মেয়রের ব্যর্থতা আড়ালের কৌশলের নাম ‘অভিযান-জরিমানা’

সিটি করপোরেশন সঠিক সময়ে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় ও কার্যকর কীটনাশক ব্যবহার না করায় ঢাকায় ভয়াবহ আকারে ডেঙ্গু বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নিজেদের ব্যর্থতা আড়ালের অংশ হিসেবে ‘অভিযান-জরিমানা’র কৌশল বেছে নিয়েছে সিটি করপোরেশন।
(বামে) ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, (মাঝে) রাজধানীর মিরপুরের একটি বাড়িতে ডিএনসিসির ডেঙ্গু নিধন অভিযান, (ডানে) ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

সিটি করপোরেশন সঠিক সময়ে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় ও কার্যকর কীটনাশক ব্যবহার না করায় ঢাকায় ভয়াবহ আকারে ডেঙ্গু বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নিজেদের ব্যর্থতা আড়ালের অংশ হিসেবে 'অভিযান-জরিমানা'র কৌশল বেছে নিয়েছে সিটি করপোরেশন।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে তাদের কাছে পরামর্শ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে চলতি বছরে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত চার হাজার ১১৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। চলতি আগস্ট মাসেই আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৪৫৭ জন। জুলাই মাসে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অন্তত দুই হাজার ২৮৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ ছাড়া, জুন মাসে ২৭২ জন ও মে মাসে ৪৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন অ্যাডাল্ট মশা মারা। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কোনো হাত নেই। এই কাজটি অবশ্যই সিটি করপোরেশনকেই করতে হবে।'

তিনি বলেন, 'সিটি করপোরেশন যে ফগিং করে সেটি ত্রুটিপূর্ণ। তাছাড়া তাদের লোকবলের দক্ষতা নিয়েও সন্দেহ আছে। তাদের অধিকাংশ কাজ ত্রুটিপূর্ণ। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। আমাদের কাছে মাঝে মধ্যে কিছু পরামর্শ নেয়। কিন্তু, আমরা যা বলি তারা তা শোনে না।'

'আমাদের দেশে অন্যের ওপর দোষ চাপানো খুব সহজ। সিটি করপোরেশন নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে, অপারগতা ঢাকতে, তাদের ত্রুটিপূর্ণ কাজগুলো আড়াল করতে জনগণের ওপর দায় চাপিয়ে অভিযান করছে, জরিমানা করছে। যা মোটেই উচিত না।'

'সিটি করপোরেশনকে দক্ষ জনবল দিয়ে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে, তবেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এসব অভিযান, জরিমানা করে তেমন কোনো লাভ হবে না,' তিনি যোগ করেন।

কীটতত্ত্ববিদ ও বাংলাদেশ প্রাণীবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রথম থেকে এডিস মশা ঠিকঠাক মতো দমন করা হয়নি। এ কারণেই এ বছর ডেঙ্গুর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। নিজেদের কাজ সঠিকভাবে না করে তারা জনগণকে জরিমানা করছে। এতে বাস্তবে কোনো লাভ হবে না।'

তিনি বলেন, 'সিটি করপোরেশন বা সরকারের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যেসব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল তার কোনটাই তেমনিভাবে নেওয়া হয়নি। তাই ডেঙ্গু এক ধরণের মহামারি আকার ধারণ করেছে। এই সময়ে অ্যাডাল্ট মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সেটি তেমনিভাবে নেওয়া হচ্ছে না। কোন কোন জায়গায় ডেঙ্গুর ক্লাস্টার আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের নগর পিতারা তা না করে বিভিন্ন গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন, জনগণের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। তারা যে গান গায় তা আসলে সঠিক নয়।'

'তারা আমাদের পরামর্শ নেয় ঠিকই কিন্তু, যেগুলোতে তাদের নিজের স্বার্থ আছে শুধু সেগুলোই শোনা হয়। বাকিগুলো শোনা হয় না। আমরা দেখি নির্মাণাধীন বাসায় গিয়ে জরিমানা করা হয়। কিন্তু সেই বাসার মশা মেরে আসা হয় না। এটি আসলে হাস্যকর। এ বছর তারা তেমন কোনো উদ্যোগই নেয়নি। এখন দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। এতে করে আসলে তেমন ফলাফল পাওয়া যাবে না। তাছাড়া তারা যে ফগিং করে তা তেমনিভাবে কার্যকর না। যে কীটনাশকগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোর কার্যকারিতা নেই বললেই চলে,' তিনি বলেন।

'দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হাঁস-ব্যাঙ দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, এটি আসলে হাস্যকর। পৃথিবীর কোনো দেশেই এভাবে হাঁস-ব্যাঙ দিয়ে মশা মারা হয় না। এগুলো জনগণের টাকার অপচয় ছাড়া কিছুই না,' তিনি যোগ করেন।

মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'নগর পিতারা কার্যকরভাবে কাজ করে না বলেই ঢাকা সিটি অভিশপ্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে। গত ৬০ বছরে তারা যেহেতু মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি তাই এটি তাদের কাছ থেকে নিয়ে নিতে হবে। অন্য বিশেষ কোনো বাহিনী গঠন করে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।'

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেগুলো হলো পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, অন্য জীব দিয়ে এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ, কীটনাশক হিসেবে লার্ভি সাইড ও অ্যাডাল্টি সাইডের প্রয়োগ এবং জনগণকে এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ। এই চারটি পদ্ধতি সারাবছর ব্যাপী বাস্তবায়ন করতে হবে। সিটি করপোরেশন সারা বছর কাজ করলেও এই চারটি বিষয়কে একত্রিত করে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার কাজ করা হয় বলে আমার জানা নেই।'

তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে অভিযান পরিচালনা কমিয়ে দিয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করে এডিস মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করতে হবে। সিটি করপোরেশন ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ বাদ দিয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করতে পারলে এই মুহূর্তে ডেঙ্গু কমে আসবে।'

কবিরুল বাশার বলেন, 'এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাছাড়া প্রজননের শুরুতে সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু নিয়ে তেমন একটা মনোযোগ দেয়নি। এ কারণেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে গেছে।'

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এই মুহূর্তে সিটি করপোরেশনকে প্রতিটি মহল্লায় একটি করে কমিটি গঠন করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে একটি যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে যেমন দেশবাসী ঝাঁপিয়ে পড়ে নয় মাসে দেশ স্বাধীন করেছিল, তেমনি বর্তমানে আমাদের এমন একজন মানুষ প্রয়োজন যার ডাকে সাড়া দিয়ে সবাই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তবেই আমরা খুব দ্রুত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো।'

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল ও সরকারি অফিসের আশেপাশে ডেঙ্গু মশার লার্ভা আছে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কয়েকদিন আগে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের দুটি ড্রাম ও একটি ফুলের টবে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা বাড়িতে মোটা অংকের টাকা জরিমানা করা হলেও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বা জরিমানা করেনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ও মুখপাত্র মো. আবু নাছের টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের কোনো ঘাটতি নেই। এপ্রিল মাসেই আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু, কেউ তেমনিভাবে সহযোগিতা করছে না বলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।'

হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বা জরিমানা করা হয়নি কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কিছু স্পর্শকাতর বিষয় থাকার কারণে তাদেরকে জরিমানা করা হয়নি। তবে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। তা ছাড়া যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লার্ভার খবর পেলে আমরা অভিযান চালাই।'

বিশেষজ্ঞদের নেতিবাচক মনোভাব থাকা সত্ত্বেও কেন হাঁস বা ব্যাঙ কেনা হলো, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা ১০টি জলাধারে ৫০০ এর বেশি হাঁস এবং ১০ হাজারের মতো ব্যাঙ অবমুক্ত করেছি। আমরা কোথাও বলিনি যে, হাঁস বা ব্যাঙ মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। আমরা পরীক্ষামূলকভাবে এগুলো কিনেছি।'

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জনগণের অসচেতনতা এবং বিল্ডার্সদের খামখেয়ালিপনা ও অদায়িত্বপূর্ণ ব্যবহারের কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।'

ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু জনগণ এখনও সচেতন হচ্ছে না বলেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে আমাদের অভিযান চালাতে হচ্ছে।'

বিশেষজ্ঞদের কথা শোনা হচ্ছে না, এমন অভিযোগ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'বিশেষজ্ঞরা যে পরামর্শ দেয় আমরা সবমসময় তা শোনার চেষ্টা করি এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করি। তাদের কিছু পরামর্শ বাস্তবায়ন করার মতো সামর্থ্য না থাকায় সব পরামর্শ শোনা সম্ভব হয় না।'

তিনি বলেন, 'আমরা মিল্কভিটা, সিভিল অ্যাভিয়েশন, বাংলাদেশ রেলওয়ের নামে নিয়মিত মামলা দিয়েছি। কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আমরা ছাড় দিচ্ছি না। আমরা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছি। নিজেরাই নিজেদের আঙিনা পরিষ্কার রাখলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট (আইভিএম) প্রকল্প গ্রহণ করেছি। এর জন্য সরকারের থেকে প্রয়োজনীয় বাজেট পেলে কার্যকরভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো বলে আশা করছি।'

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

সিটি করপোরেশন সারা বছর কাজ করেনি, এখন নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই জরিমানা করছে। বিশেষজ্ঞদের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতি. সচিব) ফরিদ আহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা মানুষকে সব সময় সচেতন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তারা তা না শোনায় বাধ্য হয়ে জরিমানা করছি। কারো বাসায় এডিস মশা থাকলে শুধু তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, আশেপাশের অনেক মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যকে অসুস্থ করার অধিকার কারোই নেই। এটা আইনে অপরাধ। তাই আমরা জরিমানা করি।'

জরিমানা করে কি ডেঙ্গু কমেছে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমরা প্রথমে অল্প পরিমাণে টাকা জরিমানা করি। সেই বাসায় আবার লার্ভা পাওয়া গেলে বেশি টাকা জরিমানা করি। এভাবে দেখা গেছে অনেকেই জরিমানার ভয়ে নিজেরাই এখন বাসা-বাড়ি পরিষ্কার রাখছেন।'

সিটি করপোরেশন সারা বছর কাজ করলে এ বছর ডেঙ্গু এতো বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা তো আর মানুষের ঘরে গিয়ে কীটনাশক প্রয়োগ করতে পারি না। তাই নিজের ঘর বা বাড়ির আশেপাশে নিজেকেই পরিষ্কার রাখতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ৮০ শতাংশই নির্ভর করে জনগণের ওপর আর ২০ শতাংশ সিটি করপোরেশনের ওপর। জনগণ সচেতন না বলেই ডেঙ্গু বেড়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English
digital security act

Press freedom index: Bangladesh falls 2 spots, only Afghanistan worse in South Asia

The country was ranked 165th among 180 nations, placing it only above Afghanistan among South Asian countries

1h ago