‘জুলাই সনদ’ খসড়া প্রস্তুত, রাষ্ট্র কাঠামোতে ব্যাপক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দেশের শাসনব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ এবং দুর্নীতি দমন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার কার্যকর করতে 'জুলাই জাতীয় সনদের' খসড়া প্রণয়ন করেছে।

পর্যালোচনার জন্য 'জুলাই সনদের' খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে কয়েক মাসব্যাপী রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ শেষে এই সনদ চূড়ান্ত করা হয়েছে।

আজ সোমবার দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, 'আমরা সনদের ভাষাটি পর্যালোচনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে খসড়া পাঠিয়েছি।'

তিনি বলেন, 'যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, তা চূড়ান্ত সংলাপ শেষে চূড়ান্ত সনদে সংযোজন করা হবে।'

এ সনদে একটি বাধ্যতামূলক রোডম্যাপ নির্ধারিত হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃত্ববাদ ও পদ্ধতিগত দুর্নীতির কবলে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারের লক্ষ্য নির্ধারণ করবে।

ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি দেবে যে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণআন্দোলনে নিহত হাজারো নাগরিকের আত্মত্যাগকে সম্মান জানানো হবে এবং এই সনদকে একটি সম্মিলিত নৈতিক দায় হিসেবে গ্রহণ করে তা পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।

এছাড়া, এতে দেশের সাংবিধানিক কাঠামো, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ এবং দুর্নীতি দমন ব্যবস্থাকে আইনি ও নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্গঠন করার কথা থাকবে।

নির্বাচিত পরবর্তী জাতীয় সংসদের প্রথম দুই বছরের মধ্যে সনদে থাকা সব আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে এবং গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য এটি বাধ্যতামূলক আইনি গ্যারান্টি প্রদান দেব।

সনদে থাকা আইনি, ঐতিহাসিক ও সাংবিধানিক সুরক্ষা সংরক্ষণ ও শ্রদ্ধা জানাবে রাজনৈতিক দলগুলো এবং ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আলোকে একটি ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক পদক্ষেপ হিসেবে এই সনদকে স্বীকৃতি দেবে।

ঘোষণার শেষাংশে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণ করে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক সংস্কারে উত্তরণ

'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫' এসেছে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া নজিরবিহীন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়। 

ওই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল ন্যায়বিচার, সুশাসন এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এতে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত এবং আরও অনেক আহত হন। এ ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি মোড় পরিবর্তনের ঘটনা।

এ প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেন এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। মোট ৩৫টির বেশি রাজনৈতিক দল ও জোট এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে এবং ২০টি মূল বিষয়ে আলোচনা করার জন্য মোট ৪৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

এই প্রক্রিয়ায় ৬টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনগুলো তাদের সুপারিশ এ বছরের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সরকারের কাছে জমা দেয়। 

পরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সেই সুপারিশগুলোকে একত্র করে দুটি ধাপে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে ঐকমত্য তৈরির কাজ করে।

'জুলাই সনদের' সাফল্য নির্ভর করবে কঠোর বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, ভবিষ্যৎ আইন প্রণয়ন এবং ফলোআপ রিপোর্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 

Comments