নদী যেভাবে খুন হয়

নদী যে জীবন্ত সত্তা, অর্থাৎ তারও যে প্রাণ আছে, আছে অনুভূতি এবং সেই অনুভূতির সঙ্গে মানুষও যে একাত্ম, সেটি বহু আগেই টের পেয়েছিলেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। তাই তিনি কবিতায় বলেছিলেন- 

নদী যে জীবন্ত সত্তা, অর্থাৎ তারও যে প্রাণ আছে, আছে অনুভূতি এবং সেই অনুভূতির সঙ্গে মানুষও যে একাত্ম, সেটি বহু আগেই টের পেয়েছিলেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। তাই তিনি কবিতায় বলেছিলেন- 

'যেইখানে পৃথিবীর মানুষের মতো ক্ষুব্ধ হয়ে

কথা কয়, আকাঙ্ক্ষার আলোড়নে চলিতেছে বয়ে

হেমন্তের নদী।'

নদী যে পৃথিবীর মানুষের মতোই ক্ষুব্ধ হয়, কথা কয়, তারও যে আকাঙ্ক্ষা রয়েছে—জীবনানন্দের আগে এমন কথা বাংলা সাহিত্যে আর কে লিখেছেন! নদীর এই অনুভূতি বোঝার সাধ্য আর কার হয়েছে?

জীবনানন্দের এই তর্জমার বহু বছর পরে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত রাজধানীর প্রতিবেশী তুরাগসহ দেশের সকল নদীকে 'লিভিং এনটিটি' বা 'জীবন্ত সত্তা' হিসেবে ঘোষণা করেন। তার অর্থ হলো, দেশের নদীগুলো এখন থেকে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণির মতোই আইনি অধিকার পাবে। আদালতের রায় অনুযায়ী নদীগুলো এখন 'জুরিসটিক পারসন' বা 'লিগ্যাল পারসন'। এর মধ্য দিয়ে মানুষের মতো নদীরও মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। সুতরাং নদীকে হত্যা করার অর্থ হলো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হত্যা করা। নদীদূষণ এবং দখলকারী মানবজাতির হত্যাকারী। নদীদূষণ এবং দখলকারী সভ্যতা হত্যাকারী। আদালত স্পষ্ট করে বলেছেন, তুরাগ নদীসহ বাংলাদেশের সব নদীই মূল্যবান এবং সংবিধান, বিধিবদ্ধ আইন ও পাবলিক ট্রাস্ট মতবাদ দ্বারা সংরক্ষিত।

নদী যেভাবে মা

নদী যে জীবন্ত সত্তা বা মানুষের মতো যে তারও অধিকার আছে, সেটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ বাংলাদেশকে বলা হয় 'নদীমাতৃক'। অর্থাৎ নদী যার মাতা। নদী মা হিসেবে স্বীকৃত। সন্তানের কাছে মায়ের যা অধিকার, বাংলাদেশের মানুষের কাছে নদীর অধিকারও তাই। সুতরাং এই দেশে একটি নদীও দখল-দূষণে খুন হওয়ার মানে হলো তার সন্তানরাই তাকে হত্যা করেছে।

প্রশ্ন হলো, বছরের পর বছর ধরে এই দেশে নদীরা হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কিন্তু সেই হত্যার শাস্তি কী? বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে মানুষ হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি যেখানে মৃত্যুদণ্ড, সেখানে নদীমাতাকে হত্যার শাস্তি কী এবং এই হত্যা ও নির্যাতনের অপরাধে এখন পর্যন্ত তার কতজন সন্তানের ফাঁসি হয়েছে?

বাংলাদেশের সংবিধান (অনুচ্ছেদ ১৮ক) বলছে, 'রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।' তার মানে জলাভূমি অর্থাৎ নদীর নিরাপত্তা বিধান সংবিধানস্বীকৃত এবং সেটি সেটি করতে হবে স্বয়ং রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র মানে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। যে কারণে ২০১৯ সালে হাইকোর্ট যখন একটি রায়ে নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেন, তখন নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করা হয়—যারা রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে নদীমাতার অধিকার রক্ষা করবে। কিন্তু সেই অধিকার কতটুকু রক্ষিত হচ্ছে?

নদী যেভাবে খুন হয়

সম্প্রতি জাতীয় সংসদের পরিবেশ বিষয়ক স্থায়ী কমিটি রাজধানীর অদূরে হেমায়েতপুরে গড়ে তোলা ট্যানারি পল্লি বন্ধের সুপারিশ করেছে। কারণ ওই ট্যানারির বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। এতে নদীর পানি শুধু দূষিত নয়, বিষাক্ত হয়ে গেছে। এই ট্যানারির হাত থেকে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য সরিয়ে নেয়া হলো হেমায়েতপুরে। কিন্তু ট্যানারি সরলেও নদীর দুঃখ ঘোচেনি।

কথিত উন্নয়নের করাতে নদীকে চেরাই করার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। সারা দেশেই কমবেশি এই দৃশ্য রয়েছে। রাজধানীর ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে চলা বা আরও পরিস্কার করে বললে, যে নদীর তীরে এই শহরটি গড়ে উঠেছে, সেই বুড়িগঙ্গার তীরে শুকনো মৌসুমে গিয়ে দাঁড়ানো কঠিন। পানি পঁচে এতটাই দুর্গন্ধ ছড়ায় যে, এই নদীর পানি ব্যবহার তো দূরে থাক, বলা হয় এই নদীতে মাছ তো দূরে থাক, পোকামাকড়ও বাঁচতে পারে না। খোদ রাজধানী শহরের পাশ দিয়ে বলে চলা চারটি নদীর (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা) দশাই কমবেশি এক। এর প্রধান কারণ অর্থনীতি।

রাজধানী থেকে দূরবর্তী জেলা বা উপজেলা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কিংবা গ্রামীণ এলাকার নদীতীরের জমির চেয়ে ঢাকার আশপাশের নদীতীরবর্তী জমির দাম ও মূল্য অনেক বেশি। ফলে এখানে স্থায়ী বা অস্থায়ী যেকোনো অবকাঠামো গড়ে তোলা গেলেই সেখান থেকে লাখ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। আর যেকোনো নদীর তীরে স্থাপনা তৈরির জন্য প্রথমেই দরকার হয় কোনো না কোনো কায়দায় নদীর জমি ভরাট করা। প্রথমে ময়লা ফেলে, তারপর বাঁশ বা কাঠের অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করে এবং কখনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে (যাতে কেউ উচ্ছেদ করার সাহস না পায়) ধীরে ধীরে নদীর জায়গা সংকুচিত করা হয়। অর্থাৎ একজন মানুষকে যেমন কোনো একটি জায়গায় আটকে রেখে তাকে দিনের পর দিন প্রয়োজনীয় খাদ্য, আলো, বাতাস না দিয়ে দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়, নদীর ক্ষেত্রেও সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করে তাকে ধীরে ধীরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়—যার পেছনে প্রধানত সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই যুক্ত থাকেন।

দখল ছাড়া আরও নানাভাবেই নদীকে খুন করা হয়। যেমন দূষণ। শিল্প-কারখানার বর্জ্য সঠিক উপায়ে পরিশোধন না করে বছরের পর বছর নদীতে ফেলা; মানুষের পয়ঃবর্জ্য নদীতে ফেলা; প্লাস্টিকসহ নানারকম অপঁচনশীল দ্রব্য নদীতে ফেলা; নদীর প্রবাহ সংকুচিত করা ইত্যাদি। এর বাইরে অপরিকল্পিত ও অবৈধ বালু উত্তোলন; চাষাবাদ ও মাছ ধরার জন্য নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে এর প্রবাহ ক্ষীণ করে ফেলা; উন্নয়নের নামে নদীর জায়গা দখল করে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করা ইত্যাদি। তবে এই কাজগুলো যে কেবল ব্যক্তি পর্যায় থেকে হয়, তা নয়, বরং খোদ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও অনেক সময় নদী হত্যার জন্য দায়ী।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে নদী খুন করা হয়, তার বড় উদাহরণ কুড়িগ্রামের চাকিরপশা নদী। প্রথমে এই নদীর দুইপাড় স্থানীয়রা বিভিন্নভাবে দখল করে সংকুচিত করে ফেলে। মাছ চাষের জন্য নদীর দখল করা জায়গায় কাটা হয় পুকুর। নদী হত্যা করে তার বুকে পুকুর কাটার এমন অদ্ভুত ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। যদিও স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের আন্দোলনের মুখে সরকার নড়েচড়ে বসে এবং নদীটি দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারি তালিকায় ২২জন এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে অন্তত একশো লোক এই নদীটি হত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা যায়নি বা তাদের যে কারাদণ্ড হয়েছে, সে কথাও শোনা যায়নি। সরকারি অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগে এমন কোনো নির্যাতন নেই, যা এই নদীর ওপর হয়নি। কিন্তু এর জন্য দায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিকে শাস্তি পেতে হয়নি।

তবে নদী দখল ও দূষণের কথা বললে আমরা সব সময় বড় নদীকেই বুঝি। কিন্তু দেশের অসংখ্য ছোট নদী ও  খালের ওপর যে সেতু হয়েছে, যেগুলো এলজিইডি নির্মাণ করেছে এবং এর ফলে যে অসংখ্য নদীর মৃত্যু হয়েছে, সেটি আমাদের ভাবনার আড়ালে থেকে যায়। এইসব ব্রিজ ও কালভার্টের নির্মাণকৌশলই ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু যারা এরকম ত্রুটিপূর্ণ নকশা করে আমাদের নদীমাতাকে হত্যা করলেন বা এখনও করে চলেছেন, তাদের কোনো শাস্তি হয় না। পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত মনে করেন, নদী হত্যার দায়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডির বিচার হওয়া উচিত (কালের কণ্ঠ, ১৪ জানুয়ারি ২০২২)। তার মতে, যেসব সরকারি কর্তাব্যক্তি নদীকে ব্যক্তির নামে লিখে দেন তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। যারা নদীকে বিল কিংবা জলমহাল নাম দিয়ে লিজ দেন, তারাও নদীর অনেক বড় শত্রু। তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তির সংস্কৃতি চালু করতে হবে।

নদী খুনের শাস্তি  

প্রশ্ন হলো, নদীকে জীবন্ত সত্তা বলা হলেও সত্তাকে হত্যার অপরাধে কোনো শাস্তি আছে কি? সংবিধান বলছে, রাষ্ট্র জলাভূমির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবেন। কিন্তু না করলে কী হবে? বস্তুত, দেশে নদীরক্ষার জন্য বা নদীকে দখল ও দূষণের হাত থেকে বাঁচানো এবং নদী হন্তারকদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য আলাদা করে কোনো আইন নেই।

পরিবেশ সুরক্ষা আইন এবং জলাধার সুরক্ষা আইনে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু নির্দেশনা ও শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনে বলা হয়েছে, নদীসহ যেকোনো প্রাকৃতিক জলাধার দখল বা অবৈধ ব্যবহার করা হলে দায়ী ব্যক্তি অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। এই আইনে আরও বলা হয়েছে, কোনো জলাধারের জায়গায় অননুমোদিত নির্মাণকার্য হলে সেটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিতে পারবে এবং অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই ভেঙে ফেলার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না। অর্থাৎ কেউ যদি নদী দখল করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করে তাহলে সেটি দখলকারীকেই ভেঙে ফেলতে হবে।

আশার কথা, নদী দখল ও দূষণ ঠেকাতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০২০ এর খসড়ায় বেশ কিছু কঠোর বিধান রাখা হয়েছে। যেমন নদীর দখল ও দূষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ২০১৩ সালে যখন এই আইনটি হয়, সেখানে এ ধরনের অপরাধের জন্য কোনো শাস্তি নির্ধারিত ছিল না।

আগের আইন অনুযায়ী, নদী দূষণ ও দখল রোধে সুপারিশ করা ছাড়া নদী রক্ষা কমিশনের কোনো কাজ নেই। কিন্তু নতুন আইন অনুযায়ী, কমিশন নদী দখল ও দূষণ রোধ এবং নদীর উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেবে। এই নির্দেশনা মানতে সংস্থাগুলো বাধ্য থাকবে। সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কমিশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। খসড়া আইনে নদী সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য 'নদী রক্ষা কোর্ট' গঠনের বিধানও রাখা হয়েছে।

তার মানে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নদী যেহেতু এখন থেকে জীবন্ত সত্তা এবং বাংলাদেশ যেহেতু নদীমাতৃক, অর্থাৎ নদীই যে দেশের মা, সেই মায়ের সম্ভ্রম রক্ষায়, সেই মায়ের জীবন বাঁচাতে রাষ্ট্র যে এগিয়ে আসছে, সেটি খুবই আশার কথা। তবে আইনটি দ্রুত পাস হওয়া দরকার এবং আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে জীবন্ত সত্তা নদীর বিষয়টি রায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।

Comments

The Daily Star  | English

Uncertainty lingers over Chhatak Cement’s return to operation

State-run Chhatak Cement Company in Sunamganj might not return to production anytime soon as its modernisation project is set to miss the deadline for the second time while uncertainty over the supply of the key raw material persists.   

10h ago