আমাদের বাতিঘর আলী যাকের

ভোরবেলার গ্রাম, প্রকৃতি, মানুষ, নদী দেখতে দেখতে ঢাকায় ফিরছি টাঙ্গাইল-বগুড়া-সিরাজগঞ্জ হয়ে। ইছামতী নদীর কিছু ছবিপোস্ট দিয়ে ফেসবুকে যেতেই পেলাম সংবাদটি। আমাদের আরেক বাতিঘর আলী যাকের আর নেই। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ভীষণ মন খারাপ। গাড়ি চলছে গাড়ির মতোই। কিন্তু, আমি মনে হলো থমকে গিয়েছি।
আলী যাকের। ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/ স্টার ফাইল ফটো

ভোরবেলার গ্রাম, প্রকৃতি, মানুষ, নদী দেখতে দেখতে ঢাকায় ফিরছি টাঙ্গাইল-বগুড়া-সিরাজগঞ্জ হয়ে। ইছামতী নদীর কিছু ছবিপোস্ট দিয়ে ফেসবুকে যেতেই পেলাম সংবাদটি। আমাদের আরেক বাতিঘর আলী যাকের আর নেই। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ভীষণ মন খারাপ। গাড়ি চলছে গাড়ির মতোই। কিন্তু, আমি মনে হলো থমকে গিয়েছি।

গত বছরের এই দিনে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো বন্দরের বাতিঘর দেখতে গিয়ে লিখেছিলাম— কী জাহাজ কী মানুষ পথ দেখানোর জন্য কিছু কিছু বাতিঘর জরুরি। তেমনি এক বাতিঘর ছিলেন আলী যাকের। আমাদের এই প্রজন্মকে গড়তে আলী যাকেরদের ভূমিকার তো শেষ নেই।

এই শহরে আলী যাকের স্যারকে দেখেছি, টুকটাক কথাও হয়তো হয়েছে। কিন্তু, সেভাবে ঘনিষ্ঠতা হয়নি কখনো। আলী যাকেরের বাতিঘর হয়ে ওঠার কাহিনীটা বেশ জানি। তার কারণ প্রথম আলোয় আমার সাবেক সহকর্মী জাহীদ রেজা নুর।

আলী যাকেরের সারা জীবন নিয়ে ২০১৯ সালের ১৭ আগস্ট একটা দারুণ লেখা লিখেছিলেন তিনি। শিরোনাম ছিল: আলী যাকেরের সারা জীবন। ছবির মতো করে আলী যাকেরকে পেয়েছি সেই লেখায়। মনে হলো সেখান থেকে তরুণ প্রজন্মের জন্য লিখি। দেখাই কী করে তিনি বাংলাদেশ চিনলেন, দেশটা স্বাধীন করলেন, দেশটা গড়ার জন্য আজীবন লড়লেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৪ সালে চট্টগ্রামে আলী যাকেরের জন্ম। কাগজে কলমে ৬ নভেম্বর, ১৯৪৪। আলী যাকের এই দেশ-মাটি চিনেছিলন এক জেলা থেকে আরেক জেলা ঘুরে ঘুরে। বাবা মোহাম্মদ তাহের বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা। সেই সুবাদে এই দেশের এক জেলা থেকে আরেক জেলা। চট্টগ্রাম-খুলনা-কুষ্টিয়া নানা শহরে বড় হয়ে কিশোর বয়সে আসলেন ঢাকায়। কারণ, তার বাবা তখন প্রাদেশিক সরকারের সচিব। তবে ঢাকায় এসে কিছুদিন পরেই তার বাবা সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করলেন বাওয়ানি জুট মিলস ও বাওয়ানি টেক্সটাইলসে।

ঢাকায় এসে সেন্ট গ্রেগরি থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে আলী যাকের ভর্তি হলেন নটরডেমে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করলেন ১৯৬২ সালে।

আলী যাকেরের লেখাপড়া কিন্তু সমাজবিজ্ঞানে। ধারণা করি, এই লেখাপড়াই তাকে এই দেশ-সমাজ বুঝতে সহায়তা করেছে। পারিবারিকভাবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তখনকার প্রধান ড. সাজ্জাদ হোসেন সেই সময় তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সমাজবিজ্ঞানের চেয়ারম্যান জন ই ওয়েনের সঙ্গে। বাংলা, ইংরেজি বা অর্থনীতির কথা না বলে ওয়েন পরামর্শ দিলেন সমাজবিদ্যা পড়তে। সে বিষয়েই স্নাতক হলেন আলী যাকের। এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে ছাত্র রাজনীতি— এগুলো তাকে স্বাধীনতা আন্দোলন বুঝিয়েছে।

আলী যাকের যে এই দেশের সেরা নাট্য অভিনেতা ও সেরা বিজ্ঞাপনদাতা তার একটা বড় কারণ আমার মনে হয় সমাজ নিয়ে লেখাপড়া। অবশ্য বিজ্ঞাপন নির্মাতার কাজটা সরাসরি করেছিলেন ১৯৬৭ সালে করাচিতে ক্রফোর্ডস ব্রিটিশ এজেন্সিতে ট্রেইনি এক্সিকিউটিভ হিসেবে শুরু করে। এরপর ১৯৬৯ সালে ঢাকায় ফিরে এশিয়াটিকে যোগ দিলেন।

এই বাংলা তখন উত্তাল। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গেলেন। প্রশিক্ষণ নিলেন। এরপর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি সার্ভিসে। সেখানেই একাত্তরের শব্দ সৈনিক। স্বাধীন বাংলাদেশ। এরপর দেশে ফিরে দায়িত্ব নিলেন এশিয়াটিকের। আর যুদ্ধ চলাকালেই নাট্যজন মামুনুর রশীদ একদিন তাকে বলেছিলেন, ‘দেশে গিয়া কী করবি?’ আলী যাকের বলেছিলেন, ‘নাটক করুম।’

হলোও তাই। আরণ্যকের ‘কবর’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমেই তিনি নাট্যচর্চায় নিজেকে নিবেদন করেন। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকে প্রথম অভিনয়। ২০ ফেব্রুয়ারি একটি এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ও সন্ধ্যায় দুটি শো হয়েছিল নাটকটির। সকালের শো সরাসরি প্রচার করেছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। সেটা দেখেছিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি জিয়া হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান। তারা সন্ধ্যায় এসে আলী যাকেরকে নাগরিকে যোগ দিতে বললেন। শুরু হলো আলী যাকেরের নতুন জীবন। আমরা পেলাম নতুন এক আলী যাকেরকে।

আমাদের শৈশবকে রাঙিয়েছে বিটিভি ও আলী যাকেরদের মতো মানুষেরা। ‘বহুব্রীহি’, ‘আজ রবিবার’— এসব নাটকে তার অভিনয় আজীবন মনে থাকবে। ঢাকার মঞ্চে ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘গ্যালিলিও’, ‘ম্যাকবেথ’— এগুলোর কথাও বা ভুলি কী করে। একদিকে বিজ্ঞাপন, আরেক দিকে নাটক। দেশ নিয়ে ভাবনা। এভাবেই আলী যাকের হয়ে উঠলেন এই জাতির বাতিঘর। আমাদের বাতিঘর।

আলী যাকের বিজ্ঞাপন সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি। যুক্তরাজ্যের রয়েল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির পূর্ণ সদস্য। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ অনেক পুরস্কার। কিন্তু, সব পুরস্কারের চেয়ে বড় পুরস্কার মানুষ হয়ে ওঠা। সত্যিকারের মানুষ। জাতির বাতিঘর।

প্রিয় যাকের ভাই, ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও আপনারাই যে আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন। আপনারাই যে এই জাতির পথ প্রদর্শক। এই বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, যতদিন থাকবে লাল সবুজের এই পতাকা ততদিন থাকবেন আপনারাও। আপনাকে শ্রদ্ধা। স্যালুট।

শরিফুল হাসান, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

10h ago