়ের যাত্রার দলের অভিনেতা মোজাহের মণ্ডল। যিনি ভুলতে পারে না তার অতীত। আর তাই তো ৩৯ বছর পরেও তিনি আজও ফিরে যান তার সুদূর অতীতে। তার কথাবার্তা সবকিছু জুড়েই সেই যাত্রার ছোঁয়া। মেরাজ ফকিরের মা এক অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের অধিকারী। মেরাজ ফকির বড় ছেলে বলেই আলো বিবি মেরাজ ফকিরের মা বলে পরিচিত। আর তাই মোজাহের মণ্ডলের সঙ্গে তার স্ত্রী মেরাজ ফকিরের মা তথা আলো বিবির সঙ্গে সঙ্গে যাত্রাপালার ঢঙে কথাবার্তার মাধ্যমেই শুরু হয় নাটক মেরাজ ফকিরের মা।
যদিও মূল রহস্য আলোয় আসে আর কিছুক্ষণ পরেই। যে ধর্মীয় অনুভূতিকে কেন্দ্র করে এই নাটকের কাহিনী। জন্মের ৩৯ বছর পর একদিন মেরাজ ফকিরের মা জানতে পারে তার গর্ভধারিণী মায়ের ধর্ম আর তার ধর্ম এক নয়। ধর্ম পরিচয়ে এ যে ফারাক রচিত হয় তা কি মা-ছেলের সম্পর্ককে ফারাক করে দিতে পারে? ধর্মের ভিন্নতার কারণে ছেলে কি অস্বীকার করতে পারে তার মাকে? একদিকে আচার সর্বস্ব অন্যদিকে মানবিক সম্পর্ক দুটোই যেন দ্বিমুখী হয়ে উঠে। মেরাজ ফকিরের মা যেন এক অক্লান্ত বিশ্লেষণী নাট্য। যা আবদুল্লাহ আল মামুন তার মঞ্চ থেকে টিভি নাটক, অভিনয় থেকে চলচ্চিত্র সমস্তটুকু জুড়েই কী নিপুণভাবে করে গেছেন। আবদুল্লাহ আল মামুন চিরকাল থাকবেন তার অনন্য সৃষ্টি আর সৃষ্টির মহত্ত্ব জুড়ে।
আজ আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রয়াণ দিবস। শ্রদ্ধা জানাই এই অনন্য মহারথীর প্রতি।
Comments