হালদার বিপন্ন ডলফিন, দেখার কেউ নেই!

হালদা নদী রক্ষায় ঘোষণা আছে অসংখ্য। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে কয়েকটি। যেমন: ২০১০ সালে মৎস্য শিকার বন্ধ করার ঘোষণা, নদী থেকে বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ করার ঘোষণা, ২০১৮ সালে যান্ত্রিক নৌযান চলাচল বন্ধের ঘোষণা আর ২০১৯ সালে হালদাকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি।
dolphin
প্রতীকী ছবি। (সংগৃহীত)

হালদা নদী রক্ষায় ঘোষণা আছে অসংখ্য। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে কয়েকটি। যেমন: ২০১০ সালে মৎস্য শিকার বন্ধ করার ঘোষণা, নদী থেকে বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ করার ঘোষণা, ২০১৮ সালে যান্ত্রিক নৌযান চলাচল বন্ধের ঘোষণা আর ২০১৯ সালে হালদাকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি।

এতসব ঘোষণার মধ্যে হালদা নদীর তো ভালো থাকার কথা। ভালো থাকার কথা নদীর সুস্থতার পরিচায়ক স্তন্যপায়ী ডলফিনের। বাস্তবতা হলো— শুধু ঘোষণাতেই দায় সেরেছে মৎস্য অধিদপ্তর। তাদের  উদাসীনতা ও অবহেলায় প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার রুই জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বলে পরিচিত নদীর ডলফিনগুলো।

ঘোষণা আর বাস্তবায়নের মধ্যে কতটুকু ফারাক সেটা একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। হালদা নদীর ৬০ কিলোমিটার জুড়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। আর ৬০ কিলোমিটার জুড়ে সেটা তদারকি করার জন্য আছেন দুই জন নিরস্ত্র আনসার সদস্য। অতিমানবীয় ক্ষমতা ছাড়া এ দুজনের পক্ষে রাতবিরাতে এ পাহারা দেওয়া অসম্ভব।

লকডাউন আর শাটডাউন পৃথিবীর নানা অংশের বন্যপ্রাণী ও নদী-সমুদ্রের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসলেও মানুষের নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না গাঙ্গেয় এ ডলফিন। অবৈধ জালের শিকার হচ্ছে মা মাছও। শনিবারও হালদা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ইঞ্জিন বোটের আঘাতে রক্তাক্ত ১৩ কেজি ওজনের একটি মা মাছ।

গাঙ্গেয় এ ডলফিন (গাঙ্গেটিকা প্লাটানিস্টা) দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলোতে একটি বিপন্ন প্রজাতি। প্রকৃতি সংরক্ষণের জোট ‘আইইউসিএন’ এ প্রজাতিকে মহাবিপন্ন হিসেবে লাল ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত করেছে ২০১২ সালে।

ডলফিনের মৃত্যুর তালিকায় যুক্ত হয়েছে নতুন ধরনের নৃশংসতাও। গত শুক্রবার সকালে রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নে হালদা সংলগ্ন এলাকায় একটি ডলফিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ডলফিনের চর্বি থেকে তৈরি তেল নারীদের রোগমুক্তি ঘটে— এমন কুসংস্কারের বশে এ ডলফিনকে হত্যা করা হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিমত।

হালদা নদীতে ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরিচালিত ইউএনডিপির সহযোগিতায় গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি ও বনবিভাগের পরিচালিত এক জরিপে হালদায় মাত্র ৪৫টি ডলফিনের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। হালদা নদীর মোহনা থেকে সাত্তার ঘাট পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলাকাকে ডলফিনের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল তখন। জরিপে বলা হয়েছে, জরুরি উদ্যোগ নিলে এ বিদ্যমান সংখ্যা থেকে ডলফিনকে দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ করা যাবে। সংরক্ষণ তো দূরের কথা, সেই ৪৫টি থেকে মৃত্যু হয়েছে ২৪টি ডলফিনের।

লকডাউনের মধ্যে হালদা হারালো দুটি ডলফিন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত মারা গেছে ২৪টি ডলফিন। যে গতিতে হালদায় ডলফিন মারা যাচ্ছে, সেটা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালের মধ্যে হালদা ডলফিনমুক্ত হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

জরিপে ডলফিনের মৃত্যুর পেছনে তিনটি কারণ চিহ্নিত করা হয়। মাছ ধরার জাল, শিল্পকারখানার দূষণ ও যান্ত্রিক নৌযান। এসব বন্ধে বনবিভাগ ও মৎস্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ে যৌথ টহলের ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছিল জরিপে। সেটা এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি।

মার্চে হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। পূর্ববর্তী ঘোষণার মতো সেটাও যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়, সে বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তর সজাগ থাকবে কি না, নিশ্চিত করে বলা যায় না।

পরিবেশ অধিদপ্তর বায়েজিদ অঞ্চলের শিল্পকারখানাগুলোতে ইটিপি (এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) স্থাপনে বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে হালদার দূষণ বন্ধ হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পরিবেশ অধিদপ্তরকে বায়েজিদের দূষণকারী শিল্পগুলো বন্ধের নির্দেশ দিলেও সে আদেশ অদৃশ্য কারণে বাস্তবায়ন করেনি পরিবেশ অধিদপ্তর।

ইউএনডিপির ওই জরিপে হালদার ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, নদীর তীরবর্তী মানুষের মধ্যে হালদা নিয়ে সচেতনতা ও হালদার মুখ থেকে সাত্তার ঘাট পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলাকাকে বন্যপ্রাণী আইনের অধীনে অভয়রাণ্য ঘোষণা করার সুপারিশ করা হয়েছিল। তার কিছুই এ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি।

হালদা রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা

খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার হালদা ছড়া থেকে উৎপত্তি হয়ে ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদী ফটিকছড়ি, রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার মধ্য দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়েছে। তার মধ্যে একমাত্র হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন হালদা রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে তার প্রশাসনিক সীমার মধ্যে। গত দেড় বছরে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন হালদা নদীতে পরিচালনা করেছেন ১০১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত। উদ্ধার করেছেন দুই লাখ ১৩ হাজার মিটার অবৈধ জাল, এক লাখ ১৫ হাজার ঘনফুট বালি, বালি উত্তোলনে ব্যবহৃত পাইপ ধ্বংস করেছেন, যার দৈর্ঘ্য সাড়ে তিন কিলোমিটার, ড্রেজার ধ্বংস করেছেন নয়টি, বালি উত্তোলনে ব্যবহৃত ইঞ্জিন নৌকা ধ্বংস করেছেন ১২টি।

এ ছাড়াও, পরিবেশ অধিদপ্তরকে সঙ্গে নিয়ে বন্ধ করেছেন হালদা দূষণের জন্য দায়ী হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট ও এশিয়ান পেপার মিল। হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও বাকি দুই উপজেলা প্রশাসনের তেমন তৎপরতা নেই। ফলে ফটিকছড়ি ও রাউজানে হালদার মা মাছ ও ডলফিনের ক্ষতি হলেও সেটা দেখার কেউ নেই।

হালদা রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্রিয় হওয়া অতি জরুরি। দূষণকারী যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। যান্ত্রিক নৌ চলাচল বন্ধ করতে হবে। অবৈধ জাল ফেলা বড় হুমকি মা মাছ ও ডলফিনের জন্য। সেটা যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। মৎস্য অধিদপ্তরকে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে হালদা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃতির দেওয়া বিরল এ প্রাকৃতিক ক্ষেত্রকে আমরা এভাবে ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে পারি না।

লেখক: মোস্তফা ইউসুফ, নিজস্ব সংবাদদাতা (চট্টগ্রাম ব্যুরো), দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

4h ago