জন্মের পর চোখের রঙ পরিবর্তনের কারণ

বয়সের বিভিন্ন ধাপে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং মস্তিষ্কের বিকাশের কথা তো সবারই জানা, কিন্তু জন্মের সময় চোখের রঙ নীল নিয়ে জন্ম নিলেও পরবর্তী কয়েক বছরে বাদামী বা সবুজ রঙ ধারণ করার বিষয়টি বেশ নতুন।
ছবি: রয়টার্স

বয়সের বিভিন্ন ধাপে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং মস্তিষ্কের বিকাশের কথা তো সবারই জানা, কিন্তু জন্মের সময় চোখের রঙ নীল নিয়ে জন্ম নিলেও পরবর্তী কয়েক বছরে বাদামী বা সবুজ রঙ ধারণ করার বিষয়টি বেশ নতুন।

ব্যক্তির নাকের আকৃতি বা কানের লতির ন্যায় চোখের রঙের বিষয়টি অন্যান্য শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মতো মনে হতে পারে। এমনকি অন্যদের কাছে ব্যক্তি কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবেন সে বিষয়টিও চোখের রঙের উপর নির্ভর করে থাকে।

অবাক করার বিষয় হলো, আমাদের চোখের রঙ সবসময় একরকম থাকে না। আঘাত, সংক্রমণ এমনকি সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি ইত্যাদি বাহ্যিক প্রভাবের কারণে এটির পরিবর্তন হতে পারে। কখনো কখনো কোনো কারণ ছাড়াও এমনটি ঘটতে পারে।

শিশুর চোখের রঙ পরিবর্তন হবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে রঙের উপর। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ার্স আই ইনস্টিটিউটের চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ক্যাসি লুডউইগ একটি গবেষণার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার লুসিল প্যাকার্ড চিলড্রেন হাসপাতালে জন্মগ্রহণকারী ১৪৮টি শিশুর তথ্য সংগ্রহ করেন। যাদের জন্মের সময় চোখের আইরিসের রঙ রেকর্ড করেন। আর দুই-তৃতীয়াংশ শিশুর বাদামী রঙের চোখ এবং এক-পঞ্চমাংশ শিশুর চোখের রঙ ছিল নীল।

দুই বছর পরে, লুডউইগ এবং তার সহকর্মীরা দেখতে পান ৪০ জন নীল চোখের শিশুর মধ্যে ১১ জনের দুই বছর বয়সে চোখ বাদামী রঙ ধারণ করে, ৩ জনের হ্যাজল এবং ২ জনের চোখের রঙ সবুজ হয়ে যায়। এ ছাড়া ৭৭ জন বাদামী চোখের নবজাতকের মধ্যে, প্রায় ৭৩ জনের দুই বছর বয়সেও বাদামী চোখ ছিল। এ ক্ষেত্রে বোঝা যায়, আমাদের জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে বাদামী চোখের চেয়ে নীল চোখের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু কেন?

আরেকটি বিষয় খেয়াল করলে দেখা যায়, বাচ্চাদের চোখের রঙ আগের চেয়ে হালকা নয় বরং গাঢ় হতে থাকে। লুডউইগের গবেষণায়, প্রথম দুই বছরে এক-তৃতীয়াংশ শিশুর চোখের রঙ পরিবর্তিত হয়। যার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ পরিবর্তন হলো চোখ কালো হয়ে যাওয়া। গবেষণায় ১৪৮ জন শিশুর মধ্যে মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশের চোখ বয়সের সঙ্গে হালকা হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে গাঢ় হওয়ার প্রবণতা আইরিসের প্রতিরক্ষামূলক পিগমেন্টের জন্যও হতে পারে।

সাধারণত স্বাস্থ্যকর রঙ পরিবর্তন বেশিরভাগই শৈশবকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্য একটি গবেষণায়, শৈশব থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি যমজ শিশুর তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাধারণত জন্মের ৬ বছর বয়সের মধ্যে চোখের রঙ পরিবর্তন বন্ধ হয়ে যায়। যদিও গবেষণার ১০ থেকে ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, চোখের রঙ বয়ঃসন্ধিকালেও পরিবর্তন হতে থাকে এবং যৌবনে ভিন্ন যমজদের মধ্যে, চোখের রঙ অভিন্ন যমজদের তুলনায় পরবর্তী জীবনে ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল।

ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লায়ন্স আই ইনস্টিটিউটের চক্ষুবিদ্যার অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকি চোখের রঙ পরিবর্তন করার প্রবণতার একটি জেনেটিক উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। চোখের রঙ পরিবর্তনের ঘটনা সম্পর্কে কৌতূহলী হওয়ার পরে, ম্যাকি দেখতে পান যে, এই দুটি গবেষণা কমবেশি সমস্ত গবেষণা যা শৈশবের চোখের রঙ পরিবর্তনের উপর করা হয়েছিল। তিনি দেখতে পান, পিতামাতার জন্য তাদের বাচ্চাদের চোখের রঙ পরিবর্তন হবে এমন আশা করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

এসব গবেষণা কেবল একটি দেশের সীমিত তথ্যের ভিত্তিতে করা হলেও চোখের রঙের পরিবর্তনের বিষয়টি উত্তর ইউরোপীয়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপবাসী বা মিশ্র-জাতির ঐতিহ্যের লোকদের মধ্যেও মিল পাওয়া যায়।

এমন পরিবর্তন এসব মানুষের শৈশবকালের চুলের রঙেও দেখা যায়। ম্যাকি বলেন, কিছু বাচ্চাদের ছোটবেলার ছবিতে সোনালি রঙের চুল দেখা গেলেও, বড় হওয়ার পর দেখা যায় গাঢ় বাদামী চুল। এজন্য চুলের পিগমেন্টকে দায়ী করা যেতে পারে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং অন্য স্থানে ছড়িয়ে পরে।

এটি চোখের রঙের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ভূমিকা পালন করে। জন্মের কয়েক মাস বা বছর পর বেশি পরিমাণে পিগমেন্ট তৈরি হয়। যার প্রধান অংশজুড়ে থাকে মেলানিন এবং এটির বিস্তারের জন্যই চোখ বিভিন্ন রঙ ধারণ করে। সহজভাবে বলতে গেলে নীল রঙ থেকে ধীরে ধীরে অন্য রঙে রূপান্তরিত হয়। অনেকে ধূসর রঙের কথা বললেও এটি আসলে নীলের আরেককটি ভ্যারিয়েন্ট। তারপর হ্যাজেল এবং সবুজ রঙের সংমিশ্রণের পর বাদামী রঙ আসে। সেটি হতে পারে হালকা বাদামী কিংবা গাঢ়।

উচ্চ মাত্রার মেলানিন রঙ পরিবর্তন করার পাশাপাশি তীব্র সূর্যালোকে উপকারী। ত্বকের মতো এই পিগমেন্ট সূর্যের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। তবে চোখের রঙের অনেক পরিবর্তন কোনো ক্ষতিকারক কারণে না হলেও আঘাত, সংক্রমণ বা সূর্যের ক্ষতির কারণে হতে পারে। 

আঘাতের কারণে যদি চোখের ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে যায় তাহলে চোখের কিছু অংশে দাগ দেখা দিতে পারে অথবা অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং স্থায়ী হয়। এ ছাড়া সংক্রমণের কারণে চোখের রঙ পরিবর্তনের জন্য দায়ী অন্যতম রোগ হলো হেটেরোক্রোমিয়া। যার জন্য দুটি চোখের রঙ ভিন্ন হয়ে যায়।

কিছু সংক্রামক রোগের কারণে পিগমেন্ট অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। যার একটি হল ফুচের হেটেরোক্রোমিক সাইক্লাইটিস নামক একটি ভাইরাল সংক্রমণের কারণে হয়। যা রুবেলা এবং জার্মান হাম নামেও পরিচিত। ভাইরাস মূলত চোখের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে এবং এটি পরবর্তী জীবনে পিগমেন্টেশন কমিয়ে দেয়।

অন্যান্য ভাইরাসও চোখের অভ্যন্তরে থাকতে পারে এবং পিগমেন্টেশনকে প্রভাবিত করতে পারে। একজন ইবোলা জীবিত ব্যক্তির চোখের রঙ নীল থেকে সবুজে পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল যখন ভাইরাসটি তার শরীরের অন্য জায়গা থেকে পরিষ্কার করার পরেও তার চোখের তরলে অবস্থান করে।

তবে সবসময় চোখের রঙের পরিবর্তন পুরো আইরিসকে প্রভাবিত না করলেও ছোট ছোট ফ্লেকগুলোকে প্রভাবিত করে। ব্রাশফিল্ড স্পট নামে পরিচিত ফ্যাকাশে ফ্লেক্সগুলো ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আইরিসে উপস্থিত থাকতে পারে। অন্যদিকে লিস নোডুলস নামক বাদামী ফ্লেকগুলো জেনেটিক অবস্থা নিউরোফাইব্রোমাটোসিস টাইপ ওয়ানের একটি সাধারণ লক্ষণ।

তবে ত্বকের মতো আইরিস এবং চোখের অন্য কোথাও ফ্রেকলস এবং মোলস প্রদর্শিত হতে পারে।

একজনের ক্ষেত্রে ফ্রেকল কোনো ক্ষতি না করলেও অন্যদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তাই অনেকে চোখের রঙ পরিবর্তনে খুশি হলেও সতর্ক থাকা আবশ্যক।

তথ্যসূত্র:

বিবিসি

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago