যমুনার গর্ভে ‘সব হারানো’ আশরাফ আলীর গল্প

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার ভেতরে যমুনার বুকে ২০০৮ সালে একটি চর জেগে উঠে। সে সময় সেখানে একটি নতুন গ্রামের গোড়াপত্তন হয়। গ্রামের নাম দেওয়া হয় ‘চর হাটবাড়িয়া’। ধীরে ধীরে সেখানে গড়ে ওঠে প্রায় ৩৫০টি পরিবারের একটি জনবসতি।
আশরাফ আলী। ছবি: মোস্তফা সবুজ

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার ভেতরে যমুনার বুকে ২০০৮ সালে একটি চর জেগে উঠে। সে সময় সেখানে একটি নতুন গ্রামের গোড়াপত্তন হয়। গ্রামের নাম দেওয়া হয় ‘চর হাটবাড়িয়া’। ধীরে ধীরে সেখানে গড়ে ওঠে প্রায় ৩৫০টি পরিবারের একটি জনবসতি।

চর হাটবাড়িয়া থেকে নদী আরেকটু দূরে সরে গেলে, গ্রামটির উত্তরে আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে আরও ৪৫-৫০টি পরিবারের আরেকটি ছোট জনবসতি গড়ে উঠে। তার নাম দেওয়া হয় ‘উত্তর চর হাটবাড়িয়া’। সেই গ্রামের একজন সচ্ছল কৃষক ছিলেন আশরাফ আলী (৫০)। পাঁচ ছেলে-মেয়ে, ছেলের স্ত্রী-সন্তান এবং নিজের স্ত্রীকে নিয়ে আশরাফ আলীর ১৩ সদস্যের একটি যৌথ পরিবার।

পূর্ব-পুরুষদের রেখে যাওয়া ১০-১২ বিঘা আবাদী জমিতে ফসল ফলিয়ে এবং নদী থেকে মাছ ধরে বেশ সুখেই সংসার চলছিল আশরাফ আলীর।

এ বছর জুন মাসে প্রথম দফা বন্যায় গ্রামে পানি উঠতে থাকে। ২৯ জুন গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায় বাড়িঘরের ভেতরে বন্যার পানি উঠে গেছে। ঘরে থাকার উপায় নেই বলে গ্রামের লোকজন তাদের সব কিছু নিয়ে উঠে পড়েছেন ছোট ছোট নৌকায়।

এর মধ্যে গ্রামের একটি শিমুল গাছের নিচে মাটির একটি উচু ঢিবিতে তখনও পানি উঠেনি। সেখানে দেখা গেল এক ভিন্ন চিত্র। সেই ছোট ঢিবিতে কয়েকজন নারী-পুরুষ মিলে একটি অনুষ্ঠানের রান্না করছিলেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, সেদিন আশরাফ আলীর ছোট মেয়ে মৌসুমীর বিয়ে। তারই রান্না হচ্ছে সেখানে।

রান্নার স্থানের পাশেই সামিয়ানা টাঙিয়ে তার নিচে রয়েছে বেশ কয়টি ছোট-বড় নৌকা। নৌকাগুলোর ওপরেই আশরাফের মেয়ের বিয়ের আয়োজন।

কোন একটি ছোট নৌকায় দেখা গেল লাউডস্পিকারে গান বাজানো হচ্ছে। গ্রামের মাঝবয়সী নারীদের কেউ কেউ বিয়ের গীত গাইছেন। আশরাফ আলীকে দেখা গেল ছোট একটি নৌকায় বসে রান্নার কাজ দেখছেন।

নৌকায় বসে মেয়ের বিয়ের রান্না পর্যবেক্ষণ করছেন আশরাফ আলী। ছবি: মোস্তফা সবুজ

আশরাফ আলীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তার মেয়ের বিয়ে পাশের মানিক দাইড় চরের তার এক ভাই শফিকুল ইসলামের ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। বন্যা আসার আগেই এই বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছিল। ছেলে শিক্ষিত বলে মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে বিয়েতে যৌতুক দিচ্ছেন এক লাখ ১০ হাজার টাকা। মেয়ের গয়না-বাবদ খরচ করেছেন আরও ৫০ হাজার টাকা। আর বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজনে খরচ ৫০ হাজার টাকা।

এ বছর ১০ বিঘা জমিতে তিনি মরিচ চাষ করে লাভ করেছেন তিন লাখ টাকা। তাই দিয়েই এই দুর্যোগের মধ্যেও মেয়ের বিয়ের আয়োজন করেছেন আশরাফ।

তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই পটকার শব্দ শোনা গেল। অদূরেই বরযাত্রীর নৌকা নোঙর করেছে। দুই নৌকায় নারী-পুরুষ, যুবক, শিশু মিলে ২২ জন এসেছেন বরযাত্রীতে। ধুমধাম করেই সেদিন ছোট মেয়ের বিয়ে দিলেন আশরাফ।

উজানের পানিতে এরই মধ্যে হয়ে গেল আরও দুই দফা বন্যা। ১০ আগস্ট সারিয়াকান্দির চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী জানান, উত্তর হাটবাড়িয়া চরসহ আরও চার-পাচটি চর বন্যায় নদী ভাঙনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গ্রাম-ফসলের মাঠ সবকিছু চলে গেছে যমুনার বুকে।

আশরাফ আলীসহ আরও ৯৫০টি পরিবার এবার বন্যায় নদী ভাঙনের শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হয়েছেন। আশরাফসহ ওই গ্রামের আরও ৪৫-৫০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন পাশের সোনাতলা উপজেলার তেকানি-চুকাইনগর আশ্রয়ণ প্রকল্পে।

১২ আগস্ট সেই আশ্রয়ণ প্রকল্পে সকাল ১০টায় গিয়ে দেখা গেল, তার ছেলেরা অবশিষ্ট ৫০ হাজার টাকা দিয়ে নতুন টিন কিনে ঘর তুলছে। আশরাফ আলীকে দেখা গেল না। ছেলে শামিম মিয়া জানালেন, তার বাবা ছোট মেয়ে মৌসুমীকে দেখতে গেছেন সেই মানিক দাইড় চরে।

‘কয়দিন ধরে ছোট মেয়েটার জ্বর এসেছে বলে নৌকা ভাড়া করে তাকে দেখতে যেতে হয়েছে’, বলেন আশরাফের স্ত্রী শিরিনা বেগম (৪৫)।

মেয়ের জামাই কেমন আছে জানতে চাইলে আশরাফের আরেক ছেলে সুজন জানাল, তারাও খুব একটা ভালো নেই। মানিক দাইড় চরও নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে।

বন্যার পর চর হাটবাড়িয়া। ছবি: মোস্তফা সবুজ

আশরাফ আলী ফিরে আসলেন সন্ধ্যা ৬টায়। আশরাফের সেই আগের হাসিমাখা মুখখানি আর দেখা গেল না।

আশরাফ আলী জানালেন, বিয়ের কয়েকদিন পরেই তাদের গ্রামের দিকে নদীভাঙন শুরু হয়। বন্যার পানির মধ্যেই নদী ভাঙতে ভাঙতে বাড়ির কাছে চলে আসে। ফসলের সব জমি আগেই নদীর বুকে চলে গেছে। দেবে গেছে অনেক ঘরবাড়ি। অনেক কষ্টে বাড়িঘর টেনে এনেছেন এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে।

আশরাফ আলীর এখন আর নেই কোনো নগদ অর্থ, ফসলের জমি। নেই পর্যাপ্ত খাবার, যা দিয়ে কাটিয়ে উঠবে এই বিপদ। ত্রাণের চাল আর নদীতে বাপ-ছেলেতে মিলে মাছ ধরে কিছু অর্থ উপার্জন করেন। তাই দিয়ে চলে পরিবারের ১১ সদস্যের খাবার। এভাবে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন আশরাফ ও তার পরিবার।

আশরাফ আলীর স্ত্রী শিরিনা বেগম কথার ফাঁকে বলে ফেলেন, ‘এই আমাকে যা দেখছেন, আমি কি এমন ছিলাম? আমার ছেলেগুলোর চেহারা কি এমন ছিল? নদীগর্ভে সব কিছু চলে যাওয়ার পর চিন্তায়-শোকে অর্ধেক হয়ে গেছে আমাদের শরীর।’

কেন বন্যার মধ্যে এত টাকা খরচ করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হলেন, জানতে চাইলে আশরাফ আলী বলেন, ‘আমরা কেউ জানতাম না যে বন্যা এতদিন থাকবে। সব কিছু নদীতে চলে যাবে। তা ছাড়া, মেয়ের বিয়ে তো দিতেই হবে।’

একই গ্রামের শাহজান আলী (৩৫) জানালেন, গতবার এর থেকে বড় বন্যা হয়েছিল। কিন্ত, পানি এতদিন থাকেনি। তাই, বেঁচে গিয়েছিল ফসলের মাঠ, ঘরবাড়ি। নদী ভাঙনও ছিল না গত বছর। এ বছর সব হারিয়ে তারা নিঃস্ব।

আশরাফ জানান, নদীতে এখন কিছু মাছ পাওয়া যায়। তাই দিয়ে চলছে এত বড় পরিবার। কিন্তু, সামনে শীতেই শুকিয়ে যাবে নদীর পানি। মাছও আর তেমন মিলবে না তখন। সে সময় কীভাবে জীবিকা নির্বাহ হবে, তা জানেন না আশরাফ আলী।

হয়তো আবার ঘুরে দাঁড়াবে এক সময়ের সুখী-স্বচ্ছল আশরাফ আলীর পরিবার। হয়তো আবারও কোনো নতুন চরে বসতি গড়বেন তারা। আবার নতুন করে ফসল ফলাবেন।

দক্ষিণ-এশিয়ার দেশগুলোতে আবহমান কাল ধরে এভাবেই চলছে চরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা। স্থলভাগের উন্নয়নের ঝলক খুব কমই এসে লাগে চরের মানুষের জীবনে।

Comments

The Daily Star  | English

Six state banks asked to cancel contractual appointments of MDs

The Financial Institutions Division (FID) of the finance ministry has recommended that the boards of directors of six state-run banks cancel the contractual appointment of their managing directors and CEOs..The six state-run banks are Sonali Bank, Janata Bank, Agrani Bank, Rupali Bank, BAS

32m ago