আপনার মতো ‘কাফেরের’ শিরশ্ছেদ করতেই পারি: মানবাধিকারকর্মীকে তালেবান

হাবিবুল্লাহ ফারজাদ ভারতের নয়াদিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির (সার্ক প্রতিষ্ঠিত) পিএইচডি স্কলার এবং একজন মানবাধিকার কর্মী। গত ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিম কাবুলে নারীর অধিকারের জন্য একটি বিক্ষোভ চলাকালে তালেবানরা তাকে বেধড়ক মারধর করে। এ ঘটনায় ফারজাদের একটি হাত ভেঙে যায়। এ ছাড়া, তিনি শরীরের একাধিক স্থানে আঘাতও পেয়েছেন।
তালেবানের নির্যাতনের শিকার হাবিবুল্লাহ ফারজাদ। ছবি: সংগৃহীত

হাবিবুল্লাহ ফারজাদ ভারতের নয়াদিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির (সার্ক প্রতিষ্ঠিত) পিএইচডি স্কলার এবং একজন মানবাধিকার কর্মী। গত ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিম কাবুলে নারী অধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ চলাকালে তালেবানরা তাকে বেধড়ক মারধর করে। এ ঘটনায় ফারজাদের একটি হাত ভেঙে যায়। এ ছাড়া, তিনি শরীরের একাধিক স্থানে আঘাতও পেয়েছেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তালেবান শাসনে আফগানিস্তানের অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন ফারজাদ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতা মোস্তফা সবুজ।

ডেইলি স্টার: সেদিন আপনার সঙ্গে কী ঘটেছিল?

হাবিবুল্লাহ ফারজাদ: গত বুধবার পশ্চিম কাবুলের একটি থানার সামনে ৫০-৬০ জন ছাত্রী ও নারী অধিকার কর্মী এবং ৫-৬ জন পুরুষ বিক্ষোভ করেন। আমিও এতে অংশ নেই। আমরা নারী অধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ করছিলাম। আমাদের দাবি ছিল সব নাগরিকের, বিশেষ করে নারীদের অধিকার রক্ষা। আফগানিস্তানে নারীরা গুরুতর হুমকির মুখে আছেন।

এক ঘণ্টা পর যখন আমরা স্লোগান দিতে শুরু করলাম, কয়েকজন সশস্ত্র তালেবান পুরুষ বিক্ষোভকারীদের কাছে চলে আসল এবং আমাদের আটক করার চেষ্টা করল। তাদের বললাম, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছি। কিন্তু, তারা আমাকে এবং অন্য পুরুষ বিক্ষোভকারীদের পাশের থানায় নিয়ে যায়। তালেবান আমাদের বলেছিল, আমরা নাকি তালেবানের বিরুদ্ধে নয়, ইসলামের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছি।

সকাল ১১টার দিকে তারা আমাকে থানায় নিয়ে গেল। সেখানে একটি কক্ষে ৪-৫ জন তালেবান অপেক্ষা করছিল। তারা আমার হাত পেছনে বেঁধে ফেলে এবং আমাকে মেঝেতে ফেলে নির্দয়ভাবে মারতে শুরু করে। ৫-৬ মিনিটের মধ্যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এক ঘন্টা পর আমি নিজেকে করিডোরে দেখতে পাই। তারপর তারা আমাকে অন্য রুমে নিয়ে যায়। সেখানে তারা সাংবাদিকসহ আরও কয়েকজনকে আটক রেখেছিল।

তারপর তালেবান আমার রক্তাক্ত পোশাক পাল্টাতে বাধ্য করে এবং ঐতিহ্যবাহী আফগান পোশাক পরার পরামর্শ দেয়। আমার অবস্থা তখন খুব খারাপ। পুরো শরীরে গুরুতর জখম। ডান হাত ভেঙে গেছে। বাম হাতেও মারাত্মকভাবে আঘাত করা হয়েছে। আমি নড়তে পারছিলাম না।

তালেবানরা আমাকে প্রায় ৩ ঘণ্টা আটক রাখার পর ছেড়ে দেয়। কারণ, নারী বিক্ষোভকারীরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের মুক্তির দাবি জানাচ্ছিলেন তারা।

ছেড়ে দেওয়ার আগে তালেবান একটি লিখিত কাগজে আমার আঙুলের ছাপ নেয়। তবে, সেখানে কী লেখা ছিল তা আমি জানি না।

আমাদের ছেড়ে দেওয়ার আগে তারা ভবিষ্যতে কোনো বিক্ষোভে অংশ নিতে মানা করে। তারা বলেন, 'আপনারা ইসলামের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন। তাই, আপনাদের মত কাফেরদের হত্যা করার অনুমোদন আছে আমাদের।' 

ডেইলি স্টার: কারা বিক্ষোভ করছে? এটি কি জাতিগত নাকি সম্মিলিত বিক্ষোভ?

হাবিব: বিক্ষোভ শহরকেন্দ্রীক এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই বিক্ষোভগুলো মানবাধিকার গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলো পরিচালনা করছে। তবে, আমি বলব, এটি সম্মিলিত বিক্ষোভ। তালেবানের অধীনে অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিধর্ম নির্বিশেষে উদ্বিগ্ন সব মানুষ বিক্ষোভ করছে।

ডেইলি স্টার: তালেবানের ক্ষমতা দখলের প্রভাব এখন পর্যন্ত কেমন?

হাবিব: এখন অনেক কিছু ঘটছে। চারদিকে অনেক বেশি অনিশ্চিয়তা ও আতঙ্ক। পাবলিক প্লেসগুলোর বেশিরভাগই ফাঁকা। গণমাধ্যমে বিধিনিষেধ। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সাধারণ মানুষ মতামত প্রকাশ করতে পারছে না। মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। নিরাশ হয়ে বাড়িতে সময় পার করছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা ইতোমধ্যে ভেঙে পড়েছে। অর্থনীতি দ্রুত ভেঙে পড়তে যাচ্ছে। আমরা ব্যাংকের সামনে ভীড় দেখছি। সবকিছু দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। অনিশ্চিয়তার কারণে মানুষ দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সীমান্তও বন্ধ।

ডেইলি স্টার: পশ্চিমা-সমর্থিত সরকার এবং তালেবান সরকারের মধ্যে কী পার্থক্য দেখছেন?

হাবিব: আমি আগের সরকারেরও সমর্থক নই। তবে, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকার অন্তত সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার চেষ্টা করেছে। বৈষম্য তখনও ছিল। কিন্তু, তালেবান শাসনের মত এতটা না।

ডেইলি স্টার: দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কারজাই ও গনি সরকার কীভাবে সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত করেছে?

হাবিব: হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। তারা দুর্নীতিবাজ ছিলেন। দুজনই পশতুন ছিলেন, যারা শত শত বছর ধরে আফগানিস্তানের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে। কিন্তু আগের শাসনামল ও তালেবান সরকারের তুলনা করলে বলা যায়, আগে সংখ্যালঘুদের সীমিত অধিকার ছিল। মানে, আগের সরকারগুলো অন্তত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং নারী ও অন্যদের কিছু সুযোগ ও স্বাধীনতা দিয়েছিল। এটি তো আমরা অস্বীকার করতে পারি না। আর এখন, আমরা গত ২০ বছরে যা অর্জন করেছি, তালেবানের অধীনে তা হারানোর ঝুঁকিতে আছি।

ডেইলি স্টার: তালেবান সরকার কি অন্তর্ভুক্তিমূলক?

হাবিব: নতুন সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। এখন পর্যন্ত, তালেবানদের গৃহীত উদ্যোগগুলোতে আফগান ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটেনি। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধুমাত্র পুরুষশাসিত পশতুন জাতিগোষ্ঠীর ইসলামি নেতা ও মোল্লাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে।

ডেইলি স্টার: তালেবান কি জাতি পুনর্গঠনে তরুণদের যুক্ত করবে?

হাবিব: তালেবান গণতান্ত্রিক যুগে বেড়ে ওঠা শিক্ষিত, মেধাবী তরুণদের ব্যবহার করতে আগ্রহী নয়। গত সপ্তাহে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী শেখ মৌলভী নূরুল্লাহ মুনির স্পষ্টভাবে বলেছেন, তাদের কাছে পিএইচডি বা মাস্টার্স ডিগ্রির কোনো মূল্য নেই। কারণ, তারা ধর্মীয় নেতা ও মৌলভীদের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করতে চায়।

ডেইলি স্টার: আপনি কি মনে করেন তালেবানরা আন্তর্জাতিক জিহাদিদের আশ্রয় দিয়ে তাদের ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে?

হাবিব: আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর স্বীকৃতির জন্য তালেবান নেতারা নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক জিহাদিদের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবে। কিন্তু, শীর্ষ নেতাদের পক্ষে আঞ্চলিক ও স্থানীয় নেতৃত্বকে জিহাদিদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করানোর কাজটি করানো কঠিন হবে। তারা এখনও তালেবান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।

ডেইলি স্টার: তালেবান শাসনে আফগানদের ভাগ্যে কী আছে?

হাবিব: লক্ষণ আশাব্যঞ্জক নয়। আমি মনে করি, আমরা আরেকটি গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছি।

অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

Khagrachhari violence: 3 dead, 4 sent to CMCH 'with bullet wounds'

Three indigenous people died of their injuries at a hospital in Khagrachhari yesterday and early today, hours after arson attacks and violence in the district

2h ago