৯ অক্টোবর ১৯৭১: ‘ভারত সবসময় বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের পাশে আছে’

১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর শিমলায় অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন, 'ভারত সবসময় বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের পাশে আছে। আগামীতেও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। আমরা শরণার্থীদের পাশে সবসময় আছি। ভারত বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে আগ্রহী। তবে তার আগে বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নতি আবশ্যক। আমরা কোনোভাবেই তাদের ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারি না। সোভিয়েত ভারত চুক্তি কোনোভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী নয় এবং কোনো ধরনের হস্তক্ষেপও সেখানে করা হয়নি। আমরা চাই কোনো বিদেশি শক্তি বা দেশ আমাদের বিষয়ে নাক না গলাক।'
১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর ভুটান সীমান্তসংলগ্ন মূর্তি শিবিরে ১৪ সপ্তাহের বাংলাদেশ কোর্স সমাপণকারী প্রথম ব্যাচের সেনা অফিসারদের পাসিং-আউট অনুষ্ঠিত হয়। ৬১ জন তরুণ যোদ্ধা এই প্রশিক্ষণ লাভ করেন এবং ক্যাডেট অফিসার সাঈদ আহমেদ প্রধান সেনাপতির 'Sword of Honour' লাভ করেন। ১ জুলাই এই কোর্সের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল। প্রশিক্ষণের সমাপনী অনুষ্ঠানে ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীসহ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
ঢাকায় এদিন
৯ অক্টোবর প্রথম প্রহরে ক্র্যাকপ্লাটুনের গেরিলা যোদ্ধা হাবিবুর রহমান স্বপনের নেতৃত্বে ক্র্যাকপ্লাটুনের গেরিলাদের একটি দল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আক্রমণ করে। এছাড়া বাড্ডা-গুলশান এলাকা থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট লক্ষ্য করে ৮১ এমএম মর্টার শেলিং করে গেরিলারা। রাতে গেরিলারা একই সময়ে ঢাকা বিমানবন্দর লক্ষ্য করেও মর্টার শেলিং করে, তবে সে গোলা মহাখালীর টোবাকো কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে এসে পড়ে। পরে গেরিলারা কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই নিজেদের বাসায় ফিরে যায়।
৯ অক্টোবর কাইয়ুম মুসলিম লীগের প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, 'পাকিস্তানের আদর্শে অবিশ্বাসী শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করতে হবে। যুবকদের বাধ্যতামূলক রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের ব্যবস্থা করা হোক এবং শ্রমিকদের পরিবর্তে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজাকারদের কল-কারখানায় নিয়োগ করা হোক। যারা পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বাসী নয় তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হোক।'
৯ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের এক প্রেসনোটে বলা হয়, 'পূর্বঘোষিত উপনির্বাচনের মনোয়নপত্র গ্রহণের তারিখ ২০ অক্টোবর পর্যন্ত নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আর বাকিগুলোর মনোনয়নপত্র ১ নভেম্বরের মধ্যে জমা দিতে হবে।'
ভারতে এদিন
৯ অক্টোবর 'হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড' পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'সারা সিলেট শহরে মুক্তিবাহিনী অপ্রতিরোধ্যভাবে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ মহকুমা এবং উত্তর সিলেটের পুরো অংশ মুক্তিফৌজ দখল করেছে। এছাড়া গোয়াইনঘাট, সারি, সালুটিকর, কানাইঘাট, শ্রীমঙ্গল, শমসেরনগরে মুক্তিবাহিনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত মুক্তিফৌজের ১০ হাজার গেরিলা ওই এলাকায় পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।'
৯ অক্টোবর শিমলার কৈলাসনগরে নিখিল ভারত নব কংগ্রেসের অধিবেশনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জনজীবন রাম বলেন, 'ভারত যুদ্ধে সমর্থন করে না। তবে ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘনের কোনো অপচেষ্টা হলে ভারত দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান সাফল্যে পাকিস্তানি শাসকদের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মাঝেমধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। যা পাকিস্তানের জন্যই বিপদজনক।'
পাকিস্তানে এদিন
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় ৭৬ নম্বর সামরিক বিধি তুলে নিয়ে ৯৪ নম্বর সামরিক বিধি জারি করেন। এ আদেশে পাকিস্তানের সংহতি ও অখন্ডতা বা আদর্শের পক্ষে ক্ষতিকর প্রচার কার্যক্রমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
৯ অক্টোবর কুমিল্লায় হানাদার বাহিনীর একটি দল বুড়িচংয়ের জাগলপুরের অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণ করে। এসময় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। হানাদার বাহিনী পালানোর সময় এক মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায়। এই যুদ্ধে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। পাঁচ জন হানাদার সেনাকে আটক করে মুক্তিবাহিনী। অন্যদিকে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ২ জন আহত হন।
৯ অক্টোবর বাগেরহাটে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে। এসময় এক হানাদার অফিসার সহ মোট ১০ সৈন্য নিহত হয়। বেশ কয়েকজন গুরুতর আহতও হয়। এসময় মুক্তিবাহিনী হানাদারদের ক্যাম্প থেকে প্রচুর গোলাবারুদ আটক করে।
৯ অক্টোবর ৮ নম্বর সেক্টরের বানপুর সাব-সেক্টরে কুশলডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্যের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই অ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর ১১ সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে এক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
৯ অক্টোবর গাইবান্ধায় বিপুল সংখ্যক রাজাকার মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এসময় তারা অঙ্গীকার করে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে।
৯ অক্টোবর নীলফামারীর চিলাহাটিতে রাজাকার কমান্ডার হাবিবুর রহমান বিপুল অস্ত্রশস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
তথ্য-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পঞ্চম, সপ্তম, দশম, দ্বাদশ খণ্ড
হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড ৯ অক্টোবর ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান ১০ অক্টোবর ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১০ অক্টোবর ১৯৭১
Comments