একাত্তরের আপনজন

৩০ মার্চ, ১৯৭১। ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকার বুকে সংঘটিত ভয়াল গণহত্যার প্রত্যক্ষ চিত্র তুলে ধরে লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো সাংবাদিক সায়মন ড্রিংয়ের প্রতিবেদন ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’।
ছবিতে (ক্লকওয়াইজ) সায়মন ড্রিং, মার্ক টালি, সিডনি শেনবার্গ, মাইকেল লরেন্ট ও অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ছবি: সংগৃহীত

৩০ মার্চ, ১৯৭১। ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকার বুকে সংঘটিত ভয়াল গণহত্যার প্রত্যক্ষ চিত্র তুলে ধরে লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো সাংবাদিক সায়মন ড্রিংয়ের প্রতিবেদন 'ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান'।

ওই প্রতিবেদনে সায়মন ড্রিং লিখলেন, 'আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত সন্ত্রস্ত এক নগর।'

টেলিগ্রাফের পাতায় প্রকাশিত সায়মন ড্রিংয়ের ওই প্রতিবেদনটি ছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় পাকিস্তানি গণহত্যার প্রথম বিবরণ। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি বাহিনীর নিধনযজ্ঞের খবর পৌঁছে গেল পুরো বিশ্বের কাছে।

২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তৈরি করেছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার নজির। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়জুড়ে চালানো পাক বাহিনীর নৃশংস কর্মকাণ্ডের খবর যেন বিশ্বপরিসরে ছড়িয়ে না পড়ে, তার জন্য সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার।

এ সময় জীবন বাজি রেখে অনেক বিদেশি সাংবাদিক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন। সেগুলো প্রকাশ করেছিলেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এভাবে দুর্গম সংবাদপ্রবাহের সেই সময়েও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর দ্রুত দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে পাক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার খবরের পাশাপাশি পৃথিবীর মানুষ জানতে পেরেছিল মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের সমাচার।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বিশ্ব গণমাধ্যমে বহুল আলোচিত ঘটনা। সে সময় পশ্চিমা সরকারগুলো বাঙালির এই মুক্তিপ্রয়াসের বিরোধিতা করলেও সায়মন ড্রিংয়ের মতো অনেক সাংবাদিক মানবতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। দাঁড়িয়েছিলেন বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ন্যায্যতার পক্ষে। এভাবে ভিনদেশি হয়েও তারা হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির একান্ত আপনজন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের করা সব প্রতিবেদন, আলোকচিত্র ও ভিডিও ফুটেজ কেবল বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিতই করেনি, সময়ের পরিক্রমায় তা হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল।

পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেওয়ার ৫১তম বার্ষিকীতে এমন কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ভূমিকা স্মরণ করছে দ্য ডেইলি স্টার।

সায়মন ড্রিং

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নিধনযজ্ঞের খবর বিশ্বের কাছে সবার আগে পৌঁছে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফের হয়ে কাজ করছিলেন কম্বোডিয়ায়। ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে মার্চে লন্ডনের হেড অফিস থেকে তাকে পূর্ব পাকিস্তানে যেতে বলা হয়।

সেই খবর সংগ্রহ করতে ৬ মার্চ ঢাকায় নামেন সায়মন ড্রিং। পরদিন ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণও তিনি প্রত্যক্ষ করেন।

সায়মন ড্রিং ঢাকায় এসেছিলেন সপ্তাহখানেকের সময় নিয়ে। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে তিনি থেকে যান। বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির খবর তিনি নিয়মিত পাঠাতেন লন্ডনে।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করার আগে ঢাকায় অবস্থানরত প্রায় অর্ধশত বিদেশি সাংবাদিককে আটকে ফেলে তখনকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। পরদিন তাদের হোটেল থেকে সরাসরি উড়োজাহাজে তুলে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়, যাতে গণহত্যার কোনো খবর সংগ্রহ করতে না পারে বিশ্ব গণমাধ্যম।

কিন্তু সায়মন ড্রিং পাকিস্তানিদের নির্দেশ না মেনে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলেই লুকিয়ে থাকেন। শ্বাসরুদ্ধকর ৩২ ঘণ্টা সময় কাটে হোটেলের লবি, ছাদ, বার ও কিচেনের মতো জায়গাগুলোতে।

২৭ মার্চ কারফিউ উঠে গেলে সায়মন ড্রিং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পুরাণ ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘুরে দেখেন। পরে অক্ষত অবস্থায় সবগুলো নোটবুক সঙ্গে নিয়ে থাইল্যান্ডে চলে যান।

পরে ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয় সায়মন ড্রিংয়ের প্রতিবেদন 'ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান'।

ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর লন্ডনে ফিরে গেলেও ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত জেনে আবার তিনি ঢাকায় আসেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনও তিনি ঢাকায় ছিলেন।

একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো এই ব্রিটিশ সাংবাদিককে ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননায় ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ছিলেন করাচির মর্নিং নিউজের সাংবাদিক ও ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাতা।

একাত্তরে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাসকারেনহাসসহ ৮ জন সাংবাদিককে পূর্ব বাংলায় নিয়ে আসে। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের ঢাকা, কুমিল্লা, যশোরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে দেখায়। বোঝাতে চেষ্টা করে এখানকার পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক।

এই সাংবাদিকদের মধ্যে সবাই পাকিস্তান সরকারের চাহিদা অনুসারে প্রতিবেদন করলেও ব্যতিক্রম ছিলেন মাসকারেনহাস। করাচি ফিরে তিনি ১৮ মে লন্ডনে হাজির হন সানডে টাইমসের দপ্তরে। সেখানে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি।

একাত্তরের ১৩ জুন সানডে টাইমস ২ পৃষ্ঠাজুড়ে মাসকারেনহাসের প্রতিবেদনটি ছাপে। শিরোনাম ছিল এক শব্দের, 'জেনোসাইড'।

সেই প্রতিবেদনে মাসকারেনহাস লেখেন, 'পূর্ব বাংলার শ্যামল প্রান্তরজুড়ে আমি আমার প্রথম চাহনিতেই জমাট রক্তপুঞ্জের দাগ দেখতে পেয়েছিলাম। এই সংঘবদ্ধ নিপীড়নের শিকার কেবল হিন্দুরাই নয়, হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানও এ নির্মমতার শিকার।'

পরবর্তীতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সানডে টাইমসের সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্সকে জানিয়েছিলেন, লেখাটি তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। এটি তাকে ইউরোপীয় রাজধানীগুলো আর মস্কোতে ব্যক্তিগতভাবে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে উৎসাহ দেয়, যাতে এই যুদ্ধে ভারত সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করতে পারে।

মাইকেল লরেন্ট

২৫ মার্চের গণহত্যার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) আলোকচিত্রী মাইকেল লরেন্ট।

এ সময় তিনি ও সায়মন ড্রিং কর্মচারীদের সহযোগিতায় হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের একটা রান্নাঘরে লুকিয়ে ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালে ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ উঠলে তারা ২ জন একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েন। দেখেন সড়ক, ছাত্রাবাস, বস্তি—সর্বত্র ধ্বংসযজ্ঞ, লাশ পড়ে আছে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে।

পরে পাকিস্তানি সেনাদের চোখ এড়িয়ে মাইকেল লরেন্ট তার ছবিগুলো পাঠান জার্মান দূতাবাসের মাধ্যমে।

সিডনি শনবার্গ

একাত্তরে মার্কিন সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ ছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ২৫ ও ২৬ মার্চ ঢাকায় ছিলেন তিনি। গণহত্যার খবর প্রচার করায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে। এরপরও তিনি বারবার ফিরে এসেছেন সীমান্ত এলাকায়। কখনো ঢুকে গেছেন মুক্তাঞ্চলে। কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকসহ বহু প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে।

নিউইয়র্ক টাইমসে 'ইন ঢাকা, ট্রুপস ইউজ আর্টিলারি টু হেল্ট রিভোল্ট' শিরোনামে শনবার্গের যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছিল, তাতে তিনি এই সামরিক অভিযানকে বর্ণনা করেন 'পাইকারি হত্যাকাণ্ড' হিসেবে।

১৬ ডিসেম্বর শনবার্গ মিত্রবাহিনীর ট্যাংকে চড়ে ঢাকায় আসেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানেও তিনি উপস্থিত ছিলেন।

পরে সিডনি শনবার্গ কম্বোডিয়ার গণহত্যার সংবাদভাষ্য প্রদান করে খ্যাতি অর্জন করেন। এটি তাকে পুলিৎজার পুরস্কার এনে দেয়।

মার্ক টালি

একাত্তরে বিবিসির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা মার্ক টালিও ২৫ মার্চের বর্বর হামলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পরে তাকে ঢাকা ছেড়ে যেতে হয়। অবশ্য জুনের তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বিদেশি সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তান সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে বিবিসি তাকে আবার বাংলাদেশে পাঠায়।

যুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে রেডিওতে কান পেতে সকাল-সন্ধ্যা মার্ক টালির কণ্ঠ শোনার অপেক্ষায় থাকত পুরো দেশ। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনেও তার ভূমিকা ছিল অনন্য।

দ্বিতীয় দফায় মার্ক টালি ঢাকায় না এলেও তিনি সীমান্তবর্তী বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও জেলাগুলো ঘুরে বাঙালির দুর্দশা ও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির খবর পাঠাতে থাকেন দিল্লি থেকে।

ভারতীয় গণমাধ্যম

একাত্তরে পাকিস্তানিদের বর্বরতা ও বাঙালির প্রতিরোধযুদ্ধের খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল কলকাতা ও আগরতলার বাংলা পত্রিকাগুলো।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ডিসেম্বরের দিকে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে গিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন করেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলম ধরেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো লেখক-কবিরাও।

এর পাশাপাশি আকাশবাণীতে ভরাট কণ্ঠে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুদ্ধের সংবাদ পর্যালোচনাও ছিল হৃদয়কাড়া।

Comments

The Daily Star  | English
Are schools open? Simple issue unnecessarily complicated

Are schools open? Simple issue unnecessarily complicated

Are the secondary schools and colleges open today? It is very likely that no one can answer this seemingly simple question with certainty.

1h ago