জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের কবি

ছাত্র জনতার বিপ্লবে দেখা গেছে- নজরুল এই জাতির জীবনে কি ভীষণ প্রাসঙ্গিক। সারাদেশ জুড়ে দেয়ালের গ্রাফিতি রেখেছে তার নিদর্শন।
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের যে কোন সঙ্কটে বিপর্যয়ে যেমন ছিল, ঠিক তেমনটা বর্তমানেও বেইনসাফির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নজরুলের সৃষ্টি আমাদের প্রেরণা। একাত্তর ও নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবে যে কবি আবারো কবিতায়, গানে আর দেয়ালের গ্রাফিতি ও লিখনে প্রাসঙ্গিক। অপরিহার্য অস্তিত্বের জানান দিলেন কবি নজরুল। অনেক আগে বলে গেছেন।

''আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলে শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম । যে কুলে যে সমাজে যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করিনা সে আমার দৈব । আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।''

জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের কবি। অসাম্যের বিরুদ্ধে সাম্যের কবি। নজরুলের চেতনাই বাংলাদেশের চেতনা। ফ্যাসিবাদী শাসনের গত ষোল বছর এই চেতনার দ্বার রুদ্ধ করে জাতিকে বিভক্ত করে ভুল পথে চালিত করা হয়েছিল। ফ্যাসিষ্টরা ভুল চেতনার বয়ান তৈরি করে 'চেতনা' শব্দটিকেই কলঙ্কিত করেছে। জুলাইয় বিপ্লবে বাংলাদেশ ফিরে পেয়েছে তার কাঙ্ক্ষিত গতিপথ। এই নজরুলকে আমরা আবার আমাদের করে পেয়েছি। তার চেতনায় জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। ঐক্য ধরে রাখতে নজরুল চর্চার কোন বিকল্প নেই।

১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে নজরুল ইনস্টিটিউট কবির জীবন ও তার সৃষ্টি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। নজরুল রচনা, স্বরলিপি গ্রন্থ, নিজস্ব পত্রিকা, স্মারক গ্রন্থ, গবেষণা গ্রন্থ, ও বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদসহ  এই পর্যন্ত মোট প্রকাশনার সংখ্যা ৪৩৭ টি। এছাড়াও রয়েছে অডিও ক্যাসেট, সিডি, তথ্যচিত্র, পোস্টার সহ কবি নজরুল বিষয়ক তথ্যের বিশাল ভাণ্ডার। সঙ্গে রয়েছে একটা দারুণ সমৃদ্ধ লাইব্রেরী। আমি যোগদানের পর বিস্মিত হয়েছি এটা দেখে যে, এই বিপুল তথ্য ভাণ্ডার বছরের পর বছর প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়ে রয়েছে। ঢাকা শহরের মানুষ জার্মান কবির নামে প্রতিষ্ঠিত গ্যেটে ইন্সিটিউটকে অথবা ছায়ানটকে যেভাবে চেনে সেভাবে নজরুল ইন্সটিটিউটকে চেনে না। কারণ, নজরুলকে প্রমোট বা ব্রান্ডিং এর কোনটাই করা হয়নি। প্রসঙ্গে আমাদের কিছু পরিকল্পনা-

 ১) সংবিধানে জাতীয় ফুল, পাখি, প্রাণি, বৃক্ষ, মাছ, নদী ইত্যাদি থাকলেও আমাদের জাতীয় কবির নাম এখনও সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কবি নজরুলকে প্রত্যক্ষভাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে এবং জাতীয় কবির গেজেট অতি দ্রুত প্রণয়ন করতে হবে।   

২)  স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণীতে এবং সিলেবাসে গুরুত্বের সাথে নজরুলের রচনা ও দর্শনকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর পক্ষে কবি নজরুল ইনস্টিটিউট দাবী তুলবে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে উদ্যোগী হয়ে  আলোচনা করবে।

 ৩) নজরুল ইনস্টিটিউটকে গণমুখি করার লক্ষে বাংলা একাডেমির মতো সাধারণকে ইনস্টিটিউটের সদস্য হওয়ার সুযোগ তৈরি করা হবে এবং সদস্যদের অংশগ্রহণে নিয়মিত সভার আয়োজন করা হবে। নজরুলের বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, সমসাময়িক সাহিত্যিকদের স্মৃতি থেকেও নজরুলকে আবিস্কার করা হবে। 

৪) নজরুল সাহিত্যকর্ম ও সমসাময়িক বিশ্বে স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে নজরুলের চিন্তাধারার প্রাসঙ্গিকতা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে অনুবাদ ও গবেষণার জন্য বিশ্বের  বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে 'নজরুল সেন্টার' প্রতিষ্ঠার মতো দ্বিপাক্ষিক এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতার সম্পর্ককে সুদৃঢ় করতে  কাজ করবে।

৫) নজরুল-স্মৃতি বিজড়িত সকল স্থান ও স্থাপনা অবিকৃত আকারে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হবে।

৬) গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন ধানমন্ডি লেকে 'নজরুল সরোবর' নির্মাণের ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশন যে জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে সেখানে দ্রুততার সঙ্গে কাজ শুরু করার বিষয়ে আমরা উদ্যাগ নিয়েছি।

৭) নজরুলের সকল সৃষ্টি ইংরেজি, আরবি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশসহ পৃথিবীর প্রধান প্রধান ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করা হবে। ইতোমধ্যে নজরুল সমগ্র ইংরেজিতে অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছে।

৮) বিদেশে বাংলাদেশের সকল মিশনে নজরুল কর্নার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হবে। তার রচনা পড়তে উৎসাহিত করা হবে।

৯) ছাত্র জনতার বিপ্লবে দেখা গেছে- নজরুল এই জাতির জীবনে কি ভীষণ প্রাসঙ্গিক। সারাদেশ জুড়ে দেয়ালের গ্রাফিতি রেখেছে তার নিদর্শন। আমাদের কাজ হবে এই নজরুল চেতনায় জাতীয় ঐক্যকে অটুট রাখার জন্য প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ তথা বিভিন্ন কর্মসূচি তৈরি করা। আঞ্চলিক লাইব্রেরি ও পাঠাগারকে এর সঙ্গে যুক্ত করা।
১০) জাতীয় কবির প্রকাশনাসমূহ তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য বিভাগীয় শহরে 'নজরুল কর্ণার' স্থাপন করে প্রকাশনা বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা। সেই লক্ষে ইতিমধ্যে আমরা ৭টি বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারগণের দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছি।
১১)  এই সময়ে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতে সমকালিন ইস্যুর সঙ্গে নজরুল  চেতনাকে মিলিয়ে দেশব্যাপি বিষয় ভিত্তিক আলোচনা সভার আয়োজনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় "২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আমাদের নজরুল"  শীর্ষক রচনা প্রতিযোগি শুরু করেছি।
১২) প্রজন্মের কাছে নজরুল সঙ্গীতের আবেদন তৈরী করতে উন্মুক্ত জায়গায় 'নজরুল কনসার্ট' আয়োজনের পরিকল্পনা হয়েছে।
১৩) তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় একটি আন্তর্জাতিক নজরুল বায়োপিক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
১৪) নজরুলের সমস্ত সৃষ্টিকর্মকে একটি ওয়েব সাইটে নিয়ে আসা। 'নজরুল ডিজিটাল আর্কাইভ' যাতে ই-বুক পাওয়া যাবে।
১৫) নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপনের জন্য  বরিশাল ও মানিকগঞ্জে স্থাপত্য নকশা প্রণয়ন করে জমির সার্ভে নকশা স্থাপত্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। 
১৬। নজরুল বন্ধু ড. কাজী মোতাহার হোসেন নজরুলের ভাষ্যেই রমনা লেক-এর যাওয়ার স্মৃতিচারণ করেছেন এবং কবির অনুজ  বন্ধু আবদুল কাদির লিখেছেন নজরুল তাকে নিয়ে রমনা লেকের ধারে বেড়াতে গিয়েছিলেন এবং সেখানে বসে তাঁর একটি বিখ্যাত গজল 'নিশি ভোর হল জাগিয়া' রচনা করেছিলেন। নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত এই রমনা লেকের নামকরন- 'নজরুল সরোবর' করা ও নজরুল মঞ্চ তৈরি করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।
১৭) নজরুল বিষয়ক অনুষ্ঠান আয়োজন ও মহড়ার জন্য ইনস্টিটিউট বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে অডিটরিয়াম বরাদ্দ প্রদান করবে। শিক্ষার্থীদের জন্য নামমাত্র মূল্যে পেপারব্যাক- নজরুল রচনাবলি প্রকাশ ও বিক্রি ব্যবস্থা করা হবে। 
১৮) নজরুল ইনস্টিটিউট লাইব্রেরী রাত ১০ টা পর্যন্ত খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হবে এবং লাইব্রেরির সদস্য পদ তৈরি করে ব্যবহারের  সুযোগ নিশ্চিত করা হবে।
১৯) প্রতিটি জাতীয় অনুষ্ঠানে জাতীয় কবিকে যথাযথভাবে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়া হবে।

এগুলো আমাদের পরিকল্পনা। আমাদের ইচ্ছা কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভৌগলিক সিমা ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন করা। নজরুল আমাদের উন্মেষে, রাষ্ট্রের নির্মাণে, মাটি ও মানুষের মুক্তির সংগ্রামে ও আকাঙ্ক্ষায়, তারুণ্যের উদ্দীপনায়, আনন্দে-বেদনায়, সবসময় প্রাসঙ্গিক আছেন এবং থাকবেন।

কবি ও কথাসাহিত্যিক। নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট।

Comments