আসাদুজ্জামান নূরের স্মৃতিতে হুমায়ূন আহমেদ

নন্দিত কথাসাহিত্যিক, জনপ্রিয় নাট্যকার এবং চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ। তার লেখা পাঠকের মন ছুঁয়ে গেছে দারুণভাবে। টেলিভিশনে নাটক লিখে তার মতো সাড়া কম নাট্যকার পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’ পরিচালনা করে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি।
হুমায়ূন আহমেদ ও আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: সংগৃহীত

নন্দিত কথাসাহিত্যিক, জনপ্রিয় নাট্যকার এবং চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ। তার লেখা পাঠকের মন ছুঁয়ে গেছে দারুণভাবে। টেলিভিশনে নাটক লিখে তার মতো সাড়া কম নাট্যকার পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’ পরিচালনা করে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘অয়োময়’, ‘বহুব্রীহি’, ‘আজ রবিবার’, ‘নক্ষত্রের রাত’ ধারাবাহিকসহ আরও অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর।

কোথাও কেউ নেই নাটকের বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করে সব শ্রেণির দর্শকদের মন জয় করে নেন খ্যাতিমান এই অভিনেতা। ‘অয়োময়’ নাটকে মীর্জার চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূরের অভিনয় আজও মনে রেখেছেন দর্শকরা। ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে’ নাটকে আসাদুজ্জামান নূর অভিনয় করেছিলেন নান্দাইলের ইউনুস চরিত্রে। এটা খুব আলোচিত একটি নাটক ছিল। ‘নিমফুল’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন মনা ডাকাত চরিত্রে। মনা ডাকাত চরিত্রটিও সেই সময়ের আলোচিত একটি চরিত্র।

এভাবে হুমায়ুন আহমেদের অসংখ্য নাটক ও সিনেমায় অভিনয় করে তাদের মধ্যে দারুণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পেশাদারিত্বের বাইরে হুমায়ূন আহমেদ ও আসাদুজ্জামান নূরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

আজ ১৯ জুলাই হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণ দিবস। নন্দিত লেখক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের কাছে স্মৃতিচারণ করেছেন আসাদুজ্জামান নূর।

তিনি বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের লেখা এক ঘণ্টার একটি নাটকে অভিনয় করেছিলাম অনেক বছর আগে। সেই নাটকের নামটা মনে নেই। তখন থেকেই আমার অভিনয় তার ভালো লেগে যায়। এরপর তার যত নাটক হয়েছে এবং আমি যতদিন নিয়মিত অভিনয় করেছি, তার সব নাটকে আমাকে অভিনয় করতে হয়েছে।

যখন থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়ি, অভিনয় কমিয়ে দেই। তখন আর তার নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতে পারিনি। হঠাৎ হঠাৎ করেছি। এ নিয়ে তিনি মনঃক্ষুণ্ণ ছিলেন।

হুমায়ূন আহমেদকে আমি বলব— বাংলাদেশে তার মতো গল্প বলার ক্ষমতা খুব কম নাট্যকারের ছিল। গল্প বলায় তার মতো মুনশিয়ানা কম লেখকেরই ছিল। নাটকের জন্য যখন সংলাপ লিখতেন, তখন খুব বেশি কষ্ট করে আমাদের মুখস্থ করতে হতো না। মনে হতো এসব সংলাপ আমাদের জীবনের সঙ্গেই মিশে আছে।

তার নাটকের গল্পে জটিলতা থাকত না। সংলাপে মারপ্যাচ থাকত না। সহজ সরল ভাষায় সংলাপ লিখতেন। কিন্তু, সেসব সহজ সরল সংলাপগুলোই মানুষ মনে রাখতেন। মানুষকে গভীরভাবে টেনেছে সেসব সংলাপ।

লেখক হিসেবে তিনি কতটা সফল তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। নাট্যকার হিসেবেও ব্যাপক সফল একজন মানুষ ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। পরিচালক হিসেবেও কম করেননি। মুক্তিযুদ্ধের “সিনেমা আগুনের পরশমণি” পরিচালনা করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন সেরা কাজ সিনেমায়ও করতে পারেন। বাংলাদেশের যতগুলো মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নির্মিত হয়েছে, তার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের এই সিনেমাটি কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।

সেজন্য বলব, ভালো একজন পরিচালকও তিনি।

তবে, হুমায়ুন আহমেদের মধ্যে ধৈর্যের খুব অভাব ছিল। এই মানুষটি কেমন ছিলেন একটু ব্যাখ্যা করি। শুটিংয়ের সময় অনেকবার হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর শুটিং করবেন না। কোনো কারণ ছাড়াই এটা করেছেন।

শুটিং বন্ধ করে বলতেন, এখন আড্ডা হবে। শুরু হয়ে যেত আড্ডা।

তার একটা বড় গুণ ছিল নিয়মিত লিখতেন। কেবল লেখালেখিটা তিনি সময় করে এবং নিয়ম মাফিক করে গেছেন সারাজীবন। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে লেখালেখি শুরু করতেন। টানা কয়েক ঘণ্টা লিখতেন। তাও বলপয়েন্ট দিয়ে। দামি কোনো কলম দিয়ে নয়।

সাধারণ বলপয়েন্ট দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখাগুলো হয়ে উঠত অসাধারণ। পাঠকরা সমানে কিনতেন তার বই। লেখালেখিতে তার মতো জনপ্রিয়তা এদেশে কোনো লেখক পাননি। একজন সৌভাগ্যবান লেখক ছিলেন তিনি।

নাটক লেখার পর মাঝে মাঝে আমাকে পড়ে শোনাতেন। কোনো মতামত দিলে তা সাদরে গ্রহণ করতেন।

আমার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের ভালো কেমিস্ট্রি গড়ে উঠেছিল। এটা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিল। তিনি অভিনয়ের বিষয়ে কী চাইতেন আমি বুঝতাম। আবার আমি কী চাই তা বুঝতেন তিনি। এমন কেমিস্ট্রি কম লেখক ও শিল্পীর মধ্যেই থাকে।

তার গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। বেড়াতেও খুব ভালোবাসতেন। দলবল নিয়ে বেড়াতে যেতেন। আড্ডা-আনন্দ করতে পছন্দ করতেন। মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডা দিতেন।

পড়ালেখাও করতেন প্রচুর। পৃথিবীর বড় বড় লেখকের বই পড়তেন। তিনি তো পিএইচডি করা মানুষ ছিলেন। জ্ঞান ছিল খুব। আমরা যারা তার সঙ্গে আলোচনা করতাম তারা জানি কতটা জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।

মাঝে মাঝে ভাবি— আড্ডা, গান লেখা, নাটক লেখা, বই লেখা, সিনেমা লেখা, আবার পরিচালনা করা, বেড়ানো, এতসব কীভাবে করেছেন তিনি? পরিশ্রমী ছিলেন বলেই সম্ভব হয়েছিল।

আবার ছবিও আঁকতেন। এ ছাড়াও ম্যাজিকের প্রতিও ছিল তার অন্যরকম আকর্ষণ।

বন্ধুত্বের মাঝেও তার সঙ্গে কখনো কখনো মান-অভিমান যে হতো না তা কিন্তু নয়। মান-অভিমান হতো। কিন্তু, সেসব মান-অভিমান এক ঘণ্টাও স্থায়ী হত না। হঠাৎ করেই রেগে যেতেন তিনি। আবার হঠাৎ করেই সব রাগ মাটি হয়ে যেত। ভালোবাসার ক্ষমতাও ছিল অনেক।

তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা আমেরিকায়। যখন তিনি হাসপাতালে। সেখানে টানা তিন দিন আমি ছিলাম। আমি ছাড়াও মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইয়াসমিন হক, মেহের আফরোজ শাওনসহ আরও কয়েকজন ছিলেন। ওই তিন দিন পুরোটা সময় কাটিয়েছি হাসপাতালে। তখন মনে হয়েছিল হুমায়ূনের সঙ্গে তো আমরা আছি।

আজকের দিনেই চলে গেছেন হুমায়ুন। তার কথা খুব মনে পড়ে।’

Comments

The Daily Star  | English
digital security act

Press freedom index: Bangladesh falls 2 spots, only Afghanistan worse in South Asia

The country was ranked 165th among 180 nations, placing it only above Afghanistan among South Asian countries

1h ago