মুক্তিযুদ্ধ

২২ এপ্রিল ১৯৭১: পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে না: ভাসানী

​মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল। এই দিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে না।
২২ এপ্রিল এক প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ছবি- এপি আর্কাইভ

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল। এই দিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে না।

এই দিন পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে বগুড়া শহরের পতন ঘটে। মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশের মুখে কুমিল্লার গঙ্গাসাগরে  প্রাণ হারায় ছয় হানাদার সেনা। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে হানাদার বাহিনী ফেনী দখল করতে ব্যর্থ হয়।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ২২ এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে না। অবিভক্ত ভারতের ১০ কোটি মুসলমান যে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তান তাকে অবজ্ঞা করেছে। পাকিস্তান আন্দোলনের এই মৌলিক প্রস্তাবটিকে অবজ্ঞা করে বিগত ২৩ বছর ধরে তারা পূর্ব বাংলাকে তাদের কলোনি করে রেখেছে। এই চূড়ান্ত  সংগ্রাম বীর বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সংগ্রাম। শোষণ থেকে মুক্তি ও হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লড়াই।’

তিনি বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি দল, মত, পেশা, বয়স নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার ও সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।

এই দিন ঢাকায় শান্তি কমিটির আহবায়ক খাজা খয়ের উদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘শান্তি কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা। দেশদ্রোহী ভারতের দালাল মুক্তিবাহিনীর কবল থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে।’

বিদেশি বুদ্ধিজীবী ও রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গের বিবৃতি

এই দিন অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমোহন এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর এমন অভিযান ও গণহত্যা চরম নিন্দনীয়। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করি। অস্ট্রেলিয়ার মানুষ আসা করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শিগগির সামরিক শাসন উঠিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। আমরা এটিও আশা করি, সামরিক বাহিনীর এমন তৎপরতা, গণহত্যা ও নির্যাতন বন্ধ হবে। পাকিস্তান সরকারের উচিৎ পাকিস্তানের সংসদে বসে পূর্ববর্তী নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।’

বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যার অভিযোগ তুলে ১০টি প্রভাবশালী দেশের বুদ্ধিজীবীরা এই দিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন দ্য ইউনিভার্সিটি ইমারজেন্সি (আইসিইউই) এর মাধ্যমে একটি অভিযোগ পত্র  প্রকাশ করেন। এই অভিযোগ পত্রে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের কারণে সাধারণ নিরীহ মানুষের সঙ্গে জ্ঞান বিতরণকারী বুদ্ধিজীবীরা নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানে নিজস্ব জ্ঞানশৈলী ও মুক্ত বুদ্ধি চর্চা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় আমরা বিবেকবান ও সচেতন মানুষ হিসেবে চুপ থাকতে পারি না।’

ঢাকার বাইরের যুদ্ধ ও গণহত্যা

২২ এপ্রিল কুমিল্লার গঙ্গাসাগরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সৈন্যদের অ্যামবুশ করে। প্রচণ্ড যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের ছয় সৈন্য নিহত হয়। আহত হয় ২০ জনের বেশি সৈন্য। হানাদার বাহিনী অবস্থা বেগতিক দেখে পিছু হটলে মুক্তিযোদ্ধারা গোলাবারুদ ও অস্ত্র দখল করে নেয়।

হিলিতে পাকিস্তানি হানাদারেরা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সীমান্ত রেখার ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিত  প্রচণ্ড আক্রমণ করে। অতর্কিত হামলায় মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের ভূখণ্ডে আশ্রয় নেন।

রাজশাহীর গোদাগাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহে পাকিস্তানি হানাদাররা হামলা চালায়। পাকিস্তানি হানাদারদের আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের হামলায় বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

পাকিস্তানি হানাদারদের হামলায় বগুড়া শহরের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে যায়।

পাকিস্তানি হানাদারেরা পাবনার সিরাজগঞ্জ মহকুমার  বাঘাবাড়িতে এসে শাহজাদপুর লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষের পর বাঘাবাড়ি ও শাহজাদপুরে পাকিস্তানি হানাদারদের পতন হয়।

পাকিস্তানি হানাদারেরা হেলিকপ্টারে করে মাদারীপুরে এসে শহরের ওপর গোলাবর্ষণ করে। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল মাদারীপুরের সংগ্রাম কমিটির কার্যালয় ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ মিলন সিনেমা হল। এই হামলায় কেউ নিহত না হলেও বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ আহত হন।

২২ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারেরা নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম থেকে ত্রিমুখী আক্রমণ করে ফেনীর ওপর। মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফেনী দখল করতে না পেরে স্ব স্ব ক্যাম্পে ফেরত যায় তারা।

এই দিন চট্টগ্রামের দোহাজারীতে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষের পর মুক্তিবাহিনী পিছু  হটতে বাধ্য হয়েছিল।

ময়মনসিংহ জেলা ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মুহম্মদ আশরাফ হোসাইনের নেতৃত্বে জামালপুর শহরে প্রথম আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। স্থানীয় এক পত্রিকায় আল বদর বাহিনী নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। যেখানে লেখা ছিল, ‘আলবদর একটি ন্যায়! একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আলবদর সেখানে। যেখানেই দুষ্কৃতকারী দেশদ্রোহীরা, আলবদর বাহিনী সেখানেই। ভারতীয় চর দুষ্কৃতকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল হিসেবে শিগগির ধরা দেবে।’

রাজশাহী থেকে পাকিস্তানি হানাদারেরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজশাহী থেকে নওগাঁ শহরে প্রবেশ করে। সেদিন রাতে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্দেশনায় শান্তি কমিটি গঠন করা  হয়। নওগাঁ শহরে তাণ্ডবলীলা চালানোর পরে পাকিস্তানি হানাদারেরা শহরের লর্ড লিটন ব্রিজের পূর্ব পাশে যাওয়ার সময় দেখতে পায়, এক যুবক জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে সামনে আসছে। এ সময় পাকিস্তানি হানাদারেরা গুলি চালালে ১৯ বছর বয়সী আকালু নামের সেই যুবক শহীদ হন। নওগাঁ শহরের প্রখ্যাত প্রবীণ নাট্যকর্মী বালা সাহাকে (৮০) নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদারেরা।

ময়মনসিংহের মধুপুর জঙ্গলে পাকিস্তানি হানাদারেরা মুক্তিবাহিনীর ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী প্রথমে পিছু হটলেও পরে হালুয়াঘাটে এসে একত্র হয়ে অবস্থান নেয়।

১১ নম্বর সেক্টরকে নাজমুল হক তারা, তফাজ্জল হোসেন, এম.এ. আলম ও নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে চারটি সাব সেক্টরে ভাগ করা হয়।

পাকিস্তানি হানাদারেরা সাতক্ষীরা থেকে কালীগঞ্জে পৌঁছায়। এর আগের দিন পাকিস্তানি হানাদারেরা সাতক্ষীরা টাউন হাই স্কুলে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের মধ্য থেকে বেশীরভাগ শরণার্থীকে পার্শ্ববর্তী দিনেশ কর্মকারের বাড়িতে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। একই দিন সাতক্ষীরা  শহরের কাটিয়া এলাকার অ্যাডভোকেট কাজী মসরুর আহমেদের দ্বিতল বাড়ির পূর্বাংশ ধ্বংস করে তাকে ও তার শ্যালক শেখ মাসুদার রহমানকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। এরপর হানাদারেরা সুলতানপুর কুমোরপাড়ায় একই পরিবারের তিন জনকে হত্যা করে এবং শেখ মশির আহমেদের বাড়ি ধ্বংস করে সেই বাড়ির সামনে সিলভার জুবিলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল কাদের ও সাতক্ষীরা কোর্টের মোহরার পুণ্য শাহকে গুলি করে হত্যা করে।

 

তথ্যসূত্র-

রক্তে ভেজা একাত্তর: মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: দ্বিতীয়, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা: ২৩ এপ্রিল ১৯৭১

দৈনিক পাকিস্তান: ২৩ এপ্রিল ১৯৭১

 

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

 

আরও পড়ুন:

২১ এপ্রিল ১৯৭১: ফরিদপুরের শ্রীঅঙ্গন গণহত্যা, বিশ্ব নেতাদের ভাসানীর চিঠি

২০ এপ্রিল ১৯৭১: দিল্লিতে ৩০ পাকিস্তানি কূটনীতিক বহিষ্কার, ঢাকায় শান্তি কমিটির মিছিল

১৯ এপ্রিল ১৯৭১: প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ১৮ নির্দেশনা

১৮ এপ্রিল ১৯৭১: বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন

স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সূচনা, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ

১৬ এপ্রিল ১৯৭১: প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার শপথের অপেক্ষা, ঢাকায় কারফিউ শিথিল

১৫ এপ্রিল ১৯৭১: নিভৃতে কেটেছে বাংলা নববর্ষ, ভয়ে-আতঙ্কে ঢাকা ছাড়ে মানুষ

১৩ এপ্রিল ১৯৭১: চারঘাট গণহত্যা ও ঘটনাবহুল একটি দিন

১২ এপ্রিল ১৯৭১: বালারখাইল গণহত্যা ও ঘটনাবহুল একটি দিন

১১ এপ্রিল, ১৯৭১: দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান তাজউদ্দীন আহমদের

১০ এপ্রিল: মুজিবনগর সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিবস

Comments

The Daily Star  | English

3 quota protest leaders held for their own safety: home minister

Three quota protest organisers have been taken into custody for their own safety, said Home Minister Asaduzzaman Khan

6m ago