জন্মযুদ্ধ, যুদ্ধশিশু ও এক আত্মজার কান্না

২০১৫ সালের ২০ নভেম্বর। সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পুরনো ঠিকানায় বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন একাত্তরের যুদ্ধশিশু শিখার তরুণী কন্যা ক্যাটরিনা।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করছেন শিখার মেয়ে ক্যাটরিনা। পাশে একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের মাতৃসমা বনি কাপুচিনো। ছবি: প্রথম আলোর সৌজন্যে

২০১৫ সালের ২০ নভেম্বর। সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পুরনো ঠিকানায় বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন একাত্তরের যুদ্ধশিশু শিখার তরুণী কন্যা ক্যাটরিনা।

একাত্তরে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধে একটি অনালোকিত অধ্যায় এই যুদ্ধশিশু। মা-বাবার ভালোবাসার ফসল নয়, পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের যৌন নির্যাতনে তাদের জন্ম।

মাদার তেরেসা হোমসের যুদ্ধশিশুরা। ১৯৭২ সাল। ছবি: সংগৃহীত

ক্যাটরিনার মা শিখা তেমনই এক যুদ্ধশিশু। ১৯৭২ সালে তিনি যখন কানাডার উদ্দেশে বাংলাদেশ ছাড়েন, তখন তার বয়স মাত্র ৪ মাস। অতটুকু বয়সের কোনো স্মৃতি কিংবা উপলব্ধি তার স্মরণে থাকার কথা না।

অথচ সেই শিখাই পরবর্তীতে আত্মজা ক্যাটরিনাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশকে তিনি তার আত্মায় ধারণ করে আছেন। এখানেই তার শেকড়।

দেশ ছাড়ার ৪৩ বছর পর বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সেদিন শিখার হয়ে কথাগুলো জানিয়ে দেন ক্যাটরিনা। মা ও মাতৃভূমির স্নেহ বঞ্চিত হলেও স্বদেশের প্রতি শিখার প্রবল মমত্বের কথা তখন উঠে এসেছিল অশ্রুসজল ক্যাটরিনার কথায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব নারীদের ধর্ষণ করা হয় তাদের মধ্যে অনেকেই গর্ভধারণ করেন। নির্যাতন ও তৎকালীন সমাজের বিরূপ দৃষ্টির সামনে তারা ছিলেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ফলে সন্তান লালন-পালনের মতো অবস্থায় তারা ছিলেন না।

এই পরিস্থিতিতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব শিশুদের নীরবে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আবার জন্ম-পরিচয় গোপন রেখে তাদের অনেকেই বেড়ে ওঠেন এ দেশেই।

স্বাধীনতার পর পর দেশে এসব শিশুর অন্যতম আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল পুরাণ ঢাকার ইসলামপুর রোডে গড়ে ওঠা মাদার তেরেসার 'মিশনারিজ অব চ্যারিটি' বা শিশু ভবন। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে জন্ম নেওয়া শিখার মতো শিশুদের পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এই সংগঠনের সদস্যরা।

এখান থেকেই ১৯৭২ সালে কানাডার সমাজকর্মী বনি কাপুচিনোর সংগঠন 'ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন' শিখাসহ ১৫ যুদ্ধশিশুকে কানাডায় নিয়ে যায়। পরে এই পথ ধরেই যুদ্ধশিশুদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করার কার্যক্রম শুরু হয়।

মাদার তেরেসা হোমসের প্রবেশদ্বার। ১৩ ডিসেম্বর ২০২১। ছবি: স্টার

একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের মাতৃসমা সেই বনি কাপুচিনোর সঙ্গে ৬ বছর আগে ওই আলাপচারিতার আয়োজন করেছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। সেখানেই তার সঙ্গে হাজির ছিলেন শিখার মেয়ে ক্যাটরিনা। সেদিন যার কান্না সংক্রমিত করেছিল উপস্থিত সবাইকে।

মানবতা ও অখণ্ড মানবাত্মার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে বনি কাপুচিনো শিখাসহ নিজের ২ সন্তান ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দত্তক নেওয়া ১৬ জন অনাথ শিশুকে লালন করেছেন সমান স্নেহে।

বয়সের ভারে ন্যুজ অশীতিপর বনি সেদিন বলেছিলেন, যুদ্ধের অবস্থান সবসময়ই মানবতার বিরুদ্ধে। কেবল অহিংসা এবং ভালোবাসাই পারে এর বিপরীতে শক্তিশালী কিছুকে দাঁড় করাতে।

যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ধর্ষণের বিভীষিকা যারা সয়েছেন এমন নারীর সংখ্যা ২ থেকে ৪ লাখ বলে অনুমান করা গেলেও, ওয়ার চাইল্ড বা যুদ্ধশিশুদের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।

এ বিষয়ে ২০০৯ সালে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধা সাজিদ হোসেনের লেখা 'একাত্তরের যুদ্ধশিশু' শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, মার্কিন গবেষক সুসান ব্রাউনমিলারের মতে এই সংখ্যা (ধর্ষণ) অনেক বেশি, প্রায় ৪ লাখ। তাদের একটি বিরাট অংশ গর্ভবতী হয়ে পড়েন। ধারণা করা হয়, বিপুল সংখ্যক গর্ভপাতের পাশাপাশি তাদের গর্ভে জন্ম নিয়েছিল ২৫ হাজার যুদ্ধশিশু।

১৯৭২ সালে অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক জিওফ্রে ডেভিস এই নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে এগিয়ে আসেন। তার ভাষায়, পাকিস্তানি বাহিনী একাত্তরে ধর্ষণকে বাঙালির বিরুদ্ধে 'অস্ত্র' হিসেবে ব্যবহার করে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি মফিদুল হকের ভাষ্য, তখন যতগুলো যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়েছিল তাদের অনেককে বিদেশে দত্তক দেওয়া হলেও দেশের ভেতর অনেক যুদ্ধশিশু হয়তো তাদের মায়েদের আশ্রয়ে সমাজের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।

বাংলাদেশ ও কানাডার সংবাদপত্রে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন। ছবি: সংগৃহীত

শিশু ভবনের ৫৪৯ যুদ্ধশিশু

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মমতাময়ী মাতা তেরেসা প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর। দেখা করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে। রাষ্ট্রপতি তাকে নির্যাতিত নারী ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে সরকারকে সহযোগিতার অনুরোধ জানান।

এর কয়েক সপ্তাহ পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পুরাণ ঢাকার ইসলামপুর রোডের ২৬ নম্বর ভবনে চালু হয় মিশনারিজ অব চ্যারিটির ঢাকা শাখা।

গত রোববার পুরাণ ঢাকার তাঁতীবাজার ও দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি কাপড়ের বাজার ইসলামপুরের ভিড় ঠেলে শিশু ভবনে পৌঁছে কথা হলো এই শাখার প্রধান পরিচালক সিস্টার জেভিয়ারের সঙ্গে।

সিস্টার জেভিয়ার জানান, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে এখান থেকে মোট ৫৪৯টি যুদ্ধশিশুকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দত্তক দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এখনো অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ফলে জন্ম নেওয়া অনেক শিশুকে তাদের মা এখানে রেখে যান।

'৭১-এর যুদ্ধশিশু: অবিদিত ইতিহাস' গ্রন্থে গবেষক মুস্তফা চৌধুরী এ সম্পর্কে বলেছেন, 'বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও অধিক সংখ্যক দুষ্প্রাপ্য ঐতিহাসিক নথিপত্র ও দলিল এখনও সংরক্ষিত রয়েছে মাদার তেরেসা হোমে।'

মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭৫ সালে ভারতের কেরালা থেকে মিশনারিজ অব চ্যারিটির ঢাকা শাখায় যোগদান করেন সিস্টার জেভিয়ার। তার কাছ থেকে জানা যায়, যুদ্ধশিশুদের লালন-পালনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পর নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য মিশনারিজ অব চ্যারিটি 'জাগরণী' নামে একটি প্রকল্প চালু করে, যা ৩ বছরের বেশি সময় চালু ছিল।

মুস্তফা চৌধুরী ১৯৭২ সালে কানাডায় দত্তক পিতামাতার পরিবারে বেড়ে ওঠা ১৫ যুদ্ধশিশুকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। যাদের সবার ভাগ্য শিখার মতো প্রসন্ন ছিল না। এই যুদ্ধশিশুদের নিয়ে তিনি তার গ্রন্থের শেষাংশে বলেন, 'যে যুদ্ধশিশুরা মানবিক বিবেচনার দুগ্ধধারা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, তারা যে মর্মবিদারী দুঃখ পেয়েছিল, তার খবর কেউ জানে না। কেউ সে বিষয়ে জানার ইচ্ছা পোষণ করে কি না, সে প্রশ্নের উত্তরও আমাদের জানা নেই।'

যুদ্ধশিশু সম্পর্কিত মিশনারিজ অব চ্যারিটির সনদ। ছবি: সংগৃহীত

দেশে থেকে যাওয়া যুদ্ধশিশুরা

কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান তার 'যুদ্ধশিশুর বয়ান' নামের এক লেখায় বলছেন, 'ইতিহাস সংরক্ষণে আমাদের সাধারণ অবহেলার পথ ধরেই হারিয়ে গেছে বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য। যুদ্ধশিশু বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান…। বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু বিষয়ে ভিনদেশি গবেষক পিএইচডি করছেন তা জানি, কিন্তু দেশের ভেতর তাদের নিয়ে কর্মকাণ্ড বিরল।'

যুদ্ধশিশুদের নিয়ে ২০১৬ সালে নির্মিত 'জন্মসাথী' নামের একটি প্রামাণ্যচিত্রকে উপজীব্য করে উল্লিখিত লেখাটি লিখেছিলেন শাহাদুজ্জামান।

এই প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা শবনম ফেরদৌসী ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে জন্ম নেন। পরে তার বাবার কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, সে দিন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মোট ১৩টি শিশু জন্ম নেয়। তাদের ভেতর ৪ জন ছিল যুদ্ধশিশু। শবনম পরে তার জন্মসাথী ৪ যুদ্ধশিশুকে খুঁজতে বের হন। এটা নিয়েই আবর্তিত হয় প্রামাণ্যচিত্রের কাহিনী।

এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়াতেই শবনম দেশে থাকা ২ যুদ্ধশিশুর সন্ধান পেয়ে যান। তাদের একজন দিনাজপুরের রানীশংকৈলের সুধীর ও অপরজন সিলেটের শামসুন্নাহার। শামসুন্নাহার ছিলেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের একজন সাক্ষী। কিন্তু সুধীরের মতো তার সংসার নেই। তিনি তার গ্রাম থেকে বিতাড়িত। যুদ্ধাপরাধের সাক্ষী দেওয়ার কারণে হত্যার হুমকি মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়ান তিনি।

দেশে থাকা এই যুদ্ধশিশুদের সম্পর্কে নির্মাতা শবনম ফেরদৌসী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'শত্রু সন্তান তারা। সেই কারণে সেই মুহূর্তে হয়তো একটা ঘৃণা কাজ করেছিল। কিন্তু চূড়ান্ত অর্থে দায়টা রাষ্ট্রের। সমাজ তাদের গ্রহণ করেনি। রাষ্ট্র যতটুকু পেরেছে তাদের বিদেশে পাঠিয়েছে। বাকিরা এই দেশে এই ৪৪ বছর কীভাবে বেড়ে উঠেছে তা কেউ জানে না।'

অবশ্য মুক্তিযুদ্ধে এক অন্য লড়াইয়ে জন্ম নেওয়া এই শিশুদের 'যুদ্ধশিশু' নামে ডাকতে নারাজ শবনম। তিনি তাদের ডাকতে চান 'বিজয়শিশু' নামে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে দেওয়া ফাঁসির রায়ে বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের 'জাতীয় বীর' হিসেবে অভিহিত করেন আদালত। যে মামলায় সাক্ষী দেন 'জন্মসাথী' প্রামাণ্যচিত্রের যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহার।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, 'তারা যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন, তার ভয়াবহতা হ্রাস করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তারপরও তাদের অবহেলা ও অযত্নে ফেলে রাখার কোনো অবকাশ নেই, কারণ তা হবে সমাজ, জাতি এবং আমাদের বিবেকের মারাত্মক অপমান।'

Comments

The Daily Star  | English
Civil society in Bangladesh

Our civil society needs to do more to challenge power structures

Over the last year, human rights defenders, demonstrators, and dissenters have been met with harassment, physical aggression, detainment, and maltreatment by the authorities.

8h ago