লাল পাহাড়ের রূপকথা ও চুপকথাদের গল্প

ভোর ভোর সকালের সূর্যের আলো পায়ের কাছের মেঘে আটকে আছে- ফেসবুকে শ’খানেক লাইক পড়া বাঙালি এক পর্যটকের সাজেক ভ্যালিতে তোলা এমনই এক ছবির ক্যাপশন ছিল ‘এই সবুজ, এই মেঘ, এই আলো- শুধু আমার, আমার বাংলার’।
Bandarban.jpg
ভিটে-মাটি ও জুম ভূমি হারানোর আতঙ্কে থাকা একটি পাহাড়ি পরিবার। ছবি: সঞ্জয় কুমার বড়ুয়া/স্টার

ভোর ভোর সকালের সূর্যের আলো পায়ের কাছের মেঘে আটকে আছে- ফেসবুকে শ’খানেক লাইক পড়া বাঙালি এক পর্যটকের সাজেক ভ্যালিতে তোলা এমনই এক ছবির ক্যাপশন ছিল ‘এই সবুজ, এই মেঘ, এই আলো- শুধু আমার, আমার বাংলার’।

এই ছবি আর ক্যাপশনকে শুধু বাঙালির ফ্যান্টাসি আর রোমান্টিসিজম হিসেবে দেখলে, না দেখা অনেক কিছুই রয়ে যাবে। বরং একে ভূমিকেন্দ্রিক অধিকার বোধ ও চর্চার যে প্রাত্যহিক দরকষাকষি চলে রাষ্ট্র ও তার নানা স্তরের নাগরিকদের মাঝে, তার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বোঝা জরুরি। কে এই ‘আমরা’? ‘আমরা’র ‘বাংলা’টাও বা কোন মুলুক? সেই মুলুকের দাবিদার কে? কেই বা পরের বাপ-দাদার ভিটেতে দাঁড়িয়ে বুক চেতিয়ে সেই ভিটের গাছে আটকে থাকা মেঘকে নিজের নামে লেখায়? কার ক্যানন শিশির ভেজা ভোর, চনমনে দুপুর, গোধূলির আগুন রংকে সাবধানে ফ্রেমে আটকায় উদ্বাস্তু পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীদের হাড়-জিরজিরে মাচাং ঘর আর শরীরকে আড়াল করে? এই প্রশ্নগুলো এক-দুই ঘর অসহায় পাহাড়ির জন্য করা কোনো ন্যাকা-বোকা আবোল-তাবোল ‘আহা-রে’ নয়। বরং এই প্রশ্ন পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভিটে-মাটিতে পর্যটন ব্যবসার রাজনীতিকে বুঝতে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে পাহাড়ি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অসম সম্পর্ককেও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে জরুরি।  

যখন এই লেখা লিখছি, তখন বান্দরবানে চিম্বুক পাহাড় সংলগ্ন এলাকার কাপ্রু পাড়া বাজার থেকে শুরু করে জীবন নগর পর্যন্ত প্রায় এক হাজার একর জুম চাষের জমি একটি ওয়েলফেয়ার সংগঠন ও সিকদার গ্রুপ দখল করে নিচ্ছে পাঁচতারা ম্যারিয়ট হোটেল ও এমিউজমেন্ট পার্ক তৈরির জন্য। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ছয়টি ম্রো গ্রাম প্রত্যক্ষভাবে এবং ৭০ থেকে ১১৬টি গ্রাম পরোক্ষভাবে সর্বহারা হবে। কোন দাপটে দেশের একটি নির্দিষ্ট জাতি ও শ্রেণীর মানুষদের ‘এমিউজ’ করার তাগিদে পাহাড়িদের হাজার একর জমি তাদের প্রতিবাদের মুখেও লোপাট হতে থাকে? এই প্রশ্ন যেমন নতুন নয়, তেমনি পাহাড়ে রাষ্ট্রের ভূমি অধিগ্রহণের ঘটনাও নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে চার লাখ বাঙালিকে পাহাড়িদের জমিতে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের পাকা ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। সেটি ছিল শুরু।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের গবেষণা অনুসারে ‘২৭ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষের অনুপাত ছিল ৭৫ শতাংশ। আর এখন তা ৪৭ শতাংশ’।

সংখ্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীরা তাদের ভূমিও হারিয়েছেন। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, গত ৩০ বছরে এই পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণাধীন ভূমির পরিমাণ কমেছে শতকরা ৫১ ভাগ। এ ছাড়া, আর্মি/বিজিবি ক্যাম্প, সরকারি বনায়ন, বাঙালি ক্ষমতাশীল ব্যবসায়ীদের রাবার চাষের মতো লাভজনক চাষাবাদি বন্দোবস্তসহ আরও নানাবিধ কারণে বহুকাল থেকেই পাহাড়ে ভূমি দখল চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটনের ‘এক্সোটিক’ ব্যবসা পাহাড়িদের ভূমি দখল ও তাদের ওপর সন্ত্রাস ও শোষণ কায়েমের ক্ষেত্রে একটি বড় অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে।

বিশ্বের কোথাও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর অপরিকল্পিত ও পরিবেশবিরোধী পর্যটন শিল্পের খবরদারী কখনই সুফল বয়ে আনেনি। সমুদ্র সৈকতে হোটেল গড়ে তোলার কারণে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে জেলে সম্প্রদায় উদ্বাস্তু হয়েছেন। আমেরিকাতে বহু নেটিভ আমেরিকান নিজ ভূমি হারিয়ে ‘সাদা’ পর্যটন শিল্পের সস্তা শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন। আমাজনে বহু জনগোষ্ঠী তাদের ধর্মীয় আচার-রীতি বর্জনে বাধ্য হয়েছেন, আবার বহিরাগতদের কারণে অনেকেই নানা রোগ-জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। পাহাড়ের হাজার হাজার জনগোষ্ঠী বাস্তুহারা, নিঃস্ব ও দেশ ছাড়া হয়েছেন এই পর্যটন-সন্ত্রাসের কারণে। খোলা/পতিত জমি ও পাহাড়ের সঙ্গে অবাঙালি জনগোষ্ঠীদের স্বতন্ত্র সম্পর্কের জায়গাটি বরাবরই বাংলাদেশের সব সরকার অস্বীকার করে এসেছে। পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীরা জুমের ভূমি ও পাহাড়কে ‘আমার’ বা ‘নিজের’ বলে দাবি করে, তাকে পণ্য বা ব্যক্তিমালিকানার বিষয় হিসেবে দেখে না। একই পাহাড় তার আশপাশের বিভিন্ন পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, দর্শন, আচার-রীতির প্রাত্যহিক চাহিদা মেটানোর ও টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে শত শত বছর ধরে জেগে থাকে। অন্যদিকে, রাষ্ট্র জমি ও পাহাড়কে সব সময়ই গণ্য করে পণ্য হিসেবে, বিক্রি করে বা লিজ দেয় ইঞ্চি মেপে, মুনাফা করে টাকার অংক গুণে। এর ফলে, জুমের জমি ও পাহাড়ের ওপর নির্ভরশীল এককালের স্বয়ংসম্পূর্ণ জনগোষ্ঠী বহিঃঅর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। পর্যটন শিল্প পাহাড়ি এই জনগোষ্ঠীর জ্ঞান, দর্শন, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট, প্রযুক্তি, ধর্মীয় রীতি-নীতি, পবিত্র স্থান, সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামো ও সম্পর্ক, জীব-বৈচিত্র্য, পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং মৌলিক অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এক কথায় ভূমির মতো পাহাড়িরাও এখন ভোগ্য পণ্যে পরিণত হয়েছে, যাদের খুব সস্তায় ভোগ করে ফুরিয়ে ফেলা যায়। কেন তবুও একের পর এক পাঁচ-চার-তিন তারার হোটেল দখল করতে থাকে তাদের ঘর, জীবন ও জীবিকা? কেন বাঙালির মেঘ-জল দেখার শখ-আহ্লাদের মূল্য হয়ে ওঠে পাহাড়ের ভাঁজে বাস করা মানুষগুলোর জীবনের চাইতেও বেশি দামি?

উত্তর অজানা নয়, কিন্তু উপেক্ষিত। ভূমি কখনোই শুধু এক টুকরো বসত বা আবাদি জমি নয়। ভূমি সব সময়েই সামাজিক অসমতা, বৈষম্য, সংগ্রামকে আদল দেবার হাতিয়ারও বটে। আধিপত্য কায়েম করার একটি মোক্ষম অস্ত্র যে দুর্বলের জমি, প্রতিষ্ঠান, সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তা আমরা বার বার পাহাড়ে ভূমি দখলের রাজনীতি থেকে দেখে আসছি। কে, কোন স্থান, কার নামে লেখাল তার মধ্য দিয়েই তৈরি হতে থাকে ‘নিজ’ আর ‘অন্য’ এর পরিচিতি নির্মাণ, চলতে থাকে ক্ষমতা দেখানো ও প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া। তবে সব জমি কিন্তু বেদখল হয় না, সব মানুষ উদ্বাস্তু হবার আতঙ্কে দিন কাটায় না। সব দখলের মতো ভূমি দখলেরও সূত্র আছে, আছে নিয়ম মেনে অনিয়ম করার চর্চা। সেই নিয়ম গড়ে ওঠে রাষ্ট্র তার নাগরিকের পরিচিতি কীভাবে নির্মাণ করে, তার হাত ধরে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যখন সংবিধান লেখা হয়েছিল, সেখানে শুধু বাঙালিদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৮৮ সালে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০১১ সালে সংবিধানের ১৫তম এমেন্ডমেন্টে বলা হয় যে, বাংলাদেশে বসবাসরত সব মানুষের জাতীয় পরিচয় হলো তারা বাঙালি এবং নাগরিক হিসেবে তারা বাংলাদেশি। বাংলাদেশে মোট ২৭টি অবাঙালি জাতিগোষ্ঠী আছে, তার মধ্যে ১২টি জাতিগোষ্ঠী পাহাড়ি জুম্ম গোষ্ঠী। এদের কেওই বাঙালি নন, মুসলিমও নন। ফলে সংবিধান অনুযায়ী তারা রাষ্ট্রীয় নন, রাষ্ট্রও একভাবে তাদের নয়। এই পরিচয়হীনতার সংকটে দাঁড়িয়ে ভূমিকেন্দ্রিক পরিচিতি ও অধিকার আদায়ের আন্তর্জাতিক সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবার প্রয়াসে বাংলাদেশের পাহাড়ি অবাঙালি জনগোষ্ঠী নিজেদের জুম্ম জাতিগোষ্ঠী পরিচয়ে নতুন মাত্রা সংযোজন করে নিজেদেরকে দেশে ও বিদেশে ‘আদিবাসী’ হিসেবে দাবি করার মধ্য দিয়ে।

যদিও অনেক রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী এই ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, আফ্রিকা বা এশিয়ার উত্তর-উপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ ক্যাটাগরি বলে কিছু থাকতে পারে না, কিন্তু বাস্তবে ‘আদিবাসী’ পরিচিতির রাজনীতির এতো সহজ পাঠ সম্ভব নয়। হানা সামস তার লেখায় দেখিয়েছেন যে, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন ‘আদিবাসীরা’ নিজেদের ‘আদিবাসী’ পরিচয় বেছে নিয়েছে, যেহেতু তারা উত্তর-উপনিবেশিক প্রেক্ষাপটেও উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের শিকার হচ্ছে। তাদের জন্য উত্তর-উপনিবেশিক সময় স্বাধীনতা এনে দেয়নি বরং শাসকের চেহারার রদবদল ঘটেছে মাত্র, যেখানে স্বাধীন দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠী ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের প্রতিস্থাপিত করেছে শুধু। এই বিতর্কিত পরিচিতির রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই ২০১১ সালের মে মাসে জাতিসংঘের পার্মানেন্ট ফোরামে বাংলাদেশের ফার্স্ট সেক্রেটারি ঘোষণা দেন যে, বাংলাদেশে কোনো ‘আদিবাসী’ গোষ্ঠী নেই।

শুধু তাই নয়, এই সব পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভাষাকেন্দ্রিক পরিচিতি ও বাংলা ভাষার গঠন-বলনে তাদের ভাষার আদি অবদানকেও অস্বীকার করা হয়েছে। বাংলা ভাষার যে ‘দেশি’ শব্দ রয়েছে, তার অধিকাংশ শব্দ এসেছে সান্তাল ও মুন্ডাসহ আরও নানা জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা থেকে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে বাংলা ভাষায় উর্দু, ফার্সি, পর্তুগিজ শব্দের মিলমিশের কথা গলা উঁচু করে বলা হলেও, বাংলা ভাষার ওপর দেশের সমতল ও পাহাড়ি অবাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অভিভাবকত্বকে বরাবর আড়াল করা হয়েছে। একটি জাতিগোষ্ঠীর নিজ মাতৃভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার দলিল থেকে খারিজ করে তার ওপর কীভাবে শাসন কায়েমের রাজনীতি করা যায়, তা ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতি দেখেছে। সেই একই জাতি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ দেশে বাকি জাতিগোষ্ঠীদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এইসব ‘অন্য’ গোষ্ঠীর ওপর ক্ষমতা জারি রাখার কৌশল হিসেবে, ঠিক যেমন করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে চেয়েছিল বাংলা নয় বরং উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্যে দিয়ে। শুধু তাই নয়, একের পর এক পার্বত্য ভূমি, এলাকা, পাহাড়ের নাম পাল্টে ভূমির দখলদারি ও ‘বাঙালিকরণ’ প্রক্রিয়া সচল রাখা হয়েছে। এই দেশে তাই ‘রাঙ্গামাত্যে’ হয়ে গেছে রাঙ্গামাটি, ‘হবং পজ্জ্যা’ খবংপুড়িয়া, ‘শোং নাম হুং’ পাহাড় হয়ে উঠেছে রূপকথার চন্দ্রপাহাড় আর ‘তেংপ্লং চূট’ পাহাড় হয়ে গেছে নীলগিরি। এমনকি ‘সান্তাল’ হয়ে গেছে আমাদের বাঙালি শুদ্ধ ভাষার সাঁওতাল।

এভাবে একদিকে দেশের নাগরিকের বাঙালি ও মুসলিম পরিচিতিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পরিচয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ও অন্যদিকে অবাঙালি ও অমুসলিম জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষা ও ভূমিকেন্দ্রিক পরিচিতিকে অগ্রাহ্য করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র বার বার পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীদের পরিচয় নির্মাণ করেছে ‘অনাগরিক’ বা ‘অন্য’ বা ‘কেউ না’ হিসেবে। এই ‘অন্য’ ধর্ম, জাতি, ভাষার মানুষ রাষ্ট্রীয় না, তারা পুরোপুরি জাতি না, জাতির চাইতে কম কিছু- তারা রাষ্ট্রের ‘উপজাতি’। যেই মুহূর্তে এইসব জাতি-গোষ্ঠীর ভূমির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা আদি পরিচয়কে উপেক্ষা করা যায়, যেই মুহূর্তে এই মানুষদের বাঙালির মতো ‘পূর্ণ’ জাতি হওয়ার মর্যাদা কেড়ে নিয়ে দলিল-দস্তাবেজে তাদের ‘জাতির মতো কিছু একটা কিন্তু জাতি নয় এমন কিছু’ বানানো যায়, সেই মুহূর্তে এই মানুষেরা হারায় মানুষ হিসেবে তাদের ভিটেমাটি ও পাহাড়ের ওপর নিরঙ্কুশ অধিকার। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের যথার্থ বাঙালি নাগরিকদের মননে তাই এই ‘কেউ না’ মানুষের ভূমি যতো না তাদের নিজেদের, তার চেয়ে বেশি ‘বাঙালি মুসলিমের’, ‘বাঙালি মুসলিম’ রাষ্ট্রের।

যদিও দেশে আইন আছে। শান্তি চুক্তিও আছে। সেই চুক্তিতে পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি, ছয়টি সেনানিবাস ছাড়া বাকি সব ক্যাম্প প্রত্যাহার ও জুম্ম জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার কথাও লেখা রয়েছে। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন নেই, নেই জবাবদিহিতার চর্চা। বাংলাদেশে ভূমি মালিকানার প্রচলিত আইন আর পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীদের ভূমি মালিকানার ধরণ এক নয়। তাদেরটা সামাজিক। ‘সার্বজনীন সম্পদ-সম্পত্তি মালিকানা অধিকার’ নীতিই হলো তাদের ভূমি মালিকানার ভিত্তি, যেখানে মালিকানা বংশ পরম্পরায় মৌখিকভাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে। তিনটি সার্কেলের আওতায় পার্বত্য পাড়ার হেডম্যান এবং কারবারিরা এর ব্যবস্থাপনা করে থাকেন। তবে এই আইন মানা হয় না, হেডম্যান ও কারবারিদের তোয়াক্কা না করেই চলে ভূমি দখলের বন্দোবস্ত। আবার পর্যটন বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন হলেও, এটি শুধু কাগজে-কলমে জারি আছে, বাস্তবে এ বিষয়ে সঠিক কোনো নীতিমালা বা গাইডলাইন পরিষদের হাতে নেই। জেলা পরিষদকে উপেক্ষা করে বরাবরই বাণিজ্যিকভাবে প্রভাবশালীরা বন্দোবস্তের নামে পাহাড়ের জমি দখল করছে। ভূমি দখলের বিষয়টি তাই শুধু যথার্থ আইনের অনুপস্থিতির ফলাফল নয়। বরং প্রান্তিকের জমির ওপর প্রবলের একচেটিয়া অধিকারবোধ হবার যে মনোভাব ও চর্চা ক্ষমতাশীলরা দেশের সবখানে সর্বদা জারি রাখেন, ভূমিদখল তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আর সে কারণেই সমতলের অবাঙালি জাতিগোষ্ঠীদের জমির মালিকানা প্রচলিত ভূমি রেজিস্ট্রেশন নীতিমালার আওতায় নির্ধারণ করা হলেও, তারা প্রতিনিয়ত ভূমি হারানোর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। যেমন: সঞ্জীব দ্রং ও রুবায়েত ফেরদৌসরা একটি রিপোর্টে দেখান যে,  ১৯৮৪ সালে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক’র ‘Thana Afforestation and Nursery Development Project (TANDP)’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মাত্র একটি গেজেট নোটিফিকেশনের আওতায় মধুপুরে গারো জনগোষ্ঠীর ৪০ হাজার একর জমি অধিগৃহীত হয়েছে। আবার ২০০০-২০০৭ পর্যন্ত টাঙ্গাইলে মধুপুরে ৪৭৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ‘ইকো পার্ক’ তৈরি হওয়ায় হাজার খানেক মান্দি জাতিগোষ্ঠী তাদের ভিটে হারিয়েছেন। নিজ ভিটেতে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করতে গিয়ে পীরেন স্নাল, চলেশ রিসিল শহীদ হয়েছেন। 

আবার দেশের পার্বত্য অঞ্চলে ২০০টি মারমা ও ম্রো পরিবারকে ভিটে ছাড়া করার ফসল হচ্ছে আজকের নীলগিরি। নীলাচলের পর্যটন রিসোর্ট উন্নয়নে ত্রিপুরা, মারমা, তঞ্চগ্যা মিলে ১০০ পরিবার বিলীন হয়েছে। মারমা ও ত্রিপুরা পাড়ার ৩০০টি পরিবার উচ্ছেদের চিহ্ন বহন করে চলেছে এই বগালেক। বান্দরবনের রুমা উপজেলায় বমদের উচ্ছেদ করে গড়া হয়েছে অনিন্দ্য পর্যটন কেন্দ্র। কেওক্রাডং পাহাড়ে ৬০০ একর জায়গা দখল করে স্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র। সামস দেখান যে, এক সাজেক ভ্যালি সাজাতে ২০০৮ সালে সাতটি গ্রামের ৭০টি ঘর পোড়ানো হয়েছে। তারপরেও পাহাড়িদের আন্দোলন না থামায় ২০১০ সালে ৫০০ ঘরকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। রেং ইয়ং ম্রো নেংচেন তার লেখায় বান্দরবনের দুরবস্থা তুলে ধরে বলেন যে, উন্নয়নের নামে পামিয়া পাড়া, আদু পাড়া, দিরি পাড়ার ছড়ার ওপর ট্রাক চালিয়ে তাদের খাবার পানি ঘোলা করা হয়েছে। পাথর শ্রমিক পাহাড়ি নারীকে ধর্ষণ করেছে। ডেবা পাড়া, ক্রামাদি পাড়া, রামরী পাড়া, সাক্ষয় পাড়া, ক্লাংতুং, কোয়াং নাইচ্য কুয়া গ্রামের যেই মানুষগুলো কোনো এক ভীষণ শীতের রাতে কাঁদতে কাঁদতে ভিটে ছেড়েছিল, তারাই নিজেদের জায়গা জমি এক কোম্পানির দখলে চলে যাবার পর সেই ভিটে মাটিতেই সস্তায় মজুরি খাটছে। যত দিন না এইসব জাতিগোষ্ঠীর ভূমির সঙ্গে তাদের আদি সম্পর্ককে স্বীকার করে না নেওয়া হচ্ছে, ততোদিন দখলের এই ত্রাস, সন্ত্রাস বেঁচে থাকবে। শুধু মরবে পাহাড় আর তার সন্তানরা।

মনে হতেই পারে যে, এতো ভূমি-দখলের গল্প অদৃশ্য হয় কী করে। সবসময় কিন্তু গল্পগুলো অদৃশ্য নয়। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, তাদের সংগঠনগুলো ও তাদের অধিকার আদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সারাদেশের নানা স্তরের মানুষ নানাভাবে গল্পগুলো বলে যান। কিন্তু সংবিধান ও আমাদের জাতীয়তাবোধের মূলধারার সীমানা থেকে ‘বাদ পড়া’ এসব মানুষের গল্পগুলো অনেক সময়েই মূলধারার সংবাদ মাধ্যম, আলোচনা ও চিন্তা-চেতনার পরিসরে ঠাঁই পায় না। যেটুকুও বা পায় সেটুকু শোনার জন্য আমাদের কান প্রস্তুত নয়। সবহারাদের এই গল্পগুলো চাপা পড়ে আমাদের ব্যক্তিক মনে, পরিবারে, সমাজে, দেশে, রাষ্ট্রে এই দখল-সন্ত্রাসের যে রূপকথাগুলো ঘুরতে থাকে তার মাঝে। রূপকথা বোনাই হয় ভূমি দখলের ঘটনাকে যাতে ‘দখল’ হিসেবে চিনতে পারা না যায় তার জন্য। কখনো ‘বাঙালি’ হত্যার সাজানো নাটক তৈরি করে শত শত পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীদের ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, ১৯৮৯ সালের লংগদু হত্যাকাণ্ড যার একটি বড় উদাহরণ। কখনো বা উন্নয়নের সোনার কাঠি, রুপার কাঠির গল্প ফাঁদা হয়।

একদিকে শহরের ধুলো-ধোঁয়ার জালে আটকে পড়া আকাশ-তারা দেখতে না পারা বাঙালিকে শোনানো হয় লাল পাহাড়ের মিশুক মেঘেরা কীভাবে পায়ের কাছে এসে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে। বড় বড় হোটেল আর ট্রাভেল এজেন্সির বিজ্ঞাপনে থাকে ঝকঝকে পাহাড়ি নারীর স্নিগ্ধতা, রং-বাহারি পোশাক, নাপ্পি, বাঁশ কোঁড়ল আর মুরগীর ঝাল ঝাল তরকারীর হাতছানি। বাঙালি পর্যটকের বাংলা মন ‘শোং নাম হুং’ পাহাড়ের নাম শুনে উতলা হয় না। তাই সেই বাঙালির রূপকথার ফ্যান্টাসির জন্য শোং নাম হুং পাহাড় হয়ে ওঠে ‘চন্দ্রপাহাড়’। সেই সব পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তৈরি হয় রূপকথার বিশাল রাজবাড়ি। ১৫ হাজার টাকা দিয়ে বাঙ্গালি একরাতের রাজা-রাণী হয় সেই পাহাড়ের, হয়ে যায় কোনো এক ভোরের মেঘেদের মালিক।

অন্যদিকে, পাহাড়িকে বলা হয় যে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠলে নতুন রাস্তা হবে, নতুন দালান উঠবে, স্থানীয় বাজার চাঙ্গা হবে, হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে, মানুষের হাতে কাঁচা টাকা উঠবে, পুরনো মাচাং ঘর নতুন হবে, বিদ্যুতের আলো সেই ঘরকে ফকফকা করবে, পাহাড় ঘুরে বন-মোরগটা, বুনো-আলুটা, কচু-ওলটা, ঔষধি লতাটা খোঁজা লাগবে না। সেই দূর দূর পাহাড়েই পাওয়া যাবে রং ফর্সা করার তেলেসমাতি ক্রিম কিংবা গরম দিনের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পানীয়।

কিন্তু দিন শেষে কার পকেটে এই উন্নয়ন ঢোকে? গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে রাস্তা তৈরি হয়, সেই রাস্তার পাশে বাঁধ (ড্যাম) তৈরি হয়, পাহাড় দখল হয়। বাঁধের নীল জল, সবুজ পাহাড়ে আটকে পড়া মেঘ ধরার জন্য বানানো হয় নানা তারার হোটেল। শহরে বড় বড় ট্রাভেল এজেন্সি গড়ে ওঠে। রেন্ট-এ কারের ব্যবসা ধরে ফেলে পাহাড় থেকে পাহাড় ঘোরার শখটাকেও। শহর থেকে এসব হোটেলে বড় বড় কোম্পানির কতো শত পণ্যের যোগান যায় বাঙালি পর্যটকের দুই দিনের প্যাকেজকে উপাদেয় করে তোলার জন্য। এর কোনোটার সঙ্গেই পাহাড়িদের যোগসাজশ থাকে না। বড়জোর পাহাড়ি নারী-পুরুষ এসব হোটেলে হোটেল বয় বা স্পা কর্মী হয়ে নিজ পাহাড়ের মাটিতে শ্রমিক হয়ে কামলা খাটে। তবুও ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। পাহাড়ে মাইলের পর মাইল ঘুরেও হদিস মেলে না কোনো স্কুলের, এখানে গড়া হয় না কোনো হাসপাতাল। মাচাং ঘরগুলো নিখোঁজ হতেই থাকে, আর যেগুলো পড়ে থাকে সেগুলো দিনে দিনে হয় আরও জীর্ন, ঠিক যেমন হয় সেই ঘরের মানুষগুলো। ভিটে তলায় বাঁধের জলে, শেষ আশ্রয়ের খোঁজে যখন মানুষ দূর পাহাড়ে পা রাখে, তখন জানতে পারে সেটিও নাকি কারও ‘সংরক্ষিত’। কাকে তাড়িয়ে কার জন্য সংরক্ষিত হয় বাপ-মায়ের চড়ে বেড়ানো শত বছরের পাহাড়? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বারণ জেনেই রাতের অন্ধকারে মিয়ানমারে দেশান্তরী হতে গিয়ে স্থল মাইনে পা পড়ে জীবন হারায় কতো প্রউয়াই ম্রো।

তবুও উন্নয়নের রূপকথা সাজিয়ে বান্দরবনে ম্যারিয়ট বানানোর পায়তারা চলে। জারি থাকে ‘বাদ পড়ে’ যাওয়া গল্পগুলোকে চুপ করিয়ে দেওয়ার কারসাজি। বাঙালি পর্যটক পায়ের কাছে মেঘেদের লুটোপুটির সেলফি তোলার স্বপ্ন বোনে। আর সব হারানোর আতঙ্ক চোখে নিয়ে, অনেক হারানোর ব্যথা বুকে পুষে এই দেশে ‘কেউ একজন’ হয়ে উঠতে না পারা এই পাহাড়ি মানুষগুলো বার বার প্রতিবাদ করে। কখনো সে বাঁশির সুরে সুরে প্রতিবাদ জানায়, কখনো বা রেং ইয়ং ম্রো নেংচেনের মতো একলা কোনো যুবকের চিৎকারে পাহাড় কাঁপায়। কখনো বা ‘শাল বৃক্ষের মতন সিনা টান করে সে মানুষ হয়ে বাঁচতে’ পিরেনের মতো জান দেয়। তবে লড়াইটা শুধু তাদের একার না হোক, মানুষ হয়ে বাঁচার এই লড়াইয়ে আমরাও মানুষ হয়ে হাত বাড়াই, আমরাও সিনা টান করি।

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: গবেষক, পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গ, যুক্তরাষ্ট্র

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments