জাহাজ আর জাহাজীদের সম্ভাবনা ও সংকটের কথা
পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম খরচে, নিরাপদে, স্বল্প সময়ে অধিক পরিমাণ পণ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম জাহাজ। চাল, চিনি, তেল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় গাড়ি, মোবাইল, ল্যাপটপ, জামা-কাপড় এমন কিছু নেই যেটা জাহাজে আসে না। আমাদের দেশে ভালো কোয়ালিটির কিছু বোঝাতে সবাই 'এক্সপোর্ট কোয়ালিটি' বা 'ইমপোর্টেড' বলে থাকে। আর পৃথিবীর এই এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের প্রায় পুরোটাই হচ্ছে জাহাজকেন্দ্রিক। বাই এয়ার খুব অল্প পরিমাণ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে যা আবার অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
এই যে জাহাজে পণ্য পরিবহন হয় সেই জাহাজের কিন্তু নানা রকমফের আছে। ধরেন, যে জাহাজে আপনি শখের গাড়ি আমদানি করবেন সে জাহাজে তেল আমদানি করতে পারবেন না। এভাবে গাড়ি, তেল, গ্যাস, চাল, চিনি, গার্মেন্টসের তৈরি পোশাক ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পণ্য পরিবহনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের জাহাজ আছে। বিভিন্ন ধরনের জাহাজ সম্পর্কে সংক্ষেপে একটু ধারণা দিচ্ছি।
প্রথমেই বলি জেনারেল কার্গো শিপের কথা। মূলত ভারী আর বেঢপ সাইজের পণ্য বহন করার জন্য এগুলো ব্যবহৃত হয়। যেমন, বড় কোন পাওয়ার স্টেশন বা মাইনিং বা অফ-শোর ইন্সটলেশনের জন্য বানানো পণ্য যা সাধারণ স্ট্যান্ডার্ড সাইজের কন্টেইনারে ফিট হয় না। এসব একেকটা কার্গোর ওজন ১০০০ টনেরও বেশি হতে পারে।
কন্টেইনার ক্যারিয়ার শব্দটি বেশ প্রচলিত। এই ধরনের জাহাজে মূলত কন্টেইনার ক্যারি করে যাতে টাইলস, ল্যাপটপ, মোবাইল, জামাকাপড় থেকে ফলমূল, হিমজাত খাদ্য/পণ্য ইত্যাদি পরিবহন করা হয়।
বাল্ক ক্যারিয়ারে কয়লা, আকরিক, চাল, চিনি থেকে সিমেন্টের ক্লিংকার টাইপ সব জিনিস বাল্ক ক্যারিয়ারে পরিবহন করা হয়।
পিউর কার অ্যান্ড ট্রাক ক্যারিয়ারে সব ধরনের কার, বাস, ট্রাক টাইপ যানবাহন পরিবহন করা হয়। গ্যাস ক্যারিয়ার এল.এন.জি, এল.পি.জি ইত্যাদি গ্যাস বহনের জন্য উপযোগী।
অয়েল ট্যাংকারে পরিশোধিত, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল পরিবহন করা হয়। কেমিকেল ট্যাংকারে মিথানলসহ সমস্ত ধরনের কেমিকেল অধিক পরিমাণে পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। প্যাসেঞ্জার এবং ক্রুজ শিপ যা মূলত ভ্রমণ আর বিনোদনের জন্য এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাত্রী পরিবহন করে।
এই যে নানা ধরনের জাহাজের কথা বললাম এগুলো যারা নিরাপদে একদেশ থেকে অন্য দেশে নেয়ার দায়িত্ব পালন করে তাদেরকে মেরিনার বা জাহাজী বলা হয়। আমাদের দেশে মেরিন অফিসার আর নেভী অফিসারদের মধ্যে অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন।
মেরিনারদের কাজ হচ্ছে পন্য বা যাত্রীবাহী জাহাজ (মার্চেন্ট শীপ) পরিচালনা আর নেভী অফিসারদের কাজ যুদ্ধ জাহাজে। মেরিনারদের অস্ত্র-গুলি, ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে কোন কারবার নেই। যদিও আমাদের চলার পথ একই অর্থাৎ উত্তাল সমুদ্র!
এবারে এসব মার্চেন্ট জাহাজ নিয়ে একটু বিস্তারিতভাবে বলি। এই যে এত বড় একটা জাহাজ কূলকিনারা ছাড়া নীল দরিয়ায় চলে সেটা কীভাবে? নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, ইঞ্জিন লাগবে! তাহলে ইঞ্জিন চালানো, মেইন্টেন্যান্স এসবের জন্য ইঞ্জিনিয়ার লাগবে। মানে জাহাজে একটা ইঞ্জিন ডিপার্টমেন্ট থাকবে।
ইঞ্জিন চালু করার পর সমুদ্রে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা জাহাজ সঠিক গন্তব্যে চালাতে হবে, মানে নেভিগেইট করতে হবে। এই নেভিগেইটররা আবার জাহাজের ডেকের প্রায় সব কাজই করে বলে এই ডিপার্টমেন্টের নাম ডেক ডিপার্টমেন্ট।
এখন এই ডেক-ইঞ্জিন দুই ডিপার্টমেন্টের লোকজনই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। একদল ইঞ্জিন চালানো নিয়ে আরেকদল জাহাজ চালানো নিয়ে। তাহলে এদের রান্নাবাড়া-খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা কে করবে? ঠিক ধরেছেন! রান্না ও খাওয়াদাওয়ার জন্য তৃতীয় এবং শেষটার নাম হলো গ্যালি ডিপার্টমেন্ট! এই তিন ডিপার্টমেন্ট মিলেই জাহাজ।
জাহাজের কথা শুনলে সবার প্রথমেই সবাই যেটা বলে এবং একমাত্র যে শব্দটা সবাই জানে সেটা হলো, ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন হলেন ডেক ডিপার্টমেন্ট এবং পুরো জাহাজের ইনচার্জ। ডেক ডিপার্টমেন্টে ক্যাপ্টেনসহ ৪ জন অফিসার থাকে। ক্যাপ্টেন/মাস্টার, চিফ অফিসার, সেকেন্ড অফিসার আর থার্ড অফিসার।
ইঞ্জিন ডিপার্টমেন্টেও সাধারণত ৪ জন অফিসার থাকে। চিফ ইঞ্জিনিয়ার (হেড অব ইঞ্জিন ডিপার্টমেন্ট), সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার আর ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার। প্রত্যেক অফিসারের সাথে ডিউটির সময় একজন করে সহকারী থাকে যাদেরকে রেটিং বলা হয়। সাধারণত ক্যাপ্টেন এবং চিফ ইঞ্জিনিয়ার বাদে বাকি সব অফিসারদের প্রতিদিন বাই রোটেশান কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা করে ডিউটি করতে হয়। ৮-১২ টা যথাক্রমে ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার আর থার্ড অফিসার, ১২-৪ টা থার্ড ইঞ্জিনিয়ার আর সেকেন্ড অফিসার আর ৪-৮ টা সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার আর চিফ অফিসার যথাক্রমে ইঞ্জিন রুম আর ব্রিজে ডিউটি করে। জাহাজ যেখান থেকে নেভিগেইট করে সে জায়গাকে বলা হয় ব্রিজ। ডিউটির সময় ডেক অফিসার তার সহকারীসহ ব্রিজে আর ইঞ্জিনিয়ার তার সহকারীসহ ইঞ্জিনরুমে থাকে। অনেক জাহাজে আবার সব ইঞ্জিনিয়ার-রেটিং সকাল ৮-৫ টা ডিউটি করে। মাঝে রাত ৯-১০ টা একজন ডিউটি ইঞ্জিনিয়ার আর রেটিং এসে রাউন্ড নেয় সব মেশিনারি ঠিকমতো চলছে কিনা দেখতে। এসব জাহাজের ইঞ্জিন রুমকে বলা হয় UMS (Unattended Machinery Space)। বেশিরভাগ জাহাজে ইঞ্জিন ডিপার্টমেন্টে একজন ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ারও থাকে জাহাজের সব ধরনের ইলেক্ট্রিক কাজের জন্য।
তৃতীয় গ্যালি ডিপার্টমেন্টে মেইনলি একজন কুক আর একজন স্টুয়ার্ড থাকে। কুকের কাজ তিন বেলা রান্না করা আর স্টুয়ার্ডের কাজ খাবার সার্ভ করা, থালা-বাসন ধোয়া ইত্যাদি। বোঝার সুবিধার্থে আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্ট বললেও আমরা সবাই একটা পরিবারের মতো থাকি। নানা দেশের, নানা বর্ণের, নানা ধর্মের ২০-২২ জনের একটা পরিবার ভাসমান লৌহ কারাগারে করে অবিরাম ছুটে চলি দেশ থেকে দেশান্তরে।
আমাদের দেশে মেরিনারদের কমিউনিটি বেশ ছোট হলেও আমাদের দেশের অর্থনীতিতে মেরিনারদের ভূমিকা অপরিসীম। একজন জাহাজের মাস্টার বা চিফ ইঞ্জিনিয়ার মাসে জাহাজ-কোম্পানিভেদে ৭৫০০ থেকে ১৪,০০০ ইউএস ডলার পর্যন্ত আয় করে থাকেন। অন্যান্য র্যাংকের অফিসারও প্রায় ১০০০ থেকে ১১ হাজার ডলার পর্যন্ত আয় করেন। মেরিনারদের কিছু কিছু ব্যাপারে সরকার আরও বেশি যত্নশীল হলে এটা আমাদের দেশের জন্য সোনার ডিমপাড়া হাঁসের মতো হতো। কয়েকটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উল্লেখ করছি-
প্রথমত, বিভিন্ন দেশে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা আমাদের বাংলাদেশি মেরিনারদের চাকরির জন্য প্রধান অন্তরায়। মেরিনারদের চাকরি পুরোটাই ইন্টারন্যাশনাল। আমাদের ট্রেইনিং, সার্টিফিকেশন থেকে সবকিছু হতে হয় আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পোর্ট থেকে মেরিনারদের জাহাজে জয়েন বা জাহাজ থেকে দেশে ফেরার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু অনেক দেশেই বাংলাদেশি মেরিনারদের জাহাজে উঠা-নামা নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার সৃষ্টি হয় যা ভারতীয় বা ফিলিপিনোদের ক্ষেত্রে নাই বললেই চলে। সেজন্য অনেক বড় বড় শিপিং কোম্পানি বাংলাদেশি মেরিনারদের নিয়োগে আগ্রহী হয় না। এ জটিলতা এড়ানো গেলে আমাদের বাংলাদেশি মেরিনাররা তথা বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি উপকৃত হবে।
সরকারের কাছে অনুরোধ, বাংলাদেশি সকল মেরিনারদের জন্য পৃথিবীর সকল দেশে বিশেষ করে যেসব দেশ/পোর্টে প্রতিনিয়ত ক্রু-চেঞ্জ হয়ে থাকে সেসব দেশের সাথে কূটনৈতিকভাবে আলোচনা করে আমাদের সাইন অন/অফ সহজ করা। আরব আমিরাত, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, সাউথ কোরিয়া, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশে মেরিনারদের জন্য স্পেশাল ভিসার ব্যবস্থা করা।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশি মেরিনারদের সার্টিফিকেট ইন্টারন্যাশনালী রিকগনিশনের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ হাতে নেয়া। মাল্টা-বারমুদা ইত্যাদি ফ্লাগ রেজিস্টার্ড জাহাজে বাংলাদেশি সার্টিফিকেট রিকগনাইজ না করায় বাংলাদেশি অনেক মেরিনার সেসব জাহাজে চাকরির সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশ লাখ লাখ রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তৃতীয়ত, ডেসার্শন বা জাহাজ থেকে পালানো বন্ধ করা। আমাদের দেশের অনেক মেরিনার বিশেষ করে যারা রেটিংস অর্থাৎ অফিসার নয় তাদের অনেকের কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পোর্টে গিয়ে পালিয়ে যাবার প্রবণতা থাকে। কেউ একজন এভাবে পালিয়ে গেলে নিয়োগকারী কোম্পানিকে জরিমানা গুনতে হয় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। ফলে একজন পালিয়ে গেলেও স্বাভাবিকভাবে সেসব কোম্পানির দরজা আজীবনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সত্তর-আশির দশকে ফিলিপাইনে এই সমস্যার সৃষ্টি হয় যা তারা দ্রুতই নিয়ন্ত্রণ করে জিরো ডেসার্শনে নিয়ে এসেছিল। আমাদের দেশের সরকারেরও এ নিয়ে কঠোর আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। এ সমস্যার জন্য প্রতিনিয়ত আমরা চাকরির বাজার হারাচ্ছি।
চতুর্থত, আমাদের দেশে হাতে গোনা দু'একটা ছাড়া বড় বড় কোম্পানিগুলোর নিজস্ব কোন অফিস নেই। অথচ ভারত আর ফিলিপাইনে প্রায় সমস্ত বড় বড় কোম্পানির অফিস আছে। এমনকি মিয়ানমারেও এখন অনেক কোম্পানি অফিস দিয়েছে। আমাদের সরকার যদি এ ব্যাপারে আরেকটু আন্তরিক হয় তাহলে অনেক কোম্পানি হয়তো এদেশে নিজস্ব অফিস খুলতে আগ্রহী হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের চাকরির বাজার আরও বিস্তৃত হবে।
এছাড়াও মেরিন অফিসারদের জন্য একটা মিনিমাম বেতন নির্দিষ্ট করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে জুনিয়র অফিসারদের ক্ষেত্রে। মিনিমাম নির্দিষ্ট কোন স্যালারি না থাকায় অনেক কোম্পানি জুনিয়র অফিসারকে রেটিংয়ের চেয়েও কম বেতনে চাকরি করাচ্ছে যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অসম্মানজনক।
প্রতিবছর মেরিন ক্যাডেট ভর্তির সংখ্যা নিয়েও আমাদের চিন্তা করা উচিত। চাকরির বাজার বৃদ্ধি না করে শুধু ক্যাডেট সংখ্যা বাড়ানো কোনভাবেই কাম্য নয়। অনেক দেশেই ডিমান্ড অনুযায়ী ক্যাডেটের সাপ্লাই কম-বেশি করা হয় যা আমাদেরও অনুসরণ করা উচিত। করোনার পর এমনিতেই সারাবিশ্বে একটা অর্থনৈতিক ধসের আশংকা করছে বিশেষজ্ঞরা। আমাদেরও সেটা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা উচিত। এমতাবস্থায় যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার করতে আগ্রহী তাদেরও ভালোভাবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে অনুরোধ করব।
পরিশেষে, মেরিন প্রফেশন নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আকর্ষণীয় যা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশে অনেকের কাছে এটা ড্রিম জব। এছাড়াও বিশ্ব ভ্রমণ, নীল আকাশ, নীল সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, মাঝ দরিয়ার বুক শীতল করা বিশুদ্ধ বাতাসের মায়া চাইলেই সহজে কেউ ছাড়তে পারে না। তাইতো পরিবারের ভালবাসা উপেক্ষা করে একজন জাহাজী বারবার ফিরে যায় বিক্ষুব্ধ ফেনিল জলরাশিতে।
(লেখক: এক্স-ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি ৪৭তম ব্যাচ, মেরিনার হিসেবে বিদেশে কর্মরত)
Comments