ত্বকী হত্যা: প্রত্যাশার আগুন নেভেনি এখনও

২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘রিজওয়ানুর বৃত্ত’ নামের একটি অ্যালবামে শিল্পী কবির সুমন গেয়েছিলেন, ‘হয়ে যাবে ব্যবস্থা, মিটে যাবে সব/টাকা যদি থাকে তবে, সবই সম্ভব/তা ছাড়াও যদি থাকে, সরকারে হাত/ঘটে যাবে ভোজবাজি, দিন হবে রাত…’।
তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ছবি: সংগৃহীত

২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘রিজওয়ানুর বৃত্ত’ নামের একটি অ্যালবামে শিল্পী কবির সুমন গেয়েছিলেন, ‘হয়ে যাবে ব্যবস্থা, মিটে যাবে সব/টাকা যদি থাকে তবে, সবই সম্ভব/তা ছাড়াও যদি থাকে, সরকারে হাত/ঘটে যাবে ভোজবাজি, দিন হবে রাত…’।

সে সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারের ছেলে রিজওয়ানুরের মৃত্যু ও এর সঙ্গে এক প্রভাবশালী শিল্পপতি পরিবারের সংশ্লিষ্টতাকে উপজীব্য করে গানটি বেঁধেছিলেন সুমন।

গানের আরেক জায়গায় সুমন বলেন, ‘ওরা দেবে প্রস্তাব, এরা দেবে সায়/এইভাবে দিন আসে, আর দিন যায়/এইভাবে চাপা পড়ে, যায় কঙ্কাল/কবরে ঘাস গজায়, দেখে মহাকাল…’।

চাইলে সুমনের গানের এই চরণগুলো আট বছরেরও বেশি সময় আগে নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত আলোচিত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ অপহরণের দুদিন পর ত্বকীর মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীর শাখাখাল থেকে। এর এক বছর পর সংবাদ সম্মেলন করে কোথায়, কার নির্দেশে, কীভাবে ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছিল তার বিস্তারিত জানিয়েছিল মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব।

হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ভাতিজা এবং নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমান তখন আত্মগোপনে ছিলেন। আর এখন গোটা নারায়ণগঞ্জ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। শহরের ছেয়ে যাওয়া পোস্টার, বিলবোর্ডে শোভা পাচ্ছে আজমেরীর ছবি।

অন্যদিকে ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বী প্রতি মাসের ৮ তারিখে ছেলের হত্যার বিচার চেয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে যাচ্ছেন। বুকের মধ্যে এখনও তিনি পুষে রেখেছেন প্রত্যাশার আগুনটাকে।

আগামী ৮ জুলাই ত্বকী হত্যাকাণ্ডের ১০০ মাস পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এ দিন ত্বকী হত্যার বিচারের দাবিতে আরেকটু বড় পরিসরে সারা দেশে একযোগে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি পালন করবে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট।

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী এ লেভেল প্রথম পর্বের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। নারায়ণগঞ্জের সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে যেদিন তিনি অপহৃত হন, তার একদিন পরই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় ত্বকীর।

সন্তান হত্যার শোক ছাপিয়ে তার বিচারের জন্য এই যে নিদারুণ অপেক্ষা, আর সে ব্যাপারে বাবা রফিউর রাব্বীর যে ভাষ্য, তার পুরোটাই মিলে যায় সুমনের গানের পঙক্তিগুলোর সঙ্গে।

গতকাল সোমবার রাব্বী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ত্বকী হত্যার সমস্ত রহস্য তদন্তকারী সংস্থা আগেই উদঘাটন করেছে। তারা সংবাদ সম্মেলন করেও জানিয়েছে যে কারা, কখন, কীভাবে, কেন এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। কিন্তু বিষয় হচ্ছে সরকারের অনিচ্ছার কারণেই বিচারটা বন্ধ হয়ে আছে। তৈরি করে রাখা অভিযোগপত্রটাও তো আদালতে দেওয়া হয়নি।’

এ ব্যাপারে রফিউর রাব্বীর উপলব্ধি হলো, ‘ত্বকীর ঘাতক যারা, তারা সবাই সরকার সংশ্লিষ্ট। তাই সরকারই এই মুহূর্তে চাচ্ছে না যে বিচারটা হোক। এটাই হচ্ছে বিষয়। সরকারের জন্যই বিচারটা বন্ধ হয়ে আছে।’

২০১৪ সালের ৫ মার্চ র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। ২০১১ সালে সিটি নির্বাচনে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া, সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের চাঁদাবাজি ও ভূমি দখলের প্রতিবাদে জনগণকে সংগঠিত করায় রফিউর রাব্বির ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সংসদ সদস্য ও তার অনুগতরা। তাকে শায়েস্তা করতেই ছেলেকে হত্যা করেন তারা।

আজমেরী ওসমানের বিষয়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বী বলেন, ‘আজমেরী ওসমান এখন নারায়ণগঞ্জেই বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার পোস্টার, বিলবোর্ডে শহর ছেয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখছি। আর বিচার চেয়ে বেড়াচ্ছি।’

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর বক্তব্যও একই রকম। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘র‌্যাবের তদন্তে যাদের নাম এসেছিল, তারা প্রশাসনের ছত্রছায়াতেই এই শহরে বসবাস করছে। তারা যেহেতু প্রভাবশালী, রাষ্ট্রের প্রশাসন যেহেতু তাদের সহায়তা করে, সেহেতু এর বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’

ত্বকী হত্যা মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ বাবু বলেন, ‘(মামলার) কোনো অগ্রগতিই নেই। আমরা বহুবার আদালতকে তাগিদ দিয়েছি। আদালতও তদন্তকারী সংস্থাকে অভিযোগপত্র দেওয়ার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু তারা (তদন্তকারী সংস্থা) এর কোনো উত্তর দেয়নি। কিংবা কী কারণে, কেন দেরি হচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।’

হত্যাকাণ্ডের ১০০ মাস পার হতে চললেও মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশার ভাষ্য, ‘(তদন্ত) কার‌্যক্রম চলছে। আমিও রিসেন্টলি জয়েন করেছি এখানে। এখনও ফাইনাল কিছু হয়নি।’

বিলম্বের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তানভীর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এটা একটা লম্বা প্রক্রিয়া। এ ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয়েছে। যে কারণে লেনদি হয়েছে।’

তদন্তের কাজ দ্রুত শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে র‌্যাব অধিনায়ক আরও বলেন, ‘হতে পারে। আমি নতুন এসেছি। নতুন করেই দেখছি বিষয়টা।’

ত্বকী হত্যাকাণ্ডের ১০০ মাস পূর্তিতে এই হত্যার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে আগামী ৮ মার্চ সন্ধ্যার পর দেশব্যাপী মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের সদস্যসচিব হালিম আজাদ। তিনি বলেন, ‘জোটের পক্ষ থেকে সারা দেশের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। করোনার কারণে ৮ জুলাই সূর‌্যাস্তের পর যার যার অবস্থানে থেকে জেলায় জেলায় একযোগে এই কর্মসূচি পালনের ব্যাপারে সবাই সম্মত হয়েছেন।’

বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ এই কবি ও সংগঠক বলেন, ‘১০০ মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ একটা হত্যাকাণ্ডের তদন্তই শেষ হলো না। এটা খুবই দুঃখজনক।’ তারও ভাষ্য, যারা ত্বকীকে হত্যা করেছে, ওই চক্রটাই এই বিচারটাকে ধাপাচাপা দিয়ে রেখেছে। কারণ তারা সরকারি দল করে।

এর আগে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ত্বকী হত্যার বিচারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও হস্তক্ষেপ চেয়ে দেশের ২৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, এ বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা যেমনি উৎসাহিত হচ্ছে, অপর দিকে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। একটি বিচারহীনতা অসংখ্য বিচারহীনতার পথ তৈরি করে দেয়। বছরের পর বছর বিচার বন্ধ হয়ে থাকা কখনো কাম্য হতে পারে না।

২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল শামীম ওসমানের ভাই সংসদ সদস্য নাসিম ওসমান মারা যাওয়ার পর জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী ওসমান পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছিলেন।

বাবা রফিউর রাব্বীসহ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তিবর্গের বক্তব্য, কার‌্যত এরপর থেকেই ত্বকী হত্যার তদন্ত থেমে যায়।

Comments

The Daily Star  | English
Prime Minister Sheikh Hasina

Take effective steps to get maximum benefit after LDC graduation: PM

Prime Minister Sheikh Hasina today asked all concerned to take effective steps for availing maximum benefits and facilities after the country's graduation from LDC status in 2026 and also to devise strategies to face the challenges following the graduation

1h ago