রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ১৬ শিশু নিখোঁজ

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড ও বেভারেজ ফ্যাক্টরিতে আগুনের ঘটনায় নিখোঁজ সন্তানের ছবি হাতে এক মা। ছবি: আনিসুর রহমান/ স্টার

নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কারাখানাটিতে কাজ করতো এমন ১৬ শিশু নিখোঁজ। সম্ভবত তারা আগুনে মারা গেছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), নারায়ণগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের তালিকার তথ্য এবং প্রিয়জনদের খুঁজতে থাকা পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্য ডেইলি স্টার নিখোঁজ শিশুদের এ সংখ্যাটি বের করেছে।

নিখোঁজ এই শিশুরা বেশিরভাগই ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সী। যারা কারাখানায় কাজের জন্য পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা করে পেতো।

করোনা মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক শিশুর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এক বছরের বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে সম্প্রতি তাদের অনেকে বিভিন্ন কারখানায় কাজ শুরু করেছে।

দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, নিখোঁজ এ শিশুরা যে কারখানাটিতে কাজ করত, সেখানে শিশুদের খাবারই তৈরি হতো। নোসিলা চকলেট, হেজেলনাট স্প্রেডস, নুডলস, ললিপপ ও জুস তৈরি হতো সেখানে।

নিখোঁজ শিশুদের মধ্যে আছে- শান্তা মনি (১২), হিমা আক্তার (১৬), তাকিয়া (১৪), তুলি (১৫), নাজমুল (১৫), মাহমুদা (১৪), শাহানা (১৬), হাসনাইন (১৪), স্বপন (১৫), ফারজানা (১৪), ফাতেমা আক্তার (১১), চম্পা বর্মণ (১৪), লাবন্য আক্তার (১৪), খাদিজা ও নোমান মিয়া। এ ছাড়া, মিতু বেগম নামের ১৪ বছর বয়সী আরেকটি শিশু অগ্নিকাণ্ডের পরদিন পর্যন্ত নিখোঁজ ছিল। তবে, গতকাল শনিবার তার খোঁজ পাওয়া গেছে কি না, দ্য ডেইলি স্টার সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেনি।

ডিএনএ পরীক্ষা নিশ্চিত হওয়ার আগে এ শিশুদের মৃত হিসেবে উল্লেখ করা যাবে না। তবে যেহেতু ৫২টি পরিবার ৪৮টি মরদেহের দাবিদার সে কারণে নিখোঁজ এই শিশুদের জীবিত পাওয়া যাবে এমনৱ সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, কারখানার দরজায় তালা থাকায় অগ্নিকাণ্ডের সময় ওই শিশুরা বেরিয়ে আসতে পারেনি। যে কয়েকটি শিশু বাঁচতে পেরেছে, আগুন লাগার পর তারা সবাই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েছিল।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশুদের সংখ্যার ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

২০০৬ সালে ১৪ বছরের কম বয়সীদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করে আইন করে বাংলাদেশ সরকার। শ্রম আইন অনুসারে, ১৪ বছরের কম বয়সীরা শিশু এবং ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা কিশোর-কিশোরী।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬, জাতীয় শ্রম নীতি ২০১২, বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধিত) এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধি ২০১৫ এর খসড়া তৈরির কাজে সম্পৃক্ত ‍ছিলেন শ্রম বিশেষজ্ঞ জাফরুল হাসান শরীফ।

তিনি বলেন, ‘শ্রম আইন অনুযায়ী কিশোর-কিশোরীদের কাজে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তবে, তারা কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বা দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারবে না।’

তিনি আরও বলেন, ’৩৪ ধরনের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। চলন্ত মেশিন অপারেট করা তার মধ্যে একটি।’

এ ছাড়া, আইন অনুসারে সন্ধ্যা ৭টার পর তাদের দিয়ে কাজ করানো যাবে না।

কিন্তু, নিখোঁজ প্রতিটি শিশু বিকেল-সন্ধ্যার শিফটে কাজ করত। তাদের পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, প্রতিদিন আট থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করত তারা।

তবে কারখানাটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন এর আগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘শ্রমিকদের বয়স নিয়ে যে কথা হচ্ছে, তা ভুল। সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করেই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বয়স যদি আসলেই কম হয়ে থাকে, তবে শ্রমিকরাই নথিতে ভুল বয়স উল্লেখ করেছে।’

কিন্তু, ১২ বছর বয়সী ছোট্ট শান্তা মনিকে কোনো নথিপত্র দিয়েই ১৮ বছরের কারো মতো দেখানো সম্ভব না। তার মা শিমু আক্তার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিটি শিশু ওয়ার্ডে নিজের মেয়েকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘সেদিন কাজে তৃতীয় দিন ছিল ওর। ওর বাবা সাত বছর আগে মারা গেছে। আগে সে একটা মাদ্রাসায় ক্লাস ফোরে পড়তো। মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ললিপপ বানানোর জন্য প্রতি মাসে মনিকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ছিল। ও কাজ করতো চার তলায়।’  

তবে, মেয়ে মারা গেছে কিছুতেই এ কথা বিশ্বাস করতে নারাজ শিমু।

‘যে বাচ্চারা বেঁচে আছে, আমাকে তাদের কাছে নিয়ে যান। শান্তা মনি নিশ্চয়ই সেখানে আছে’, বলেন তিনি।

১৫ বছর বয়সী নাজমুলের ভাই মোবারক হোসেন জানান, মহামারি আঘাত হানার আগে নবম শ্রেণিতে পড়ত নাজমুল।

‘যেহেতু আমাদের বাবা কৃষিকাজ করেন আর স্কুল এখন বন্ধ, তাই এ সময়টা কিছু টাকা উপার্জন করার কথা ভেবেছিল সে। নোসিলা বানাতো কারখানায়।’

১৬ বছর বয়সী বড় বোন শাহানার মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছিল ১৩ বছরের মনি।

সে বলে, ‘আমরা একই কারখানা কম্পাউন্ডে কাজ করতাম। শুধু বিল্ডিং আলাদা ছিল। আমার বোন নোসিলা বানাত। বয়স কম হওয়ায় তাকে রাতের শিফটের বদলে সন্ধ্যার শিফট দেওয়া হয়।’  

‘আমার বোনকে তালা দিয়ে আটকে রেখে মেরে ফেলেছে ওরা’, কাঁদতে কাঁদতে বলে মনি।

পঞ্চম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করা হয়নি ১৬ বছরের হিমা আক্তারের।

তিন বছর ধরে সে ওই কারখানায় কাজ করছিল জানিয়ে তার বোন আর্জিনা বলেন, ‘সে চকলেট মেশিনের কাজ করত। যেটা দিয়ে চকলেটের প্যাকেজিং করা হয়।’

শ্রম আইন অনুসারে, শিশুদের মেশিন চালানো বেআইনি। বিপজ্জনক এ কাজটি করা বাবদ প্রতি মাসে পাঁচ হাজার ৬০০ টাকা পেত হিমা।

হিমার আত্মীয় ১৪ বছরের তাকিয়াও একই কাজ করত। সেও নিখোঁজ।

‘কারখানাটির লাইসেন্স দুমাস আগে নবায়ন করা হয়েছে। শিশু শ্রমিক থাকা সত্ত্বেও কীভাবে লাইসেন্স নবায়ন করেছে কর্তৃপক্ষ?’ প্রশ্ন তোলেন জাফরুল হাসান।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

Had no discussion on ‘humanitarian corridor’ with UN or any entity: Shafiqul

Regarding the reports of involvement of a major power, he said, these are 'pure and unadulterated' propaganda.

1h ago