থেমে আছে যুদ্ধাপরাধের বিচার

করোনা মহামারিসহ অন্যান্য কারণে প্রায় ২০ মাস ধরে কার্যক্রম স্থগিত থাকায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধের মামলা এবং এ সংক্রান্ত আপিল জমে আছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ছবি: সংগৃহীত

করোনা মহামারিসহ অন্যান্য কারণে প্রায় ২০ মাস ধরে কার্যক্রম স্থগিত থাকায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধের মামলা এবং এ সংক্রান্ত আপিল জমে আছে।

এ সময়ের মধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলে ভুক্তভোগী ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবারসহ বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।

আইসিটিতে এখন মোট ৩৬টি মামলা বিচারাধীন। এ ছাড়া, ২ হাজার ৭৪৪ জন সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে ৪৫৯টি অভিযোগের তদন্ত এবং আইসিটির রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে দায়ের করা ২০ টি আপিল বিচারাধীন আছে বলে জানিয়েছে আইসিটি প্রসিকিউশন এবং তদন্ত সংস্থা সূত্র।  

মহামারি চলাকালে আইসিটির একজন বিচারক, প্রধান তদন্তকারী এবং একজন সিনিয়র প্রসিকিউটরের মৃত্যুর ফলে সমস্যা আরও বেড়ে যায়।

হাইকোর্ট ও নিম্ন আদালত তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্যান্য মামলার বিচার করছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছেই।

বিচারের ধীর গতিতে হতাশা প্রকাশ করে বিশিষ্ট যুদ্ধাপরাধ গবেষক শাহরিয়ার কবির বলেন, 'যুদ্ধাপরাধের বিচার দীর্ঘ সময়ের জন্য থেমে থাকলেও, অন্যান্য মামলার আদালত তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে চলছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।'

তিনি সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা লক্ষ্য করেছি, যুদ্ধাপরাধের মামলার বিচারের বিষয়ে সরকারের আগ্রহ গত কয়েক বছরে কমে গেছে।'

শাহরিয়ারের মতে, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগীদের বিচার ও শাস্তি দেওয়া হলেও সরকার তাদের হাই কমান্ড এবং 'যুদ্ধাপরাধী সংগঠন', বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর বিচারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত মামলার বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে ২টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকেই আবার চালু করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'সরকার এসব মামলার আপিলের দ্রুত শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য আপিল বিভাগে কয়েকজন বিচারক নিয়োগ করতে পারে। কারণ আইসিটি অনেক মামলার চাপে আছে।'

আইসিটির প্রসিকিউটর তাপস কান্তি পাল জানান, গত বছর ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিচারপতি আমির হোসেন অসুস্থ হয়ে পড়ায় এর কার্যক্রমের গতি ধীর হয়ে পড়ে। চলতি বছরের ২৪ আগস্ট তিনি মারা যান।

এ ছাড়া, আইসিটির প্রধান তদন্তকারী আবদুল হান্নান খান গত বছরের ২৯ নভেম্বর করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সিনিয়র প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম মারা যান চলতি বছরের ২৭ জুন।  

তাপস বলেন, 'মহামারি পরিস্থিতির এখন উন্নতি হয়েছে। আমরা দ্রুত আইসিটির কাছে যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত মামলাগুলো নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী।'

 তিনি আরও বলেন, 'গ্রেপ্তার অভিযুক্তদের মহামারির কারণে কারাগার থেকে আইসিটিতে আনা যায়নি।'

সাক্ষীদের জবানবন্দি ও জেরার সময় আইসিটির সামনে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আসামির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক বলে জানান তিনি।

বিচারপতি আমিরের মৃত্যুর পর শূন্য পদ পূরণের জন্য সরকার গত ১৪ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমকে আইসিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়।

তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বিচারপতি আমিরের মৃত্যুর পর থেকে তদন্ত সংস্থা সীমিত পরিসরে কাজ করছে। তবে আইসিটির বিচার আবার শুরু হওয়ার পর তারা তাদের কার্যক্রম বাড়াবে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য এখন পর্যন্ত ২টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ১০০ জনের বিচার করেছে। তাদের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে গত ১১ বছরে।

তবে যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত ২২টি মামলার আপিলের শুনানি প্রায় ২০ মাস ধরে আপিল বিভাগে ঝুলে আছে।

দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুসারে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি-১) গঠন করে।

'এ বিচার ত্বরান্বিত করার জন্য ২০১২ সালের ২২ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি-২) গঠিত হয়। কিন্তু মামলার সংখ্যা কমে যাওয়ায় সরকার ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে একটি ট্রাইব্যুনালকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে।

ট্রাইব্যুনালের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আইসিটি-১ যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত মামলায় ৩১টি রায় দিয়েছেন।

আর ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত আইসিটি -২ এ ধরনের মামলাযর রায় দিয়েছেন ১১টি।

বিভিন্ন আইনি বিষয়ে গবেষণা পরিচালনাকারী ল চেম্বার 'ল ল্যাবের' এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫২ জন পলাতক আসামিসহ এখন পর্যন্ত মোট ১০০ জনের বিচার কাজ সম্পন্ন করেছেন ২টি ট্রাইব্যুনাল।

এ ১০০ জনের মধ্যে ৬৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ২৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫ জনকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড, একজনকে (গোলাম আযম) ৯০ বছরের কারাদণ্ড এবং একজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

ল ল্যাবের প্রধান অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ডেইলি স্টারকে জানান, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সর্বোচ্চ ৩৪টি আপিল দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি আপিল নিষ্পত্তি করা হয়েছে এবং অভিযুক্ত গোলাম আযম, মাওলানা আবদুস সোবহান এবং আব্দুল আলিমের করা অন্য ৩টি আপিল তাদের মৃত্যুর পর বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।

আপিল বিভাগ সবশেষ ১০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত আপিলের শুনানি করেন। সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার ২০১৪ সালে তাকে দেওয়া আইসিটির মৃত্যুদণ্ডের রায় চ্যালেঞ্জ করে এটি দায়ের করেছিলেন।

অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

Heatwave: Secondary schools, colleges in several districts closed tomorrow

All secondary schools, colleges, madrasas, and technical education institutions in several districts across the country including Dhaka, will be closed tomorrow due to the ongoing heatwave

47m ago