বাংলাদেশ

বন্দরনগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে শুরু থেকেই গলদ

দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতার সমস্যা মাত্র ৩ বছরের মধ্যে সমাধানের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ২০১৭ সালে একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নেয়।
স্টার ফাইল ফটো। রাজীব রায়হান

দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতার সমস্যা মাত্র ৩ বছরের মধ্যে সমাধানের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ২০১৭ সালে একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নেয়।

তবে, বন্দরনগরীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নে শুরু হওয়া ৫ হাজার ৬১৭ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পটি প্রায় প্রতিটি ধাপে হোঁচট খাচ্ছে। তাড়াহুড়া করে করা সম্ভাব্যতা যাচাই নিরীক্ষণ ও দুর্বল কর্মপরিকল্পনাই এর জন্য দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।

দ্য ডেইলি স্টারের পাওয়া কিছু নথি ও বিভিন্ন সূত্রের পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, এই ৩ বছর মেয়াদী প্রকল্প দুই ধাপে আরও ৩ বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে, প্রকল্পের কিছু অংশের ব্যয় বাজেটের ৮ থেকে ৩৮ গুণ বেড়েছে।

এ পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে, যার মধ্যে আছে মূলত খাল বর্ধিতকরণ ও পুনঃখননের কাজ। এ কাজের জন্য সমগ্র বাজেটের ২৯ শতাংশ ব্যয় হয়েছে।

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দাকে আংশিকভাবে কাজের ধীর গতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে। তবে, সরকারের পরিচালিত একটি নিরীক্ষার কারণ হিসেবে মূলত 'ত্রুটিপূর্ণ সম্ভাব্যতা যাচাই নিরীক্ষণ, তহবিল বণ্টনের ক্ষেত্রে ধীর গতি, কর্মীর অভাব এবং বাস্তবায়নকারী, ঠিকাদার ও পরামর্শকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের' কথা বলা হয়েছে।

নিরীক্ষায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এ বছরের জুলাইতে প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা ও প্রকল্পের খরচ নিয়ন্ত্রণে সিডিএ'র নিয়মিত আর্থিক অডিট না থাকায় প্রকল্পের কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে।

পার্টিসিপেটরি অ্যাকশন রিসার্চ অব হিউম্যান ফর অ্যাডভান্সমেন্ট (পাড়া) নামক প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পক্ষে এ বছরের মার্চ ও এপ্রিলে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করে।

২০২৩ সালের জুনে শেষ হতে যাওয়া প্রকল্পটি সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড বাস্তবায়ন করছে।

ত্রুটিপূর্ণ নিরীক্ষণ, দুর্বল পরিকল্পনা

প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সিডিএ মাত্র ১ সপ্তাহ সময় নেয়।

সূত্র জানায়, এই নিরীক্ষণে জমি অধিগ্রহণ ও বিস্তারিত প্রকল্প নকশা প্রণয়নসহ বাস্তব সমস্যাগুলোকে আমলে নেওয়া হয়নি।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীদের মতে এ ধরনের বড় আকারের প্রকল্পের সম্ভাব্যতা নির্ভুলভাবে যাচাইয়ের জন্য কমপক্ষে ১ বছর সময় লাগার কথা।

একজন প্রকৌশলী বলেন, 'সেটিও উচ্চাভিলাষী হবে।'

প্রকল্প শুরুর পর সিডিএ আরেকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সম্ভাব্যতা যাচাই নিরীক্ষণ পরিচালনা করে। দ্বিতীয় সম্ভাব্যতা যাচাই নিরীক্ষণ কিছু পুরনো সমস্যার সমাধান করে, কিন্তু ইতোমধ্যে নতুন আরও কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ায় প্রকল্পে বড় আকারের সংশোধন আনতে হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিডিএ'র পরিকল্পনা এতটাই দুর্বল ছিল যে, ২১টি পারচেজ প্যাকেজের মধ্যে অন্তত ১০টির খরচ নির্ধারিত বাজেটের তুলনায় ১১৬ শতাংশ থেকে ৩ হাজার ৭৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা এই খরচ বাড়াকে বিস্ময়কর বলে উল্লেখ করেছেন।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজালে (ডিপিপি) প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের জন্য কোনো 'ব্যবহারিক কর্মপরিকল্পনা' না থাকায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত খরচ অনুমানের চেয়েও অনেক বেশি ছিল।

উদাহরণস্বরূপ, শহরের পূর্ব অংশে খাল ও নর্দমার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ডিপিপিতে অনুমিত খরচ ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। কিন্তু, কাজটি শেষ করতে খরচ হয়েছে ২৮৮ কোটি টাকা, যেটি অনুমিত খরচের চেয়ে ৩ হাজার ৭৪০ শতাংশ (৩৮ গুণ) বেশি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ১১ কিলোমিটারের নতুন একটি খাল খননের খরচ অনুমিত খরচের চেয়ে ৮ গুণ বেশি হয়েছে।

প্রকল্পের এখনকার সমস্যাগুলোর সমাধান না করে এর সময়সীমা বাড়ানো হলে খরচের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।

জলাবদ্ধতা: নগরবাসীর দুর্ভোগ কমেনি

স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ জারিনা হোসেন প্রকল্প সম্পর্কে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি জনগণের টাকা ও সময়ের চূড়ান্ত অপচয়।'

তিনি আরও বলেন, 'বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ছাড়াই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। এখন এটি ভুল পথে চলছে।'

তিনি উল্লেখ করেন, সিডিএ ১৯৯৫ সালে একটি ২০ বছরব্যাপী মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে, যেটি বাস্তবসম্মত ছিল। কিন্তু, এরপর জলাবদ্ধতা দূর করতে যতগুলো পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার কোনোটাতেই এই মাস্টারপ্ল্যানকে আমলে নেওয়া হয়নি। ফলাফল হিসেবে হাজার কোটি টাকার এসব প্রকল্প থেকে সাধারণ জনগণ কোনো সুফল পায়নি।

প্রকল্পের ধীর গতির কারণে শহরের বাসিন্দাদের আগামী বর্ষা মৌসুমেও ভোগান্তির শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীর বেশিরভাগ এলাকা এবং শহরের সবচেয়ে বড় বাজার খাতুনগঞ্জ হাঁটু পানির নিচে চলে যাবে।

জলাবদ্ধতার কারণে বন্দর নগরীর ওপর অনেক নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবও পড়ে।

চট্টগ্রাম চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের নির্দেশনায় পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, খাতুনগঞ্জে জলাবদ্ধতা সমস্যার কারণে ২০২০ সালে শুধু খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরাই প্রায় ৫১৪ কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

অর্থ না সমন্বয়?

সিডিএ'র প্রকল্প পরিচালক আহমেদ মইনুদ্দীন প্রকল্প প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করেননি।

তবে, সরকারি সমীক্ষা পরিচালনার সময় সিডিএ প্রারম্ভিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এড়িয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন।

প্রকল্প প্রত্যাশিত গতিতে না এগোনোর জন্য তারা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তহবিল বিতরণের ধীর গতিকে দায়ী করেন। সেনাবাহিনী, সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণে সিডিএ প্রয়োজনীয় তথ্য পায়নি এবং এ কারণে তারা সময়মত অডিট প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে পারেনি বলেও দাবি করেছেন।

সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন বিগ্রেডের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও প্রকল্প পরিচালক মো. শাহ আলী ধীর গতির জন্য তহবিল স্বল্পতাকে দায়ী করেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য যে পরিমাণ টাকা প্রয়োজন তা বরাদ্দ করা হচ্ছে না। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এ বছরের মধ্যে কাজ শেষ করতে প্রায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা প্রয়োজন, কিন্তু, মন্ত্রণালয় থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৩৫০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র জমি অধিগ্রহণের জন্যই ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা প্রয়োজন।'

আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী দাবি করেন, তহবিল মূল সমস্যা নয়।

তিনি বলেন, 'সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাবের ভুলগুলো।'

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
World Press Freedom Day 2024

Has Bangladesh gained anything by a restrictive press?

The latest Bangladesh Bank restriction on journalists is anti-democratic, anti-free press and anti-public interest.

10h ago