‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেশকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্ত করেছে’

‘বাংলাদেশের এই নতুন স্বাধীনতায় আঞ্চলিক জোট সার্কের পুনর্জাগরণের পথ তৈরি হবে এবং এটি এ অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি বলিষ্ঠ সংগঠনে পরিণত হবে।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সাদী মুহাম্মাদ আলোক/স্টার

প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের সাপ্তাহিক পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত নিজের লেখায় ড. ইউনূস এই মন্তব্য করেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সব রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এবং অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ওপর জোর দেন।

তিনি জানান, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ অনেক ইতিবাচক অর্জনের জন্য পরিচিতি পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে দারিদ্র্যের হার কমা, ক্ষুদ্র ঋণের প্রবর্তন, সামাজিক উদ্যোগ ও ব্যবসার 'সিলিকন ভ্যালি' হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার মতো বিষয়।

এ ছাড়া, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মাঝে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টিতে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের অনন্য ধারণার প্রবর্তনকেও গত তিন দশকে বাংলাদেশের অন্যতম সাফল্য হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।

পাশাপাশি, তৈরি পোশাক শিল্পের সাফল্যের কথা আলাদা করে উল্লেখ করেন তিনি। জানান, এই শিল্পের মাধ্যমে প্রতি বছর বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের পোশাক বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে এবং এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন নারীরা।

ড. ইউনূস বলেন, তবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এসব অর্জন সত্ত্বেও গণতন্ত্র ক্ষয় হতে হতে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে, এমন দেশ হিসেবেও আমরা পরিচিত। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন এতটাই বিতর্কিত ছিল যে তা ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের স্বতঃস্ফূর্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অর্জনকে ম্লান করেছে।

'৩০ বছরের কম বয়সী কোনো বাংলাদেশি এখনো "কারচুপি হয়নি" এমন নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি', যোগ করেন তিনি।

গত ১৫ বছরে সরকার অসংখ্য সংস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলেছে, যার মধ্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিচার বিভাগ ও শিক্ষাব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত।

ড. ইউনূস জানান, এসব ঘটনার ফলে সব খাতের মেধাবী মানুষগুলো ভিনদেশে পাড়ি দিয়েছেন। যারা থেকে গেছেন, তাদের সামনে একমাত্র বিকল্প ছিল হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানানো অথবা নির্যাতনের শিকার হওয়া।

'আমি নিজে দ্বিতীয় বিকল্পটি বেছে নেই এবং গত সপ্তাহের তথ্যমতে, আমার বিরুদ্ধে আদালতে ১৯০টি মামলা চলছিল। আমার বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা চলছে। বিচারে দোষী প্রমাণ হলে যার সর্বোচ্চ দণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আমার বিরুদ্ধে জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগও আনা হয়েছে', যোগ করেন অধ্যাপক ইউনূস।

ড. ইউনূস জানান, তিনি সাম্প্রতিক সময়ে আদালত ও আইনি লড়াইয়ের পেছনে যত বেশি সময় দিয়েছেন, তার চেয়ে অনেক কম সময় দিতে পেরেছেন তার ভালোবাসার বিষয়গুলোতে। উদাহরণ হিসেবে তিনি সামাজিক ব্যবসার কথা জানান, যার মাধ্যমে বাজার-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলমসহ আরও অসংখ্য মানুষের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, 'শুধু আমিই এ ধরনের হয়রানির মধ্য দিয়ে গেছি, ব্যাপারটা এমন নয়।'

ড. ইউনূস জানান, গত এক মাসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও বিক্ষোভ বাংলাদেশকে এই একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছে। শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে এই বিক্ষোভ শুরু হলেও দ্রুত এটি সারা দেশের মানুষের এক দফার আন্দোলনে পরিণত হয়: শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ।

'৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীদের দাবি পূরণ হয়। প্রধানমন্ত্রী দেশত্যাগ করেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী ও নিরীহ জনগণসহ মোট ৩০০ জনের প্রাণহানিতে গভীর শোক প্রকাশের পাশাপাশি দেশের প্রায় সব নাগরিকদের মতো আমিও এই সংবাদে আনন্দিত হই। এখন আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যেন তাদের এই আত্মত্যাগ বৃথা না যায়। বরং, এতে যেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সাম্যবাদের সোনালি যুগের সূচনা হয়, সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে', যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আমাদের পরবর্তী উদ্যোগ হবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, সব রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এবং কয়েক মাসের মধ্যে একটি মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন। আমি এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে আগ্রহী এবং আমি আশা করব অন্যান্যরাও আমার পাশে থাকবেন। আমাদের জরুরিভিত্তিতে নতুন রাজনীতিবিদ প্রয়োজন। তরুণদের মধ্যে থেকে নতুন নেতৃত্ব আসতে হবে। সর্বোপরি আমাদের এমন তরুণ নেতৃত্ব প্রয়োজন, যারা প্রতিশোধ-পরায়ণ নন। আমাদের আগের সরকারগুলোর মধ্যে ব্যাপকভাবে এই প্রবণতা দেখেছি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর এবারের এই দ্বিতীয় বিপ্লবের সম্মুখে যেসব ছাত্রনেতারা ছিলেন, তাদের উচিত সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়া।'

ড. ইউনূস আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের শুভকামনা জানান এবং তাদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা জানান। তিনি বলেন, 'আমি তাদেরকে তিন শূন্যের পৃথিবী গড়তে উৎসাহ দেবো—শূন্য কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ ও শূন্য বেকারত্ব।'

শেখ হাসিনা সরকারের 'অন্ধকার যুগেও' দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন যুগিয়েছে যেসব ব্যক্তি ও সংগঠন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।

এই সময় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও ক্লুনি ফেডারেশন ফর জাস্টিসের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস।

'সারা বিশ্বের মানুষ আমাদের জনগণের ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সরব ছিল। প্রবাসী বাংলাদেশি, বিশেষত শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীরা দেশের বাইরে থেকে তাদের মাতৃভূমিতে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করে গেছে। আমি আশা করব, তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশে ফিরে এসে আমাদের গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ ও অর্থনীতি বিনির্মাণে সহায়তা করবেন', যোগ করেন তিনি।

তিনি উল্লেখ করেন, ভারতের মতো কয়েকটি দেশ সদ্য-উৎখাত হওয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে দেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, এ ধরনের ক্ষত সারিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব পুনর্গঠনের সুযোগ রয়েছে।

তিনি আশা করেন, বাংলাদেশের এই নতুন স্বাধীনতায় আঞ্চলিক জোট সার্কের পুনর্জাগরণের পথ তৈরি হবে এবং এটি এ অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি বলিষ্ঠ সংগঠনে পরিণত হবে।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি পেছনের দিকে হেঁটেছে বলেও মন্তব্য করেন ড. ইউনূস।

'আসুন ৫ আগস্ট পাওয়া দ্বিতীয় স্বাধীনতার হাত ধরে আজ থেকেই আমরা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি। যারা এই গুরুত্বপূর্ণ নতুন বিজয়ে আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের মাঝ থেকেই নতুন প্রজন্মের একদল নেতা উঠে আসুক। যাদের আত্মত্যাগে আমরা এই নতুন সুযোগ পেয়েছি, তাদের সেই আত্মত্যাগ তখনই সফল হবে যখন দেশের উন্নতির জন্য নতুন নেতৃত্বের প্রাণশক্তি ও দূরদৃষ্টির উপযুক্ত ব্যবহার করা যাবে। এটা এমন এক সুযোগ, যা ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না', যোগ করেন তিনি।

Comments