১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: দুই বাঙালি কূটনীতিকের পদত্যাগ
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে চলমান পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা ও নৃশংসতার প্রতিবাদে নাইজেরিয়ার লাগোসে পাকিস্তান দূতাবাসের চেন্সরি প্রধান মহিউদ্দিন জায়গীরদার পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
একই দিন ফিলিপাইনের ম্যানিলায় পাকিস্তান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী পাকিস্তান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ্য করেন। তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে ৪০ জন কূটনীতিবিদ পদত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
ভারতে এদিন
১৩ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সঙ্গে বৈঠক করেন মুক্তিবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে একসঙ্গে গেরিলা ও নিয়মিত সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই দিন দিল্লিতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা 'RAW' এর প্রধান রামনাথ কাওয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি মঈদুল হাসান।
১৩ সেপ্টেম্বর কলকাতায় এক টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন কেনেথ গলব্রেথ বলেন, 'পাকিস্তান যদি মনে করে পূর্ব বাংলার জনগণকে দমিয়ে রেখে স্তব্ধ করতে পারবে তবে তা ভুল। এতে করে সমাধান তো দূরে থাক পাকিস্তানের অটুট থাকাটাও দিবাস্বপ্নের মতো দাঁড়াবে। পাকিস্তান সরকারের উচিত, জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া। যেন পাকিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনগণের মাধ্যমেই তা নির্বাচিত হয়ে আসে।
পাকিস্তানে এদিন
১৩ সেপ্টেম্বর করাচিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো। প্রায় ৩ ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার এই বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা করেন তারা।
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৩ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ১৭তম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি সম্মেলন শুরু হয়। উদ্বোধনী দিনের সম্মেলনে নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধি এইচ সি টেম্পেল্টন বলেন, 'আমাদের দেশের পক্ষ থেকে কমনওয়েলথ এবং যুক্তরাজ্যকে পূর্ব পকিস্তানের নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করছি। আমরা বিশ্বাস করি তাদের সরকার স্বীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সঠিক নীতি অবলম্বন করবে।'
সম্মেলনের প্রথম দিনে গায়ানার প্রতিনিধি বিসেম্বর তার ভাষণে বলেন, 'আমি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এটা বিশ্বাস করি না আবার অবিশ্বাসও করি না যে, আমাদের স্বাধীন কোনো অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে কি না। কিন্তু আমি এটাই পেশ করছি মি. সভাপতি, যে যেখানে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ, যেখানে মানবতার অবমূল্যায়ন এবং যেখানে নৈতিকতার বিসর্জন হয় এবং একই সঙ্গে সকল আন্তর্জাতিক নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়, তখন এটা আমাদের মতো সকল কমনওয়েলথ সদস্যের একটি অধিকার ও কর্তব্য হয়ে পড়ে এমন কোনো সভায় নিজেদের মত ব্যক্ত করার। মি. চেয়ারম্যান, পাকিস্তানে বসবাসকারী মানুষের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমরা কীভাবে এই সভা পাকিস্তানে করার চিন্তা করতে পারি যেখানে নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান জয়লাভ করার পরেও পাকিস্তানে কোনো সরকার গঠন করার অনুমতি পায় না। ভারত এবং পাকিস্তানে যা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, এর থেকে দুঃখজনক ঘটনা বর্তমান পৃথিবীতে আর কিছু নেই। সুতরাং মি. চেয়ারম্যান, আমরা যারা এখানে ৩০টি দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি, তাদের কোনভাবেই এই ভয়াবহ নৃশংসতার নিন্দা প্রকাশ থেকে পিছিয়ে আসা উচিত নয়। নিন্দা প্রকাশ করা উচিত তাদের প্রতি যারা গণতান্ত্রিক বিধিবিধান লঙ্ঘন করেছে এবং একই সঙ্গে লঙ্ঘন করেছে সংবিধানকে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপরে বয়ে এনেছে সীমাহীন নৃশংসতা ও ভয়াবহ দুর্ভোগ।'
উদ্বোধনী দিনে ভারতের লোকসভার স্পিকার জি এস ধীলন বলেন, পূর্ববঙ্গের শরণার্থী সমস্যার জন্য সবার এগিয়ে আসা উচিত। কারণ এটি এখন কেবল ভারত কিংবা পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মানবিকতার খাতিরেই আমরা আশা করবো কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো শরণার্থী সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে। যাতে তাদের স্বদেশে ফেরার পথ সুগম হয়।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৩ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ আড়পাড়া সড়কের শালিখার তালখড়ি গ্রামে পৌঁছালে পূর্ব থেকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদারেরা তাদের উপর হামলা চালায়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে দিশেহারা হয়ে পড়ে। যদিও তারা এক পর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এসময় মুক্তিবাহিনীর ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১৩ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর সুধারামের করিমপুর, রামহরিতালুক, দেবীপুর ও উত্তর চাকলা গ্রামে ভোর সাড়ে ৫টা থেকে ১১টা পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার সেনারা স্থানীয় রাজাকার নেতা আমির আহম্মেদ ওরফে আমির আলী, আবুল কালাম ওরফে এ কে এম মনসুর, ইউসুফ আলি, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল কুদ্দুসসহ প্রায় ২০/২৫ রাজাকারের সহযোগিতায় প্রায় ৩০০ নিরীহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে আটক করে। এরপর তাদের মধ্য থেকে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে চিহ্নিত করে গুলি করে হত্যা করে। এরপর রাজাকার ও হানাদারেরা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেকের বাড়িসহ অসংখ্য বাড়িঘর লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে।
১৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আসার খবর পেয়ে আখাউড়া-সিলেট রেলওয়ে লাইনে মুকুন্দপুরের কাছে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন পেতে ও তার সাথে বৈদ্যুতিক তার যুক্ত করে ৩০০ গজ দূরে রিমোট কন্ট্রোল স্থাপন করে অবস্থান নেয়। এর কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য বোঝাই একটি ট্রেন নিরাপত্তার জন্যে প্রথমে বালির বস্তা ভর্তি দুটি বগিসহ অগ্রসর হয়ে মাইনের উপরে এলে বস্তা ভরা বগি পেরিয়ে যাবার পর মুক্তিযোদ্ধারা তৎক্ষণাৎ মাইন বিস্ফোরণ ঘটান। এসময় ইঞ্জিনসহ ট্রেনটি বিধ্বস্ত হলে ২৭ জন হানাদার নিহত হয়।
১৩ সেপ্টেম্বর খুলনার হরিনগরে মুক্তিবাহিনীর দুটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি গানবোট ও সৈন্য বোঝাই কয়েকটি লঞ্চকে অ্যামবুশ করে। এতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গানবোট আরোহী নিহত হয় এবং রাডার এন্টেনা ধ্বংস হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর আর্টিলারির গোলাবর্ষণে হানাদার বাহিনীর ৪টি লঞ্চ পানিতে ডুবে যায়।
১৩ সেপ্টেম্বর বরিশালের বানারীপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কয়েকটি লঞ্চ আক্রমণ করে। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর ৩টি লঞ্চ পানিতে ডুবে যায় এবং ৪০ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।
১৩ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ায় একটি ইউনিয়নে শান্তি কমিটির সভার কথা জানতে পেরে মুক্তিবাহিনীর সেখানে অভিযান চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ ২২ জন রাজাকারকে অস্ত্রসহ আটক করে।
১৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রামচন্দ্রপুর প্রধান ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর ২০ জন সৈন্য ও ১২ জন রাজাকার নিহত ও অন্য ১৩ জন সৈন্য আহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং দুইজন আহত হন।
১৩ সেপ্টেম্বর সিলেটে মুক্তিবাহিনীর ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শাহবাজপুর অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনীও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এসময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ১৫ জন হানাদার সেনা ও রাজাকার নিহত হয়।
১৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার ফতেহপুরের কাছে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল মাইন পেতে একটি রেল ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। এর ফলে লাকসাম-ফেনী- চট্টগ্রামের মধ্যে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ষষ্ঠ, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড
দৈনিক পাকিস্তান ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
দ্য গার্ডিয়ান ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
Comments