বাংলাদেশ

কারখানা খুলে দেওয়ার অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে বিশৃঙ্খলা, ভোগান্তি

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে চলমান ‘কঠোর বিধিনিষেধের’ মধ্যে রপ্তানিমুখী কারখানা খুলে দিয়ে পুরোপুরি বিশৃঙ্খল একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে সরকার।

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে চলমান 'কঠোর বিধিনিষেধের' মধ্যে রপ্তানিমুখী কারখানা খুলে দিয়ে পুরোপুরি বিশৃঙ্খল একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে সরকার।

সারা দেশে প্রায় ৪০ লাখ কারখানা শ্রমিক আছেন এবং তাদের প্রায় ৭০ শতাংশের কর্মস্থলই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে। গত শুক্রবার রাতে যখন সরকার খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়, কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার জন্য তাদের হাতে তখন কেবল একদিন সময় ছিল।

বিধিনিষেধের মধ্যে সব গণপরিবহন বন্ধ আছে। এ অবস্থায় ঈদুল আযহা উদযাপনের জন্য গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করা শ্রমিকরা কীভাবে তাদের কর্মস্থলে ফিরে আসবেন- কর্তৃপক্ষ তা একবারও ভেবে দেখেনি।

শনিবার সকালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার শ্রমিক তাদের কর্মস্থলের জন্য যাত্রা শুরু করেন। পরিবহনের অভাবে রাস্তায় অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের।

সন্ধ্যায় গিয়ে শ্রমিকদের এ দুর্দশার ব্যাপারে টনক নড়ে নীতিনির্ধারকদের। কয়েক ঘণ্টা পর তারা রোববার দুপুর পর্যন্ত ১৬ ঘণ্টা গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেন। কিন্তু ততক্ষণে হাজার হাজার শ্রমিক তাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন। দুর্ভোগের এ যাত্রার সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব না হওয়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে তাদের।

তা ছাড়া, মাত্র ১৬ ঘণ্টার জন্য গণপরিবহন চালু করার বিষয়টি খুব বেশি কার্যকর সিদ্ধান্ত নয়। কারণ, খুব অল্প সংখ্যক বাস ও লঞ্চই এত সংক্ষিপ্ত নোটিশে কাজ শুরু করতে পারে। রেল কর্তৃপক্ষ এ সংক্ষিপ্ত সময়ে ট্রেন চালু করার ব্যবস্থা করতে পারেনি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। তাদের ভোগান্তির জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী।'

সিদ্ধান্ত

গত ১৩ জুলাইয়ের গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানায়, ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে কঠোর বিধিনিষেধ থাকবে এবং এ সময় সব কারখানা বন্ধ থাকবে।

গত ২৭ জুলাই একটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সরকার বিধিনিষেধের মধ্যে কারখানা খোলার জন্য পোশাক কারখানার মালিকসহ ব্যবসায়ীদের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে।

কিন্তু, শুক্রবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, 'সামগ্রিক পরিস্থিতি' বিবেচনায় রোববার থেকে সব রপ্তানিমুখী কারখানা ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিট বিধিনিষেধের আওতামুক্ত থাকবে।

তবে, ঈদের আগে বাড়ি চলে যাওয়া হাজার হাজার শ্রমিক গণপরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় কীভাবে কর্মস্থলে কীভাবে ফিরবে- তা নিয়ে কিছুই বলা হয়নি এতে। ফলে মোটরবাইক, ট্রাক, পিক-আপ ও থ্রি-হুইলারে চড়ে হাজার হাজার শ্রমিক শনিবার সকালে কর্মস্থলের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে যেতে শুরু করেন এবং স্বাভাবিক কারণেই চরম ভোগান্তিতে পড়েন।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার পোশাক শ্রমিক ইরানি বেগম এ শ্রমিকদের একজন। ছুটিতে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন তিনি।

কারখানা চালু হওয়ার খবর পেয়ে শনিবার সকালে ইরানি ও তার চার সহকর্মী প্রত্যেকে ১০০ টাকা দিয়ে একটি থ্রি-হুইলারে করে শেরপুর থেকে বগুড়া পৌঁছান। এরপর তারা আরও প্রায় ৫০ জনের সঙ্গে একটি ট্রাকে করে ঢাকার দিকে রওনা হোন। গাজীপুরের চন্দ্রায় যেতে তাদের প্রত্যেকের ৬০০ টাকা করে খরচ হয়। পরে তারা আরেকটি ট্রাক নিয়ে সাভারের আমিনবাজারে পৌঁছান। এ দফায় সবার ১০০ টাকা করে খরচ হয়।

দ্য ডেইলি স্টারের একজন প্রতিবেদক শনিবার সন্ধ্যায় গাবতলী বাস টার্মিনালের কাছাকাছি স্থানে ইরানির সঙ্গে কথা বলেছেন। রামপুরা যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলেন তিনি। রিকশাচালকরা ভাড়া চাচ্ছিলেন ৪০০ টাকা।

ইরানি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারখানা কর্তৃপক্ষ আমাকে ঢাকা আসতে বাধ্য করেনি। আমি আসলে চাকরি বাঁচাতে ফিরে এসেছি।'

ইরানির মতো আরও হাজার হাজার শ্রমিক যখন ঝুঁকি নিয়ে এবং স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে কোনোমতে ঢাকায় পৌঁছাতে সক্ষম হোন, অনেকে তখনও রাস্তায় ও ফেরিঘাটেই ছিলেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য যানবাহন খুঁজছিলেন তারা।

শনিবার সন্ধ্যায় প্রায় এক লাখ মানুষ পদ্মা পার হওয়ার জন্য বাংলাবাজার ফেরিঘাটে অপেক্ষা করছিল বলে জানিয়েছেন আমাদের মুন্সীগঞ্জ সংবাদদাতা।

বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোও শ্রমিকদের দিনভর ভোগান্তির কথা জানিয়েছে।

কয়েক ঘণ্টার বাস ও লঞ্চ সেবা

শনিবার রাত ৮টার দিকে কর্তৃপক্ষ গতকাল দুপুর পর্যন্ত ১৬ ঘণ্টার জন্য গণপরিবহন চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। বাস মালিকরা এ সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারলেও, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রাত ৯টা পর্যন্ত এ বিষয়ে জানতেন না।

শনিবার রাত ৯টার দিকে এ সংবাদদাতা যখন বিআরটিএ'র একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন, তখন ওই কর্মকর্তা বলেন, 'আমাদের এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়নি।'

প্রায় আধা ঘণ্টা পর বিআরটিএর আরেক কর্মকর্তা জানান, বাস চলাচল শুরুর ব্যাপারে তারা তখনও কোনো 'লিখিত নির্দেশনা' পাননি। তবে, মৌখিকভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানানো হয়েছে।

তিনি বলেন, 'আমরা বাস চালু করার ব্যাপারে কোনো বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছি না। কিন্তু যদি কেউ আগামীকাল (রোববার) পর্যন্ত শ্রমিকদের জন্য বাস বা অন্যান্য যানবাহন চালায়, তাহলে কেউ তাদের বাধা দেবে না।'

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহর সঙ্গে রাত ৯টা ৪৫ মিনিটের দিকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে পেরেছেন।

এর আগে রাত ৯টার দিকে এ সংবাদদাতা বাংলাদেশ রেলওয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন। ট্রেন চালু করার কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতেন না তিনি।

পরে রেল কর্তৃপক্ষ এ 'সংক্ষিপ্ত সময়ের' জন্য ট্রেন চালু না করার সিদ্ধান্ত নেয়। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এত সংক্ষিপ্ত নোটিশে ট্রেন চালু করা সম্ভব না। এর জন্য কিছু প্রস্তুতি প্রয়োজন। তাই কোনো ট্রেন চালু করা হয়নি।'

বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, এ সংক্ষিপ্ত সময়ে অল্প সংখ্যক বাস চলাচল করেছে।

তিনি বলেন, 'আসলে এত অল্প সময়ের জন্য বাস চলাচল চালু করা সম্ভব ছিল না। ডিপোর কাছে থাকা কিছু চালক হয়তো বাস চালাতে পারতেন। অনেকে বাস চালু হওয়ার বিষয়টি জানতেনও না।

লঞ্চ রুটে দেখা গেছে দুই ধরনের চিত্র।

আমাদের বরিশাল সংবাদদাতা জানিয়েছেন, গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশে কোনো লঞ্চ ছাড়েনি।

লঞ্চ মালিকরা জানিয়েছেন, চলমান লকডাউনের কারণে তাদের অনেক কর্মী ছুটিতে চলে যাওয়ায় তারা লঞ্চ চালু করতে পারেননি। এ ছাড়া, অনেকে ইতোমধ্যেই সড়ক পথে ঢাকায় পৌঁছে যাওয়ায় বরিশাল থেকে যাত্রীর সংখ্যাও কম ছিল।

বরিশালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গতকাল রাতে বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে মাত্র তিনটি লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার কথা।

তবে, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২ টি লঞ্চ চাঁদপুর থেকে ঢাকায় পৌঁছেছে। প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে সবগুলো লঞ্চ নির্ধারিত সময়ের আগেই ছাড়া হয় বলে আমাদের চাঁদপুর সংবাদদাতা জানিয়েছেন।

এ ছাড়া, গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ভোলা থেকে ১৩টি এবং এবং বরগুনা থেকে তিনটি লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।

শ্রমিকদের জন্য বিআইডব্লিউটিএ আজ সোমবার ভোর ৬টা পর্যন্ত লঞ্চ চলাচলের সময়সীমা বাড়িয়েছে।

 

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম।

Comments

The Daily Star  | English

There is a reason why daily news has become so depressing

Isn't there any good news? Of course, there is. But good news doesn't make headlines.

10h ago