ফিরে দেখা ২০১৯: এমন আন্দোলন দেখেনি দেশের ক্রিকেট
২১ অক্টোবর দুপুর বেলা হুট করেই মিরপুর শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কিছু ক্রিকেটারকে জড়ো হতে দেখা যায়। কিন্তু অনুশীলনের পোশাকে নয়, সাধারণ পোশাকে নিজেদের মধ্যে গুরুতর বিষয়ে আলাপ চালাচ্ছিলেন তারা। খানিক পর সাংবাদিকদের আচমকা সংবাদ সম্মেলনে ডেকে নেন জাতীয় ক্রিকেটাররা। দাবি-দাওয়ার দাবিতে তারা আন্দোলনে যেতে পারেন, এমন একটা আভাস মিলছিল। সেই আন্দোলন যে শুরুতেই একদম কঠোর হয়ে যাবে তা অবশ্য আঁচ করা যায়নি।
সাকিব আল হাসান থেকে ফরহাদ রেজা, নাঈম ইসলাম থেকে তামিম ইকবাল- জাতীয় দল, ঘরোয়া ক্রিকেটের সমস্ত ক্রিকেটার, সবাই এক জোট। সমবেত কণ্ঠে তারা জানালেন এগারোটি দাবি। যা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সমস্ত রকমের ক্রিকেটীয় কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিয়ে দেন তারা। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর দেশের ক্রিকেটে এত বড় খেলোয়াড় ধর্মঘটের নজির নেই।
ভারত সফরের ঠিক আগেই ক্রিকেটারদের এমন ধর্মঘটে হুট করেই গরম হয়ে গেল হাওয়া। ঘরোয়া পর্যায়ে বেতন বৈষম্যের সঙ্গে বিসিবির নানা অনিয়ম নিয়ে শুরু হয় তুমুল হইচই। বিসিবি এমন বড় কিছুর জন্য প্রস্তুতই ছিল না।
তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি বোর্ড। গুমোট অবস্থার মাঝে পরদিন জরুরি সভা করে গণমাধ্যমের সামনে আসেন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান। তার সংবাদ সম্মেলনে ছড়ায় উত্তেজনা। ক্রিকেটারদের এমন ধর্মঘটে যাওয়ার পেছনে ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়েছিলেন বোর্ড সভাপতি। তার সেই সংবাদ সম্মেলনে বেরিয়ে আসে অনেক অপ্রিয় কথা। অনেক ক্রিকেটারের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও কথা বলতে ছাড়েননি তিনি।
সমাধান আসেনি ওই দিনও। পরদিন সকাল থেকেই দেখা দেয় ইতিবাচক হাওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে ক্রিকেটারদের সব দাবি মেনে নেওয়ার আভাস দেন বোর্ড প্রধান। কিন্তু ক্রিকেটাররা আবার মোড় ঘুরিয়ে শুরু করেন নতুন নাটক। সন্ধ্যার পরে গুলশানের একটি হোটেলে তারা ডাকেন পাল্টা প্রেস ব্রিফিং।
এক আইনজীবীকে দিয়ে পুরনো দাবিগুলোই নতুন করে তুলে ধরে আরও দুই নতুন দাবি যোগ করেন তারা। চেয়ে বসেন বিসিবির রাজস্বের ভাগও। তবে তাদের এই হম্বিতম্বি টিকেছে খানিকক্ষণ। ওই ব্রিফিং সেরেই বিসিবিতে এসে প্রভাবশালী পরিচালক আর বোর্ড সভাপতির সঙ্গে সভায় বসেন ক্রিকেটাররা। সেখানেই হয়ে যায় অচলাবস্থার অবসান। পরে যৌথ ব্রিফিংয়ে আসে ধর্মঘট প্রত্যাহার ও দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা। বলা বাহুল্য, ক্রিকেটারদের চাওয়া মতো সমস্ত দাবি খাপে খাপে পূরণ হয়নি এখনও।
যেসব দাবি ছিল- যেমনভাবে মানা হলো:
১. ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (কোয়াবের) বর্তমান কমিটিকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। ক্রিকেটারদের সরাসরি ভোটে ঠিক করা হবে নতুন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। (তাৎক্ষণিকভাবে মানা হয়নি, প্রক্রিয়াধীন)
২. ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের দলবদলের নিয়ম আগের মতো করতে হবে। যে যার পছন্দমতো দলে যাবে। (এই দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে)
৩. এ বছর না হোক, তবে পরের বছর থেকে আগের মতো (ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতিতে) বিপিএল আয়োজন করতে হবে। স্থানীয় ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক বাড়াতে হবে। (এই দাবির প্রথম অংশের ব্যাপারে একমত বিসিবি)
৪. প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ম্যাচ ফি ১ লাখ করতে হবে। চুক্তিভুক্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের বেতন ৫০% বাড়াতে হবে। ১২ মাস কোচ-ফিজিও দিতে হবে, প্রতি বিভাগে অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে হবে। (আংশিক পূরণ করা হয়েছে)
৫. আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে বল দিয়ে খেলা হয়, ঘরোয়া লিগে সেই মানের বল ব্যবহার করতে হবে। দৈনিক ভাতা ১৫০০ টাকায় কিছু হয় না, তা বাড়াতে হবে। এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে যাওয়ার জন্য যাতায়াত ভাড়া মাত্র ২৫০০ টাকা। তা বাড়াতে হবে অথবা প্লেন ভাড়া দিতে হবে। হোটেল ভালো হতে হবে, জিম ও সুইমিংপুল সুবিধা থাকতে হবে। (আংশিক পূরণ করা হয়েছে)
৬. জাতীয় দলে চুক্তিভুক্ত ক্রিকেটারের সংখ্যা অন্তত ৩০ করতে হবে ও বেতন বাড়াতে হবে। (এই দাবি পূরণ করা হয়নি)
৭. দেশি সব স্টাফদের বেতন বাড়াতে হবে। কোচ থেকে শুরু করে গ্রাউন্ড স্টাফ, আম্পায়ার- সবার বেতন বাড়াতে হবে। (এই দাবি পূরণ করা হয়নি)
৮. জাতীয় লিগের পর আগে একটি ওয়ানডে লিগ হতো। সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে। বিপিএলের আগে আরেকটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট দিতে হবে। (বিবেচনাধীন, প্রক্রিয়াধীন)
৯. ঘরোয়া ক্যালেন্ডার চূড়ান্ত হতে হবে। (এই নিয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আসেনি)
১০. ডিপিএলে (ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ) ক্রিকেটারদের পাওনা টাকা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দিতে হবে। (প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে)
১১. বিদেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ দুটির বেশি খেলা যাবে না- এমন নিয়ম তুলে দিতে হবে। সুযোগ থাকলে সবাই সব লিগে খেলবে। (বিবেচনাধীন)
Comments