ব্যক্তিগত গাড়িতে ভিআইপি হর্ন-হুটার, বিড়ম্বনায় ট্রাফিক পুলিশ

নিরাপত্তা বাহিনী-সরকারি-ভিআইপি গাড়ি ছাড়া হর্ণ ও হুটার ব্যবহারের নিয়ম না থাকলেও, ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গাড়িতে এ ধরণের হর্ণের ব্যবহার বাড়ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। ব্যক্তিগত গাড়িতে ভিআইপি হর্ণ ও হুটার বাজানো নিয়ে বিপাকে পড়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ।

এতে বাড়ছে বিড়ম্বনা, জনমনে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। ক্ষেত্র বিশেষে পুলিশের সঙ্গে ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনাও।

এছাড়া মোটরসাইকেলেও উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণরা এ ধরণের হর্ণ ব্যবহার করছেন। রাতে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় তারা দাপিয়ে বেড়ান।

নগর ট্রাফিক পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী, সরকারি বিভিন্ন ঊর্ধতন কর্মকর্তার গাড়িতে, ফায়ার সার্ভিস এবং অ্যাম্বুলেন্সে সাইরেনযুক্ত হর্ণ ও হুটার বাজানোর অনুমতি আছে।

মহানগরীর সিটি গেট এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে। ফাইল ফটো

তবে নগরের বিভিন্ন পয়েন্টে কর্মরত ট্রাফিক সার্জেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠানের গাড়ি, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের গাড়িতে সাইরেন ও হুটার বাজানো হচ্ছে।

নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় যানজটের সময় তারা সাইরেন বা হুটার বাজালে ভিড়ের মধ্যে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশরা বিভ্রান্তের মধ্যে পড়েন।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নিজেদের 'ভিআইপি' বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে জনসম্মুখে উপস্থাপন করতেই এ ধরণের কাজ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরাও পিছিয়ে নেই।

শুধু রাস্তায় নজর না দিয়ে যেখানে এ ধরনের হুটার বা হর্ন বিক্রি হচ্ছে, সেখানেও তদারকির দাবি তাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্দর বিভাগের এক ট্রাফিক সার্জেন্ট দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের গাড়ি এবং ব্যবসায়ীরা যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাদের গাড়িতে সাইরেন বা হুটার বাজাতে দেখা যায়।'

'অনেক সময় আমরা গাড়ি দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করলে বা মামলা দিতে চাইলে, তারা আমাদের নানান রেফারেন্স ও হুমকি দেন। এতে করে অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়,' বলেন তিনি।

তিনি বলেন, 'অনেকে সরাসরি সিনিয়র অফিসারদের কাছে ফোন দিয়ে দেন। তাই বিতর্ক এড়াতে আমরা আসলে এ ধরণের বিষয়ে খুব একটা ঘাটাঘাটি করতে চাই না।'

১৬ জানুয়ারি রাত ৯টা। চট্টগ্রামের কাজির দেউড়ি মোড়ে দৌঁড়ে যাচ্ছেন দায়িত্বরত সার্জেন্ট সাইফুল ইসলাম। তার পেছন পেছন দৌঁড়ে যান দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক।

সেখানে গিয়ে দেখা যায়, জলপাই রঙের একটি জিপ গাড়ি দাঁড় করানো হয়েছে। ওয়াসা মোড় এলাকায় গাড়িতে সাইরেন ও হুটার বাজানোর কারণে ওয়্যারলেসে এটিকে আটকে করতে বললে সার্জেন্ট সাইফুল গিয়ে দাঁড় করান।

তখন গাড়িতে ছিলেন ২ জন যুবক এবং ১ জন তরুনী। নিজেকে এক ব্যবসায়ীর ভাতিজা পরিচয় দিয়ে, গাড়ি কেন দাঁড় করানো হলো তা জানতে চান। গাড়িতে হুটার লাগানোর অনুমতি আছে কি না, জানতে চাইলে তখন তিনি সার্জেন্টকে মামলা না দিতে অনুরোধ করেন। এক পর্যায়ে তিনি ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলতে বলেন। অবশ্য সার্জেন্ট সাইফুল পরে একটি মামলা করেন।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীতে ভিআইপি হর্নের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। ভিআইপি হর্ণের অপব্যবহার কমাতে এবং জনমনে যেন সরকার ও আমলাদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি না হয়, সে জন্য এ সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে এখনো বন্ধ হয়নি ভিআইপি হর্ন-হুটারের ব্যবহার।

সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ সূত্র জানায়, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ৮৪ ধারায় মোটরযানের নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন ধরনের আকার, ব্রেক ও স্টিয়ারিং গিয়ার, হর্ন, আসন সংখ্যা, হুইল বেইজ, রিয়ার ওভার, চাকার আকার, সাইলেন্সার পাইপ, ইঞ্জিন, রঙ পরিবর্তন করা হলে প্রথমবার ১৫ হাজার এবং ২য় বার ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করার কথা বলা আছে।

এসব ক্ষেত্রে এই ধারাতেই ট্রাফিক সার্জেন্টরা মামলা দিচ্ছেন। বিশেষ ক্ষেত্রে দায়িত্বরত সার্জেন্ট জরিমানার পাশাপাশি গাড়ি 'টো' করতে পারেন অথবা হর্ণ খুলে ফেলতে পারেন।

ব্যক্তিগত গাড়িতে সাইরেন ও হুটার চলছে স্বীকার করে বন্দর ট্রাফিক জোনের উপপুলিশ কমিশনার শাকিলা সুলতানা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা এ বিষয়ে আমাদের সার্জেন্টদের নির্দেশনা দিয়েছি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে অনেক ক্ষেত্রে ওভারলুক করতে হয়, তবে এর অপব্যবহার রুখতে আমরা চেষ্টা করছি।'

'এটা রোধ করতে সচেতনতার পাশাপাশি সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে,' বলেন তিনি।