চিড়িয়াখানা থেকে আপনিও কিনতে পারেন হরিণ কিংবা ময়ূর

চলতি বছর করোনা মহামারির মধ্যে জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ ৪৭টি চিত্রা হরিণ বিক্রি করেছে, যা আগের পাঁচ বছরের হরিণ বিক্রির সমান। এতে চিড়িয়াখানার আয় হয়েছে ৩২ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
ছবি: পলাশ খান

চলতি বছর করোনা মহামারির মধ্যে জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ ৪৭টি চিত্রা হরিণ বিক্রি করেছে, যা আগের পাঁচ বছরের হরিণ বিক্রির সমান। এতে চিড়িয়াখানার আয় হয়েছে ৩২ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, এখনো তাদের কাছে ধারণক্ষমতার চেয়ে অন্তত ১০০টি হরিণ বেশি রয়েছে। প্রতি জোড়া হরিণ তারা এক লাখ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। আর ময়ূর বিক্রি করে প্রতি জোড়া ৫০ হাজার টাকায়।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ২০১৬ সালে ২১টি চিত্রা হরিণ বিক্রি করেছিল তারা। ২০১৭ সালে দুইটি, ২০১৮ সালে ১২টি, ২০১৯ সালে চারটি, ২০২০ সালে আটটি হরিণ বিক্রি হয়। আর গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট তারা পর্যন্ত ৪৭টি হরিণ বিক্রি করেছে।

চিড়িয়াখানার বৃহৎ প্রাণী শাখার প্রধান ডা. মো. ওসমান গনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বন বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে আমরা এগুলো বিক্রি করে থাকি। হরিণ কেনার অনুমতি দেওয়ার জন্যে বন অধিদপ্তরের ইন্সপেকশন দল সরেজমিন যাচাই করে দেখে যে, যিনি কিনবেন, তার সেগুলো লালন-পালন করার সামর্থ্য আছে কি না। সাধারণত বড় ব্যবসায়ীরা নিজেদের বাড়িতে বা খামারে রাখার জন্যে এগুলো কিনেন। তবে, এগুলো অবশ্যই খাওয়ার জন্যে নয়।'

'কেউ এগুলো কিনলে বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারা এর লালন-পালনে সহযোগিতা করেন। তা ছাড়া, স্থানীয় পশু হাসপাতালকেও যেকোনো সহযোগিতার জন্যে এ তথ্য জানিয়ে রাখা হয়। একইসঙ্গে প্রতি বছর এগুলোর বিপরীতে ট্যাক্স দিতে হয়', যোগ করেন তিনি।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ময়ূর বিক্রি শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে। ওই বছর ছয়টি, ২০১৮ সালে ২০টি, ২০১৯ সালে ২৪টি ও ২০২০ সালে আটটিসহ মোট ৫৪টি ময়ূর বিক্রি করেছে তারা। প্রতিটি ২৫ হাজার টাকা করে এই বাবদ আয় করেছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

তবে, এ বছর তারা এখনো কোনো ময়ূর বিক্রি করেনি।

পাখি সেকশনের প্রধান ডা. মো. ওয়ালিউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ময়ূরের ডিম দেওয়া শেষের পথে। সেগুলোর বাচ্চা হলে যদি আমাদের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়, তখন আমরা আবার ময়ূর বিক্রি করব। ময়ূরের চাহিদা অনেক। কিন্তু, ময়ূর তিন বছর পরপর ডিম দেওয়ায় এটার কিছুটা সংকট রয়েছে। তা ছাড়া, এটা তো আর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান না। আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলে সেগুলো বিক্রি করা হবে।'

চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. আব্দুল লতীফ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন আমাদের কাছে এক-দুই মাস বয়সী ১৩০টি ময়ূরের বাচ্চা আছে। ইনকিউবেটরে আরও ২০-৩০টি ডিম ফোটার অপেক্ষায়। আশা করছি আগামী সেপ্টেম্বর থেকে ময়ূর বিক্রি শুরু করতে পারব।'

চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের মিনি চিড়িয়াখানা ও দর্শনীয় স্থানেই বেশিরভাগ ময়ূর বিক্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নাটোরের উত্তরা গণভবন, বিমান বাহিনী জাদুঘর, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশের মিনি চিড়িয়াখানা। আর হরিণগুলো সাধারণত মিনি চিড়িয়াখানা, ব্যক্তিগত উদ্যোগে পালন কিংবা গড়ে ওঠা ছোট খামারে নিয়ে যাওয়া হয়।

সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ মাসখানেক আগে এক জোড়া হরিণ কিনেছেন। তিনি বলেন, 'আমার এলাকায় একটি পার্কের মতো জায়গা আছে। সেখানেই হরিণ দুটো আছে। ওরা ভালো ও সুস্থ আছে। আনার পর শারীরিকভাবে কোনো সমস্যা হয়নি। মানুষজন দেখতে আসে, আনন্দ পায়।'

'সৌখিনতার জায়গা থেকে পার্কটাকে বাণিজ্যিক পার্ক হিসেবে তৈরি করছি। শিগগিরই উদ্বোধন করব। আমার এই পার্কে আগে থেকেই বিদেশি প্রজাতির বেশ কিছু হাঁস আছে। উটপাখি ও ময়ূর আছে। এ ছাড়া, আরও কিছু প্রাণী আছে', যোগ করেন আব্দুল ওয়াদুদ।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান গত বছর শখের বসে জাতীয় চিড়িয়াখানা থেকে দুটি ময়ূর কিনেছিলেন। এক বছরের মধ্যেই সেগুলো ২৫টি বাচ্চা দেয়।

'ময়ূর কীভাবে লালন-পালন করতে হয় জানতাম না। ২৫টি থেকে ১৭টি ছিল। কয়েকটি ইউএনও, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ কেউ কেউ আমার কাছ থেকে নিয়েছেন। এখন আমার কাছে ১২টি ময়ূর আছে', বলেন তিনি।

ছবি: পলাশ খান

নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় বসবাসকারী খলিলুর রহমান দুটি হরিণ কিনেছেন। তিনি নিজের বাড়িতেই সেগুলো লালন-পালন করেন।

খলিলুর বলেন, 'শখের বসেই এগুলো কিনেছি। অন্য কোনো কারণ নেই।'

তবে, বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা সাধারণ মানুষের কাছে চিড়িয়াখানার প্রাণী বিক্রি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এতে করে বন্যপ্রাণী নিয়ে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণ মানুষের কাছে বন্যপ্রাণী বিক্রি করা হলে প্রাণীগুলোর সঠিক পরিচর্যা, প্রজনন ও স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা কঠিন। আমরা অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন সময়ে এর বিরুদ্ধে বলেছি। কিন্তু, সেটি কেউ নজরে নেয়নি।'

'এটা আমাদের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক', বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের একজন অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের এ ধরনের প্রাণী বিক্রি করার কোনো অধিকার নেই। সেখানে প্রাণীর সংখ্যা যদি বেশি হয়ে যায়, তাহলে তারা অন্য কোনো চিড়িয়াখানার সঙ্গে সেগুলো বিনিময় করতে পারে।'

'তা ছাড়া, যে প্রাণীগুলো বিক্রি করা হয়, সেগুলোর পরবর্তীতে কী হয়, সেটা সঠিকভাবে নজরদারি করা হয় না। প্রাণীগুলোর নতুন বাচ্চা হলে সেগুলোর প্রত্যেকটার খুঁটিনাটি সব তথ্য সংরক্ষণ করার কথা। কিন্তু, সেটি কি করা হয়?', বলেন তিনি।

জানতে চাইলে উপ বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল, ঢাকা) মো. ছায়ীদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যারা প্রাণীগুলো লালন-পালনে সক্ষম, জায়গা ও আর্থিক সঙ্গতি আছে, তাদেরকেই এসব প্রাণী লালন-পালনের অনুমোদন দেওয়া হয়। আবেদন পাওয়ার পর আমরা সরেজমিনে দেখে সব ঠিকঠাক পেলে প্রাণী কেনার অনুমোদন দিয়ে থাকি। এখানে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লেষ বা অন্য কোনো বিষয় নেই।'

চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. আব্দুল লতীফ বলেন, 'চিড়িয়াখানার প্রাণী ও পাখিগুলো এবার প্রচুর বাচ্চা দিয়েছে। শুধু হরিণ আর ময়ূরই নয়, ইমু, উটপাখি, জলহস্তী, জেব্রা, অজগরসহ অনেক প্রাণীই চিড়িয়াখানার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়েছে। কিন্তু, অন্যকোনো প্রাণী বিক্রির অনুমোদন না থাকায় আমরা দেশের ভেতর বা বাইরে অন্যকোনো চিড়িয়াখানার সঙ্গে সেগুলো বিনিময় করার চেষ্টা করছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

6h ago